ধূসর (অন্তিম পর্ব)

-“কীরে, খাবারটা এখনো খাসনি? কখন রেখে গেলাম,” বলতে বলতেই ঘরে ঢুকলেন বেলাদেবী।

সাগ্নিক নিজের ঘরেই আছে আজ সারাদিন, ছুটি নিয়েছে আজ। জানলাটা দিয়ে খেলার মাঠটার দিকেই চেয়ে রয়েছে অন্যমনস্কভাবে। জানলার কাছেই ওর স্টাডি টেবিলটা, ওখানেই বসে রয়েছে সেই সকাল থেকেই।

বেলাদেবী বুঝলেন কিছু একটা ভীষণভাবে ভাবাচ্ছে সাগ্নিককে। মা তো, এটুকু তো বুঝবেনই, তাই বেশী ভূমিকা না করে সরাসরিই বললেন, “কী ভাবছিস? এই অবস্থায় দেবাংশী একা…তাই তো?”

সাগ্নিক এখনো বুঝে উঠতে পারল না মা সবকিছু এরকম বুঝে যায় কী করে, মার চোখের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সাগ্নিক।

-“মা দেবাংশী এখন কোন জগতে আছে, নিজেও জানে না, তার ওপর মেয়েটার সব দায়িত্ব। ও নিজেই এখন এই অবস্থায়… একা কী করে কী করবে বলোতো?”

-“কিন্তু বাবু ও তো এত্তগুলো বছর ও একাই ছিল। তুই বা অয়ন কেউই তো গিয়ে ওর সব কাজ করে দিয়ে আসিসনি, তাহলে আজ।”

-“মা, তখনকার পরিস্থিতি আর এখনকার সম্পূর্ণ আলাদা, তখন ওর মা বাবা ছিল ওর পাশে, বছর খানেক তারা নেই মাত্র। আর এখন ওর মনের যা অবস্থা, অয়ন চলে যাওয়ার পর, ও নিজেকে আদৌ সামলাবে কী করে? কাঁড়ি কাঁড়ি ঘুমের ওষুধ খাচ্ছে, কারওর কথা তো শুনছে না, বলছে, ‘ঘুম হচ্ছে না।’ এভাবে ওকে একা রাখা কী ঠিক?”

কিছুক্ষণের মৌনতার পর বেলাদেবী বললেন, “তাহলে কী চাস বল তুই। কী করবি?”

-“ওকে এবাড়িতে আবার ফিরিয়ে আনবো।।।”

-“আর তোর মনে হয় ও রাজী হবে? এতদিন পর? যখন আসল সময় তখন কী।।।”

-“রাজী না হলে আমি ওবাড়ি গিয়ে থাকবো, তারপর ঠিক রাজী করব। আমি তো জানি অয়ন ওর জন্য কতটা। অয়ন আর নেই, দেবাংশী কী করে… না, না, এখনই চিন্তায় আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।”

-“ও তো তোকে ছেড়েও এত বছর কষ্টেই ছিল।”

-“মা, মা, তুমি প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো, তখন তো আমার বয়সটাও কম ছিল, আমি পারিনি সব শোনার পর মানতে, তার মানে এটা নয় যে আমি ওর জন্য ভাবিনি। ভেবেছি বলেই ওর ওপর সব ডিসিশন ছেড়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম হয়তো আমার থেকে সেপারেট হয়েই ও ভাল থাকবে অয়নের সাথে। ওকে আটকাতে চাইনি, কিন্তু আজ যখন অয়নই নেই।।।”

-“সেদিন তুই অয়ন এর অফিসে কেন গিয়েছিলি বাবু?”

-“মানে?”

