ঠিক ভুল বিচার করবে কে?

thik vul... muktodhara story image

 thik vul... muktodhara story image

||১||

“টেবিলে লুচি কিন্তু ঠান্ডা হয়ে যাবে, তাড়াতাড়ি আয় মা “- ডাক দিলো নবনীতা, প্রীতম আর পৃথার মা | পৃথা লুচির গন্ধ পেয়েই এক ছুট্টে ডাইনিং টেবিলে | গপাগপ লুচি মুখে পুরতে ব্যস্ত পৃথা, খানিকটা খাওয়ার পর খেয়াল পড়ল, মা কই খেল না তো? তাকিয়ে দেখল মা তখন অফিসের শাড়িটাও চেঞ্জ করেনি, আগে পৃথাকে খেতে দিয়েছে তারপর নিজে ফ্রেশ হবে, খাবে | এগুলো দেখেই মাঝে মাঝে নিজেকে খুব অসহায় লাগে পৃথার | ও স্কুলে পড়ে, ক্লাস ৭, কিন্তু ক্লাসের বাচ্চাদের মতো না, অনেক বেশি ম্যাচিওর, পরিস্থিতির চাপে | ওর খুব অসহায় লাগে সব দেখেও মা-র জন্য কিছু করতে পারে না বলে, খুব কষ্ট হয় মা-র জন্য ওর | প্রীতম গেছে খেলতে, এসে জলখাবার খাবে | নবনীতা এতক্ষণে নিজের জন্য সময় বের করে ফ্রেশ হতে গেল, ছেলে এলে খাবে |

||২||

নবনীতা ছেলে মেয়েকে নিয়ে ভবানীপুরে নিজের শ্বশুর বাড়িতে থাকে, স্বামী মারা গেছে যখন তখন প্রীতম খুবই ছোট, পৃথা একটু বড় | নবনীতার বয়স তখন মাত্র ৩০, একটা অ্যাক্সিডেন্ট-এ নবনীতার জীবনের সব রং নির্দয়ের মত কেড়ে নিয়ে চলে গেছিল, বড্ড ভালবাসত আবীরকে, নবনীতা | ওর ভালবাসা দিয়েও আটকাতে পারেনি আবীরের চলে যাওয়া | তারপর থেকে শুরু আরেক লড়াই, ইনসিওরেন্সের টাকাটা পেয়েছিল নবনীতা, কিন্তু তাতে কতদিন? চাকরি বিয়ের পর আবীরের কথাতেই ছেড়ে দিয়েছিল, আবার একই লড়াই শুরু হলো | আবীরের মৃত্যর এক বছরের মাথায় চাকরিটা পেয়েছিল নবনীতা, সেই থেকে চলছে অস্তিত্বের লড়াইটা |

****************

ঘড়ির কাঁটা রাট দশটা ছুঁই ছুঁই, কালকের স্কুলের হোম ওয়ার্ক শেষ পর্যায়ে | ছোট্ট প্রীতমকে ঘুম চোখে ঐকিক নিয়ম বোঝাচ্ছিল নবনীতা, চোখ দুটো আর খুলে রাখতে পারছিল না, সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখ দুটো বড্ড ভারী | হোম ওয়ার্ক শেষে চোখটা লেগে গেছিল, শাশুড়ি মার ডাকে ধড়মড়িয়ে উঠল নবনীতা | ঘড়িতে দেখল পৌনে এগারোটা | ইসস, কত্ত রাত হয়ে গেল, ছিছি, বাড়ির সবার খেতে দেরী হয়ে গেল শুধু ওর ঘুমের জন্য, কি করে যে এতক্ষন ঘুমিয়ে পড়ল |