-“দেবাংশী অয়নের এই ঘটনাটার কারণ খুঁজছে, আর তাই হয়তো পল্লবকে সেদিন ডেকে পাঠিয়েছিল। সেদিন কে কে অয়নের সাথে দেখা করেছিল সেটা জানতে, রেজিস্টারের কপিতে তোর নামটাও তো ছিল, আর সেটা ও…”

-“মা, প্লিজ, এবার তোমার আকাশ কুসুম চিন্তাটা একটু থামাও, আমি ওই রাস্তায় গেছিলাম। ভাবলাম দেখা করে নেমন্তন্নটা করেই যাই, আমার জন্মদিনের পার্টি, দ্যাটস ইট, নাথিং এলস। এই ঘটনাটার সাথে তার কী সম্পর্ক? আশ্চর্য তো?”

বলেই মা-র দিকে তাকাল সাগ্নিক।

-“আর অয়নের বাড়ির কেউ নেইও, যে কেস ফাইল বা ইনভেস্টিগেশন শুরু করাবে, এক দেবাংশীই যা।”

এটুকু বলেই চুপ করলেন, আর কিছু বললেন না বেলাদেবী। ওনার মৌনতাই যেন বুঝিয়ে দিল অনেক কিছু।

-“খেয়ে নিস, গরম করে দিচ্ছি।”

খাবারের থালাটা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।

হ্যাঁ, এটা সত্যি, দেবাংশী যখন নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত, শেষ হয়ে যাচ্ছিল একটু একটু করে, সাগ্নিকের কাছে সাহায্য চেয়েছিল, তখন তো সত্যিই হাতটা বাড়ায়নি সাগ্নিক। মানতে পারেনি কিছুতেই, দেবাংশী ওর সাথে সাথে অয়নকেও।

হ্যাঁ, পারেনি মানতে। একমুহূর্তের জন্য ওদের সন্তান শিবাঙ্গীর উপরও কী ও করেনি সন্দেহ? ওর মনে হয়েছিল, দেবাংশীর কথামতো যদিও জোর করে অয়নকে ওর জীবন থেকে সরিয়ে দিত, তাহলে হিতে বিপরীত হতে পারে। এভাবে দেবাংশী আদৌ ভাল থাকত না, ওরা কেউই সুখী হতো না। আর যেখানেই জোর খাটানো থাকে, ভালবাসা থাকে না। আর দেবাংশীই চেয়েছিল সাগ্নিক যেন জোর খাটায়, ও নিজে বেরিয়ে আসতে পারছে না, সাগ্নিকই যেন জোর করে বের করে আনে। তা সেই জোরটা যদি এখনই করে সাগ্নিক, ক্ষতি কী?

কারো মৃত্যু কখনই কাম্য নয়। কিন্তু এটা তো সত্যি, সম্পর্কের প্রথম থেকেই ওদের মধ্যে সবদিন অয়ন ছিল, আর আজ।।। এটলিস্ট ওদের মধ্যে আর কোন বাধা নেই, অয়ন আর নেই।

একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সাগ্নিক, সবার চোখের আড়ালে।

।।২।।

-“আই অ্যাম এবসোলিউটলি ফাইন সাগ্নিক, আমার কোন ডাক্তারের সত্যি প্রয়োজন নেই।”

-“প্রয়োজন নেই যখন তখন এই ঘুমের ওষুধগুলো নিজের ইচ্ছে মতো আর খাবে না তুমি।” বলেই একলহমায় টেবিল থেকে ওষুধগুলো নিয়ে বারান্দা থেকে রাস্তায় ফেলে দিল সাগ্নিক।

-“হোয়াটস রঙ উইথ ইউ সাগ্নিক? তোমার প্রব্লেমটা কী বলতো?”

-“আমার? আমার তো কোন প্রব্লেম থাকতেই পারে না, আর তোমায় এত মাথা ঘামাতে হবে না, বুঝতেও হবে না।”

-“তুমি ওষুধগুলো ফেললে কেন?”

-“বেশ করেছি ফেলেছি। এগুলো তোমার জন্য…”

-“আমার এগুলো দরকার, কেন তুমি সব ব্যাপারে নাক গলাচ্ছ?”

খানিক্ষণ চুপ থেকে আবার বলল সাগ্নিক, “হ্যাঁ, গলাচ্ছি, আমার অধিকার আছে তাই গলাচ্ছি।”

সাগ্নিকের চোখে চোখ রাখল দেবাংশী, চোখ থেকে যেন আগুন ঝরছে, চোখ মুখ লাল, এলোচুল, অবিন্যস্ত পোশাক আশাক। সাগ্নিকের চোখে চোখ রেখে বলল, “সমস্ত ব্যাপারে ঢুকো না সাগ্নিক, আমায় আমার মত ছেড়ে দাও। যখন আমার সাহায্যের দরকার ছিল, তখন কোথায় ছিলে তুমি? তখন যখন ছিলে না, এখন তাহলে কেন অধিকার ফলাচ্ছ?”

খানিক চুপ থেকে চোখটা মুছে আবার বলল দেবাংশী, “তখন তো বলেছিলাম বারবার, আমায় এখান থেকে বেরতে একটু সাহায্য করো। করোনি, উল্টে নিজে সরে গেছলে, তখন কোথায় ছিল তোমার আমার জন্য চিন্তা?”

-“তোমার জন্য আমার চিন্তা না থাকলে, তুমি ও বাড়ি ছেড়ে এই বাড়ি ঐ অবস্থায় চলে আসবার পর রোজ একটিবার দেখার জন্য সব জেনে বুঝেও এখানে আসতাম না। তোমার জীবনের প্রতিটি ডিসিশনে, প্রতিটি ধাপে আমি তোমার পাশেই ছিলাম, তুমি দেখতে পাওনি, সেটা তোমার প্রব্লেম। তুমি অয়নদাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলে আমায় আর কীভাবে…”

-“প্লিজ, এনাফ ইজ এনাফ, বিদেশ থেকে ঐ অবস্থায় ফিরে আসার পর আমি অয়নের সাথে থাকার ডিসিশন নিইনি, সেটা তুমিও জানো।”

-“হ্যাঁ, জানি, কিন্তু কেন? সেটাই তো বুঝি না। আমি তো আসিনি তোমাদের মধ্যে।”

-“কারণ আমি পাগল। শান্তি? আমি তোমায় ছাড়া আর কাউকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে পারিনি। কিন্তু আমি অয়নকেও… আমি অয়নকেও একইরকম ভালবাসি।

না আমি তোমার কাছে ভাল থাকতাম না আমি ওর কাছে, যার সাথেই থাকি এটাই মনে হতো, আরেকজন কষ্ট পাচ্ছে, আরেকজনকে ঠকাচ্ছি, নিজেকে কী উত্তর দেব? সমাজ তো নষ্টা, কুলটা ছাড়া কিছু বলবে না। এটা তো সমাজের চোখে স্বাভাবিক নয়। একসঙ্গে দুজনকে ভালবাসার অধিকার তো এ’ সমাজ আমাদের দেয় না। আর যখন কেউ এই সমাজের নিয়ম বহির্ভুত কিছু করে, সেটাকেই সমাজ ঘৃণ্য অপরাধের চোখে দেখে, আর এই কারণেই আমি তোমাদের দুজনের থেকেই নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেছি এত বছর ধরে।

আমি তোমায় মিস করতাম, আজও করি। আমি তোমায় আজও ততটাই ভালবাসি যতটা কলেজের দিনগুলোয় বাসতাম, বরং আরও বেশী, কিন্তু আমি অয়নকেও মিস করি। আমি দূরত্বে থেকে নিজেকে একটু ভাল রাখার চেষ্টা করেছি মাত্র, কখনো শান্তি পাইনি, তাই নিজের মতো করে শান্তি খুঁজে নিয়েছি। এভাবে তো দুই নৌকায় পা দিয়ে আমরা কেউই শান্তি পাব না।”