||৩||

বাড়ির বড় বৌ বলেই দায়িত্বগুলো অলিখিত ভাবে তার উপরই পড়ে, খুব স্বাভাবিক, নবনীতার ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি | তার উপর কম বয়সের বিধবা, চাকুরীরতা এই বিশেষণগুলো বসার পর দায়িত্ব কর্তব্যের পাল্লাটা একটু বেশিই ভারী নবনীতার জন্য | শাশুড়িমা প্রথম দিন থেকেই কাজের রুটিন শুনিয়ে দিয়েছিলেন, তারপর থেকে সেই রুটিনের অন্যথা হয়নি ওর, নিজের ইচ্ছাতেই নিজেকে উজাড় করে সংসারটা গুছিয়ে রাখে ও | ননদ, শাশুড়িমার চোখে না পড়লেও নবনীতার ক্লান্ত মুখটা দেখে ওর শ্বশুর মশাই, ওর একমাত্র দেওর-এরও খুব অসহায় লাগে | নবনীতার দেওর বুবাই মানে সুবীর এখন সবে কলেজের সেকেন্ড ইয়ার, টিউশনি পড়িয়ে কতটাই বা সাহায্য করা সম্ভব, তাও ও ওর মতন চেষ্টা করে বৌদির পাশে দাঁড়ানোর | শ্বশুর মশাই-এর পেনশনের টাকায় এতগুলো পেট চললেও পৃথা প্রীতমের লেখাপড়া, আনুসাঙ্গিক খরচ চালানো কষ্টকর ব্যাপার, তাই এই মানুষটাও বড় নিরুপায় |

****************

আজ নবনীতার বাড়ি ফিরতে প্রায় ঘন্টা খানেক দেরী হয়ে গেল | রান্না-বান্নার পুরো দায়িত্বটাই আস্তে আস্তে ওর কাঁধে পড়ছে, চেয়েছিল একটা রান্নার লোক রাখতে, শাশুড়িমার অনুমতি নেই, উনি বাইরের লোকের হাতের রান্না খাবেন না, অগত্যা |

সবার জন্য খাবার কিনে এনেছিল ও, তাও ঢুকতেই শাশুড়িমার রোষের মুখে পড়তেই হলো | উনি তো নবনীতা আর মাছ-মাংস খাক সেটাও চাননি, তখন শ্বশুর মশাই-ই দাঁড়িয়ে প্রতিবাদটা করেছিলেন, সারাটা দিন এত খাটনি, দুধ, মাছ, ফল না খেলে চলে, মেয়েটাকেও মেরে ফেলবে নাকী? ব্যস, আর কিছু বলতে পারেননি শাশুড়িমা |

বাড়িতে নবনীতার জন্য একটুকরো সবুজ প্রাঙ্গন বলতে এই দেওর আর শ্বশুর মশাই, এরা অন্তত বোঝে, আর মেয়ে হয়েও ননদ, শাশুড়ি বোঝা তো দূর, পাশেও দাঁড়ায়নি কখনো |

শাশুড়ি মা খুব চেঁচামেচি শুরু করলেন নবনীতার এই দেরীতে ফেরা নিয়ে, খুব রাগ হচ্ছিল তখন নবনীতার, দেবাঞ্জনের উপর | দেবাঞ্জন নবনীতার কলিগ, আজ খুব করে ধরল, সামনে নতুন একটা খাবারের দোকান খুলেছে, সেখানে খাওয়ার জন্য আজ নাছোড় বান্দা | মুখের উপর ‘না’ বলাও যায় না, যেতেই হলো, আরও কলিগ ছিল | ব্যস, তার মধ্যে বৃষ্টি, ছাতাও নেই, সব মিলিয়ে দেরী হলো বেশ খানিকটা | মেয়েটা বোঝে একটু, ছেলের মুখও ভার, “মামমাম-এর সাথে আড়ি |”

||৪||

আবীর, মানে নবনীতার স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকেই নবনীতা, নিজের কথা, নিজের ভালোলাগা মন্দ লাগা এগুলোকে নিয়ে ভাবা ছেড়েই দিয়েছিল | সবসময় শুধু মাথায় এটাই ঘুরে চলে, অনেক বড় দায়িত্ব কান্ধে, নিজের জন্য সময় বের করবার সময় কই? আগে আবীরের ছবিটা আঁকড়ে অন্ধকার ঘরে খুব কাঁদত, এখন মনে হয় আবীর কাছেই আছে, ও কাঁদলে ও-ও কষ্ট পাবে, এই ভেবে এখন চোখ দুটো আর্দ্র হলেও নোনতা জলের ধারা চোখেই আটকাতে শিখে গেছে নবনীতা |

***************

মাঝে মাঝে বড় ক্লান্ত লাগে ওর, মনে হয় আবীরের কাঁধে মাথা রেখে একটু জিরিয়ে নি, এভাবে দৌড়তে দৌড়তে বড্ড হাঁপিয়ে যাচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি ও |

***************

ক’দিন প্রীতমটার খুব শরীর খারাপ গেল, তারপরই নবনীতা পড়ল জ্বরে, বেশ ক’দিন পর পর অফিস যেতে পারল না বেচারী | এই কটা দিন দেবাঞ্জন বরাবর সাহায্য করেছে যতটা সম্ভব | বাড়িতে তখন শাশুড়িমা ছিল না, বেড়াতে গেছিল ননদের বাড়ি, দেওরের পরীক্ষা, সব মিলিয়ে নাজেহাল অবস্থা | দেবাঞ্জন নবনীতার পাড়ার কাছেই থাকে,হাঁটা পথে মিনিট ১৫ লাগে |

***************

দেবাঞ্জনের সাথে নবনীতার বন্ধুত্বটা আজকাল বহু মানুষেরই চোখে লাগছে | অফিসে নবনীতার বান্ধবীগুলো তো প্রায়ই মজা করে বলে, দেবাঞ্জন তোর প্রেমে পড়েছে সিওর, যদি কোনোদিন প্রপোজে করে বসে, কি বলবি ভেবে রাখিস | নবনীতা শোনে, হাসে, বেশি মনে চড়তে দেয় না | কি লাভ? দেবাঞ্জনের ওর প্রতি অতিরিক্ত খেয়াল, সবসময় ওর পাশে থাকা – এসব কিছুতে ব্যাপারটা ও অনেক আগেই বুঝে গেছে, বয়েস তো হয়েছে, না বোঝার কিছু নেই | নিজের কথা ভাবাও পাপ , তাই নবনীতা এসব ভাবতে চায় না |

*************

মানুষের মনের তল পাওয়া কি এতই সোজা, নাকি মন কে জোর করে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা যায়? দেবাঞ্জন, নবনীতা আর পৃথা-প্রীতম, ওদের সকলের দায়িত্ব সমেত নবনীতা কে গ্রহণ করতে চায়, নিজ মুখেই নবনীতা কে স্পষ্ট ভাবে সবটা জানিয়েছে দেবাঞ্জন | নবনীতা অসম্ভব জিনিসটা আর মাথা চাড়া দিক চায় নি,সঙ্গে সঙ্গে না বলে দিয়েছে | কিন্তু তার পর থেকেই মনের সাথে মাথার লড়াইটা শুরু হয়েছে, সাংঘাতিক একটা অন্তর্দ্বন্দ শুরু হয়েছে ওর মনের ভিতর | দেবাঞ্জনকে নিজের অজান্তেই কখন মনের ভিতর একফালি জায়গা দিয়ে ফেলেছে ভুল করে বুঝতে পারেনি, বুঝল যখন তখন দেরী হয়ে গেছে | চোখ বুজলে আজ বিগত ছয় বছর ওর চোখের পর্দায় আবীরের মুখটাই ভেসে উঠত, কিন্তু ইদানিং সেই পর্দায় অন্য কারো ছায়া | চোখ বুজলে কিছুতেই আবীরের মুখটা ভেসে আসছে না কেন? তখনই টনক নড়ল, তবে কী?…ও তো আবীরকে মন প্রাণ দিয়ে ভালবাসত, এখনও বাসে, তাহলে এসব কী? ছি ছি , এসব হতেই পারে না, কিছুতেই নিজেকে স্থির করতে পারছিল না ও | তাই আজ বহুদিন পর জোর করেই বাপের বাড়ি গেছে নবনীতা, একা, ছেলে মেয়েকে ছাড়াই, খুব ইচ্ছে করছে মায়ের কোলে মাথা রেখে একটু শুতে, মনটা যদি একটু শান্ত হয় |