কিছু বলার ছিল না আর সাগ্নিকের, বলার মতো খুঁজেই পাচ্ছে না যে আর কিছু। সব শব্দ শেষ, এবার শুধু বোঝার পালা, ওর একান্ত আপন মানুষটার মনের এত জটিল স্তরে তো ও কখনো পৌঁছতেই পারেনি। ও নিজে যেটা ভেবেছে সেটাই বিশ্বাস করেছে; সম্পর্ক, প্রেম, আমাদের জানার বাইরেও যে জটিল হতে পারে, সমাজের নিয়মের বাইরেও যে সে এইভাবে নিজের অস্তিত্ব জানান দেবে, ভাবতেই পারেনি সাগ্নিক।

খানিক্ষণ সব চুপচাপ, বর্ষায় গাঢ় সবুজ চারদিকের প্রকৃতি, মাটির সোঁদা গন্ধ আর বৃষ্টির শব্দ চারপাশে ।

দেবাংশী ঠিক কী কী সহ্য করেছে, মনের কোন অতল গহ্বর দিয়ে ওকে পেরোতে হয়েছে তার কোন আন্দাজও সাগ্নিকের নেই। তাই আজ কিছু বলা মানায় না ওর, কিছু পর শুধু বলল, “আমার একটা কথা রাখবে প্লিজ দেবু? আমি পারছি না এত জটিলতা নিতে, আমি সবকিছুর পর শুধু একটা কথাই জানি, আর একটা কথাই মানি, আমি তোমায় ভালবাসি। সেই কলেজের ছিপছিপে মেয়েটা থেকে আমার অর্ধাঙ্গিনী, আমার সন্তানের মা, জীবনের প্রত্যেকটা স্তরে যদি কায় মন বাক্যে, নিবেদিতভাবে কাউকে চেয়ে থাকি, ভালবেসে থাকি, সেটা তুমি। প্লিজ ফিরে চলো দেবু।”

সাগ্নিকের দিকে তাকাল দেবাংশী, ওর ভিতরের ভাঙ্গন ওর মুখে স্পষ্ট, অবনত দৃষ্টি, কোন শব্দ বিনিময় নেই।

সাগ্নিকই দেবাংশীর হাত দুটো শক্ত করে ধরে বলল, “আমার কোন যায় আসে না, তুমি কাকে ভালবাসো। আমি তোমায় ভালবাসি, আমাদের মেয়ে, সব তো একদম পারফেক্ট। আর পাঁচটা স্বপ্নের পরিবারের মতো ওবাড়িতে তোমার ঘর, খাট, আলমারি সব,সব একইরকমভাবে অপেক্ষায় আছে, যা তুমি পিছনে ফেলে বেরিয়ে এসেছিলে।

আর… আর তো এখন কোন দোটানা, কোন দ্বন্দ নেই। প্লিজ, ফিরে চলো, অয়নের মৃত্যু নিয়ে যা ইনভেস্টিগেশন, যা করার তুমি করো, ঐ বাড়িতে থেকেই করো, কিন্তু আর না, আমার সাথে ফিরে চলো।” এটুকু বলে থামল সাগ্নিক।

দেবাংশী সাগ্নিকের দিকে চেয়ে বলল, “অয়নের মৃত্যু হয়েছে সিভিয়ার এলার্জি-এর জন্য, শ্বাসকষ্টে। ও কী জানতো না ওর কীসে এলার্জি? তাহলে ও কেন…আচ্ছা সাগ্নিক। তুমি লাস্টদিন অয়নের সাথে কেন দেখা করতে গেছিলে?”

দেবাংশী সাগ্নিকের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করল, “তোমার সাথে তো অয়নের… কোনদিনই তেমন… তাহলে?”