****************

আবীরের সাথে প্রায়ই কথা হয় নবনীতার, যখন কেউ থাকে না, একদম একা যখন, তখন ঠিক আসে আবীর তার নবুকে দেখতে | আজও এসেছিল, ঘুমের মাঝে, নবনীতা দেখেই বলল,”আমি জানি তুমি খুব অভিমান করে আছ, কিন্তু বিশ্বাস করো আমি ওর কথা ভাবতেই চাই না, তুমি ছাড়া আর কেউ থাকতে পারে না আমার হৃদয়ে | আমি কথা দিচ্ছি, আর এরকম হবে না, ঐ সবাই মস্করা করে এতো, আমি আর ঐ প্রসঙ্গে কোন কথা উঠতেই দেব না…|”

নবনীতাকে থামিয়ে আবীর বলল,”অভিমান তো করেইছি, তবে এই জন্য নয়, বরং তুমি কেন নিজেকে এভাবে শেষ করছ সেটা ভেবে, আমারও তো কষ্ট হয়, বোঝ না?”

নবনীতা বুঝতে না পেরে ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল,”মানে?”

আবীর বলল,”মানে আবার কী? নিজেকে নিয়ে একটু ভাব এবার, কী অবস্থা করেছ, একা বাঁচা সম্ভব? একজন কাউকে কিছু না করুক, পাশে অন্তত চাই | নিজেকে একটু ভালবাসো তাহলেই আমি শান্তি পাব, এভাবে তিলে তিলে নিজের জীবনটা নষ্ট করো না |”

…….. ধড়মড়িয়ে উঠে বসল নবনীতা, ঘুম ভেঙে গেছে, স্বপ্ন দেখছিল ওর আবীরের | আজ এসব কী বলল আবীর? উফফ, এবার পাগল হয়ে যাবে ও |

||৫||

দেবাঞ্জন আজ একবার শেষবারের মতন কথা বলতে চায়, সময় চেয়েছে একটু নবনীতার কাছে | নিজের মনের সাথে অনেক লড়াই করেও এখনও ঠিক ভুল-এর হিসাবটা মেলাতে পারছিল না নবনীতা | ক্লান্ত পথিক যদি চলার পথে একজন সঙ্গীকে চায় চলার সাথী হিসাবে, বাকি পথটা যাতে ক্লান্তভাবে নয়, একটু ভালভাবে চলা যায়, সেটা কী খুব অন্যায়? নাকী বৈধব্যের তকমা যাদের গায়ে একবার লেগে গেছে, তাদের দ্বিতীয়বার আর জীবনটা শুরু করার কোন অধিকার নেই? একটু মন খুলে হাসার, নিশ্বাস নেবার অধিকার নেই? কোনটা ঠিক কোনটা ভুল? সব যে গুলিয়ে যাচ্ছে, দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে নবনীতা ভিতর ভিতর, তবু মুখ ফুটে রা-ও কাড়েনি, কাউকে কিচ্ছুটি বলেনি |

দেবাঞ্জনের কথা, ভুবন ভোলানো হাসি, গভীর সেই দৃষ্টি এই সবকিছুতেই যেন নিজের আবীরকেই খুঁজে পায় নবনীতা | অবিকল একই রকম হাসির ভঙ্গি, কথা বলার স্টাইল, তাকানোর কায়দা, অনেক অনেকটা এক, এমনকী চুলের স্টাইলটাও | পরক্ষণেই ভাবে, দেবাঞ্জন, আবীর দু’জনকেই তো ঠকাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে নিজের সদ্য আঁকা রঙ্গিন স্বপ্নগুলো, যেগুলো দু মিনিট আগেই ওর অবুঝ মনটা আঁকতে শুরু করেছিল, রং হারিয়ে সাদা কালো | ঠোঁটের কোণে ঝিলিক মারা আলতো হাসিটা যেটা একটু আগেই ফুটব ফুটব করছিল, নিমেষে হারিয়ে যায় |

আর পারছে না ও, আর কত? কেন নিজের মনকে আর মগজকে এক জায়গায় করতে পারছে না ও, বারবার যেন আবীর কানে কানে বলে, “ভালবাসায় কোন ভুল নেই নবু, নিজেকে ভাল রাখার চয়েসটা কোন অন্যায় নয় |”, বারবার সব হিসেবে গুলিয়ে দেয় আবীর |

****************

দেবাঞ্জন এলো, নবনীতা ভাবনায় ছেদ টানে, আরও একবার নবনীতাকে হাজারো দ্বিধার মুখে ঠেলে দিয়ে চেয়ারটা টেনে ওর সামনে বসল | চোখের হাফ রিম চশমাটা খুলল দেবাঞ্জন, সুন্দর মুখটার আড়ালে একটা অত্যন্ত ক্লান্ত মানুষ লুকিয়ে আছে, সেটা চোখের দিকে ভালভাবে তাকালেই বোঝা যাচ্ছে |

“আমায় কী একবার যায় না ভরসা করা?”, দেবাঞ্জনের সোজা সাপ্টা প্রশ্নটার সাথে গলার স্বরে একটা তীব্র আকুতি লুকিয়ে ছিল, যেন শেষবারের মত একটা নৌকার অকূল পাথারে ভেসে চলে যাওয়ার আগের মুহূর্তে একটিবার কূলে ফেরার তীব্র আকাঙ্খা, “আমায় কী একটুও ভালবাসা যায় না? আমি পৃথা, প্রীতম, তোমায় সত্যি ভাল রাখতে চাই |”

নবনীতা পারছিল না নিজেকে আটকাতে আর, বারবার অন্তর্দ্বন্দ্বে পিষ্ট হচ্ছিল শুধু | আবার যেন আবীরকে অনুভব করল ও, কোথায় জানে না, হয়তো পাশেই, হয়তো দেবাঞ্জনের কথায়, যেন বলছে বারবার, “তোমার ভাল থাকায় আমার শান্তি”, চোখের আর্দ্রতা এড়িয়ে মুখটা নীচু করে নিল নবনীতা | হাতটা টেবিলে রাখা ছিল, দেবাঞ্জন নবনীতার হাতটা শক্ত করে ধরল নিজের হাতে, নবনীতাও হাতটা আঁকড়ে ধরল, ওর সত্যিই হাতটা ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না, যেন এরকমই আঁকড়ে রাখার মতো, সামলে রাখার মতো একটা হাত, ঠিক আবীরের মতো |…. দুজনের মুখেই কোনো কথা নেই, কোন শব্দের প্রয়োজনও নেই যেন, চোখের গভীরতায় যেন সবটা বুঝিয়ে দিচ্ছে |

||৬||

বাইরে কালবৈশাখীর কালো মেঘ, বিকেল পাঁচটাকে সন্ধ্যে সাতটা মনে হচ্ছে, সঙ্গে প্রবল ঝড়, আর মুষলধারে বৃষ্টি, বাড়ির জানলার বাইরের সবুজ গাছগুলো প্রকৃতির প্রবল রোষে থরথর থরথর করে কাঁপছে, বজ্রপাতের তীব্র আওয়াজ, আর আলোর ঝলকানি, এসবের মধ্যে চৌধুরী বাড়ির ড্রয়িং রুমে যেন চলছে আরও একটা কালবৈশাখী, যা আরো ভয়ঙ্কর |

***************

নবনীতার ননদ আজই ঐ কফি শপে নবনীতা আর দেবাঞ্জনকে ‘আপত্তিজনক’ অবস্থায় দেখেছে বলে একটু আগেই ‘আপত্তি’র নানা কাল্পনিক বিবরণ দিল বাড়ির সবার সামনে | নবনীতা এই কুরুচিকর কথাবার্তার মাঝে নিজের জন্য সত্যিটা বলতে চেয়েও বলতে পারছে না, রুচিতে বাঁধছে ওর | শাশুড়ির তির্যক মন্তব্য, বাঁকা ইঙ্গিত সব কিছু হাজাম করে চলেছে ও চুপচাপ, ও জানে বাবা, আর সুবীর ঠিক ওকে বুঝবে, ওর কোন ভয় নেই | কিন্তু নিজেকে আজ বড্ড, বড্ড বেশি ছোট মনে হচ্ছিল নবনীতার, মান সম্মান নেই যেখানে সেখানে কী সত্যিই বাঁচা সম্ভব?