-“আমি জানি না, এই সাধারণ একটা বিষয় নিয়ে এত প্রশ্ন কেন উঠছে। আমিই যদি কালপ্রিট হতাম, তাহলে কী শখ করে নিজের নামটা লিখতাম রেজিস্টারে? আমি কী পাগল? আশ্চর্য।”

বলেই দেবাংশীর হাতটা ছেড়ে জানলার দিকে মুখ করে দাঁড়াল ও।

-“আমি এসব কিছুই বলিনি সাগ্নিক। আমি এত বছরে কখনো যা দেখিনি, তাই জন্য সেই নিয়ে প্রশ্নটা করলাম, দ্যাটস ইট। তুমি যেতেই পারো, সেটা বড় কথা না।”

-“তোমায় তো জন্মদিনের দিনই বললাম, অয়নদাকে ইনভাইট করেছি, এলো না? তখন কীভাবে বুঝব অয়নদা সেদিনই… যাই হোক।”

আর কিছু বলল না সাগ্নিক, দেবাংশীও চুপ। সাগ্নিক ঘর থেকে বেরিয়ে নীচে চলে গেল। বাইরে তখন আবার ঘনিয়ে আসছে মেঘ।

।।২।।

(বেশ কিছুদিন পর)

আবার ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে দেবাংশী, একটু নিশ্চিন্ত সাগ্নিকও। এই কটাদিন যা দুশ্চিন্তায় গেছে। অনেকবার সাইকিয়াট্রিস্ট-এর কাছে যাওয়ার কথা বলেছে, দেবাংশীই রাজী হয়নি। সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাওয়া মানেই যে মানসিক রোগগ্রস্ত এটা পুরোপুরি ভুল ধারণা। দেবাংশী যে নিজেই এই ট্রমা থেকে নিজেকে টেনে বের করতে পেরেছে এটাই বড় ব্যাপার। এবারে আর ওকে একা ছাড়েনি সাগ্নিক, সবসময়, প্রতিটা মুহূর্তে দেবাংশীর পাশে থেকেছে, দেবাংশী কিছু করে বসলে ও কী করে…

***************

আজ শিবাঙ্গী খুব খুশী, আজ এতদিন পর অবশেষে ওর চাওয়া পূরণ হতে চলেছে। আজ বহুদিন পর ও ওর বাবাকে এত খুশী দেখছে, তাই ও নিজেও খুব খুশী। ও তো বাবাকে বলেও রেখেছে, দোতলার বড় ঘরটাই ওর চাই, ঐ ঘরটা ওর ভীষণ প্রিয়। আর ঠাম্মার হাতের রান্না এবার ও রোজই খেতে পাবে, এটার থেকে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে। তবে দুঃখ একটাই ওর জ্যেঠু, জ্যেঠী, দুই দিদি সব বাইরে চলে যাচ্ছে। জ্যেঠু ভাল অফার পেয়েছে। ঠাম্মা, দাদু একদম একা হয়ে যেত, ঐ জন্যই মা আরও রাজী হলো…আচ্ছা মা কোথায় গেল।

****************

সচরাচর মাছ মাংস-এর বাজারের চৌহদ্দি মাড়ায় না যে, সেই সাগ্নিকই আজ বাজার করেছে পাঁঠার মাংস, কাতলা মাছ, মা-এর কথা মতো।

নাতনীর প্রিয় কাতলা মাছ আর দেবুর পছন্দ পাঁঠার মাংস। সাগ্নিকেরও আজ যেন কোন অসুবিধাই হয়নি। আজ এতদিন পর ওর দেবু ঘরে ফিরছে যে, এই এবার আনতে যাবে একটু পর।

***************

গোছগাছ সব শেষ প্রায়। নিজের ঘরে ঢুকে দরজাটা লাগাল এবার জানালাটার কাছে একটু বসলো দেবাংশী, একান্তে। আজই ফিরে যাচ্ছে ও সাগ্নিকের কাছে, ওর স্বামী, প্রথম প্রেম। যে এতদিন ধরে ওরই অপেক্ষায়। আর একদিকে অয়ন… পাশের বুক শেল্ফটা থেকে বইটা বের করল ও, পাতাটা উল্টাতেই বেরিয়ে পড়ল শুকনো গোলাপটা, অয়নের দেওয়া সেই গোলাপ, প্রথম এবং শেষ উপহার। তারপর থেকে আর কোনদিন কোন কিছু অয়নের থেকে দেবাংশী নেয়ওনি, ওকে দেয়ওনি।