**************

শ্বশুর মশাই, সুবীর সবাই সবটা শুনল, ছোট্ট প্রীতমকেও বাদ রাখেনি ওদের ঠাকুমা, পিসি, এসবের মধ্যে থেকে | বারবার মানা করা সত্ত্বেও ওদেরকেও এসবের মধ্যে টেনে আরও একবার নিজেদের কদর্থ রূপটা বের করে আনছিল ওরা |

সব শোনার পর বাবা বললেন, “বৌমার উপর আমার সম্পূর্ণ আস্থা আছে, আমি ওকে খুব ভাল করে জানি, কিন্তু একটা মানুষ যদি একটু ভাল ভাবে বাঁচার জন্য নিজের মতন করে কাউকে খুঁজে নেয়, তাতে খারাপটা কী? কী বয়স ওর? এতটুকু একটা মেয়ে, ওর কী হাসার অধিকার নেই? অদ্ভুত তো!”

একটু অন্তত শান্ত হলো মনটা নবনীতার, যাক, বাবা অন্তত বুঝেছে ওকে |

বুবাই বলল, “সবসময় বৌদির সাথে এরকম ব্যবহার করে ক্লান্ত হও না মা? পার কী করে? একটু শান্তিতে বাঁচতে দাও না মা মানুষটাকে | আর কোনটা ঠিক কোনটা ভুল ঠিক করবে কে, আমরা? “

কথার উপর কথা বাড়তে লাগল, কিন্তু মানুষ দুটো যে ওকে বুঝেছে এটাই শান্তির |

কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রীতম বলল, “মামমাম পচা, মামমাম বাজে “, বলেই দৌড়ে চলে গেল |

…. এটা কী হলো? সম্পূর্ণ হতবাক হয়ে দেখল নবনীতা, ঐটুকু ছোট্ট মাথায় বিষ প্রয়োগ করে ফেলল মানুষগুলো, নিজেরই সন্তান এভাবে ভুল বুঝল? এর থেকে যন্ত্রণার কী হতে পারে?

****************

পৃথা বরাবরই মাকে বুঝেছে, এখনও এই ছোট বয়সেও, মা-র কষ্ট, অসহায়তা, যন্ত্রনাগুলো উপলব্ধি করে মেয়েটা | ভাইকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেও কোন লাভ হয়নি, পারেনি পৃথা প্রীতমের মাথা থেকে বিষটা বের করতে |

||৭||

(কিছু বছর পর)

নবনীতার সাথে প্রীতমের দূরত্ব সেদিনই শুরু হয়েছিল, ছোট্ট ছেলেটাকে বারবার কাছে ডেকেও মাঝের তৈরি হওয়া অদৃশ্য দেওয়াল ভাঙতে পারেনি ওরা কেউ | পৃথা সবদিন মা-র পাশে থাকলেও আরেকটা পাশ পূরণ করতে পারেনি, প্রীতম তার মাকে ভুল বুঝেই গেছে | মা ছেলের সম্পর্কের সমীকরণটা আমূল বদলে গেছিল |

****************

সন্তানের সাথে দূরত্ব তৈরি করে নিজের সুখের ঘর গোছাতে পারেনি নবনীতা, আরও একবার গুঁড়িয়ে গেছিল ভিতর ভিতর | না বলতে বাধ্য হয়েছিল দেবাঞ্জনকে, খুন হয়েছিল আরও একটা নিষ্পাপ ভালবাসা সমাজের চোখ রাঙানির ভয়ে, কাছের মানুষগুলোর অবহেলায় | দেবাঞ্জনও অন্তহীন অপেক্ষায় স্বেচ্ছায় সামিল হয়েছিল, কোনদিন কোন অভিযোগ করেনি, শুধু দেবাঞ্জনের চোখ দুটোর দিকে তাকালে নিজের আর্দ্র চোখ দুটোকে লোক চক্ষুর থেকে বাঁচাতে তৎপর হয়ে যেত নবনীতা |

****************

(পনের বছর পর)

ছুটে চলেছে ট্রেন | গয়ায় যাচ্ছে ইঞ্জিনিয়ার প্রীতম চৌধুরী, মা-এর পিন্ড দান করতে | ফাঁকা বাড়িতে একা থাকত মা, সেরিব্রাল হয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই মনে হয় সব শেষ হয়ে গেছিল |

চলন্ত ট্রেনের হাওয়ায় বারবার অতীতের পাতাগুলো ভেসে আসছিল, কিন্ত বারবার চোখটা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে বড্ড, মাকে চিনতে বড্ড দেরি করে ফেলল প্রীতম | যে যতই নীতি বাক্য শোনাক, সারাজীবন কারো পক্ষে একা বাঁচা সম্ভব নয় | একাকিত্ব জীবনকে নরক বানিয়ে তোলে, হাঁটার জন্য, বাঁচার জন্য, একজন সাথীর খুব প্রয়োজন, এই চরম সত্যটা অনস্বীকার্য, এটা বুঝতে প্রীতম অনেকটা দেরী করে ফেলেছে | কাকা বিয়ের পর চাকরি নিয়ে বাইরে, দিদি বিয়ের পর বাইরে, ও কর্মসূত্রে বাইরে, খাঁ খাঁ বাড়িতে মা একা, যদি মা-র পাশে আজ কেউ থাকত, যদি আজ একা না থাকত, যদি সময় থাকতে থাকতে মা-র উপর অযথা মানসিক চাপ দেওয়াটা বন্ধ করত প্রীতম, দূরত্বটা যদি শেষ করত, হয়তো মাকে আরও একটু পেত, আরও বেশিক্ষন হয়ত মা-র কোলের পরম শান্তির ঘুমটা উপভোগ করতে পারত,”সরি মা, তোমায় কোনদিন বুঝিনি, বুঝলে আজ হয়ত তুমি আমার পাশেই থাকতে, এত দূরে যেতে না, হারিয়ে ফেলতাম না তোমায় |”

অশ্রু ধারা তখন বাঁধ ভেঙেছে সদ্য মা হারানো এক হতভাগ্য ছেলের দু’চোখে |

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

মুক্তি

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেল, আকাশ তখন থেকে ঠায় বসেই রয়েছে ঘাটে। এখন বাঁধানো ঘাট থেকে করিডোর হয়ে বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরে পুজো দেওয়া অনেকটা সহজ

Read More »

বন্ধু হবি চল

বাক্সপেটরা নিয়ে স্টেশনেই বসে ছিল নয়না, বৃষ্টি পড়েই চলেছে, মুষলধারায়। বাবা বলল আরেকটু অপেক্ষা করতে, এত বৃষ্টিতে তো ছাতাও হার মানবে, আর বেরিয়ে রাস্তাও অজানা

Read More »

টিফিনবাক্স

প্রতিবারের মতন এই বছর ও সমস্ত সরঞ্জাম গুছিয়ে বেরোনোর জন্য ব্যস্ত অমিত, অন্তত সন্ধ্যার মধ্যে বেরোতে না পারলে খুব মুশকিল। পুজোর দিকটা কতদূর কি হলো

Read More »

ক্লিক

।।১।। -“মালিনী, কালকের মিটিংটা কখন ফিক্স করেছ? -“ম্যাম, সকাল ১১টা।” -“ওকে, কনফার্মেশন পেয়ে গেছ?” -“ইয়েস ম্যাম।” -“ওকে গুড। আর।।। এক মিনিট।।।” টেবিল থেকে ফোনটা তুলে

Read More »

শিক্ষা

।।১।। দাপুটে, বদরাগী, মেজাজি এই সব কটা বিশেষণই বেশ ভালো যায় মিসেস বোসের সাথে। রেণুকা বোস আর অমরনাথ বোস সানফ্লাওয়ার এপার্টমেন্টে ১২০০ স্কোয়ারফিটের ফ্ল্যাট 2c

Read More »

বিদায়

।। ১।। রীতিমত জোর করেই নন্দিনীকে পাহাড়ে নিয়ে এলো সঙ্গীতারা। আসার ইচ্ছে তো ছিল না ওর একদমই, শরীর সাথ দিলেও মনটা কোনোভাবেই সাথ দিচ্ছে না।

Read More »

Share with