কালচে রঙের শুকনো পাপড়িতে হাত বোলাল একবার দেবাংশী, “তুমি এসে এভাবে আমার জীবনটা আমূল বদলে দেবে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি অয়ন। ঐ রাস্তায় আমাদের প্রথম দেখা, প্রথম থেকেই আমার মনের সবটা জুড়ে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছিলে তুমি। তুমি তো জানতে আমি সাগ্নিক একে অপরকে কতটা ভালবাসি, তাও কেন এসেছিলে ঝড়ের মতো এলোমেলো করে দিতে আমার সবটা? আমিও তো পারলাম না নিজেকে ধরে রাখতে। তোমার পাগলামোর সাথে সাথে তোমার ঐ বিধ্বংসী প্রেমের আগুনে তো সেই আমি ও পুড়ে মরলাম, বারবার। প্রতিবার দূরে সরতে চেয়েছি যত, আঁকড়ে জড়িয়ে গেছ তত আমার জীবনের সাথে, মিশে গেছো সবকিছুতে। কী করে বাঁচব আমি একবারও ভাবলে না তো। না আমি তোমায় ছাড়া ভাল থেকেছি, না আমি তোমার সঙ্গে ভাল থাকতে পেরেছি।

আমার স্বামী, সংসার, সিঁথির সিঁদুর, সব তো গেছে তোমায় ভালবেসে। না তোমায় ভুললাম না সাগ্নিককে, উল্টে পুড়লাম নিজে। আর কত? ঘরের কুলটা হয়ে ঘর ছাড়লাম, সমাজ নষ্টা বলল, তাও তো তোমায় সরাতে পারলাম না জীবন থেকে। এভাবে দুজনকে ভালবেসে দুজনের থেকেই, সংসার থেকে দূরে থেকেছি, কী করতাম আর? নিজেকে শেষ করার চিন্তাও এসছে মাথায় বহুবার, এই দহন থেকে নিষ্কৃতি চাই যে, পারিনি, মেয়েটার কথা ভেবে, পারিনি।

আমি না চাইতেও বারবার তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে তোমার উপস্থিতি, আর তোমায় ভালবেসে একটু একটু করে পুড়ে মরেছি আমি, আর…আর একজনও মরেছে, সাগ্নিক। আমরা তো কেউ সুখী হলাম না, বল অয়ন। এবার অন্তত সিঁদুরটুকু পড়তে দাও, এবার অন্তত সাগ্নিকের সাথে একটু সুখী হতে দাও আমায়, আমার ভেঙে যাওয়া সংসারটাকে একটু না হয় গোছাতে দাও, আর এসো না প্লিজ।”

বহুদিন পর কপালে সিঁদুরের টিপ, সিঁথিতে সিঁদুর ছোঁয়াল দেবাংশী, আবার।

-“কত ভালবাসতে পারে কেউ কাউকে… কত? আমি তোমার রক্তে মিশে গেছি, আর ছাড়তে পারবে না, তুমিই তো বলতে। আর তুমি আমার সর্বস্ব জুড়ে, দমবন্ধ লাগছিল যে, কী করতাম বলো? ঐ জন্য এবার তোমায় ছুটি দিলাম অয়ন। ঠিক কতটা ভালবাসলে কেউ কাউকে শেষ করে দিতে পারে? আমিই তো জানতাম তোমার সামান্য কাজু বাদামে কী মারাত্মক এলার্জি, এর থেকে ভালো তো কোন উপায় ছিল না আমার হাতে। তোমার জন্য বানানো রান্নায় সযত্নে মিশিয়ে দিয়েছিলাম বিষ সমান ঐ উপাদান, কাজু বাটা। কেউ সন্দেহ করেনি বিশ্বাস করো, তুমি তো রোজকার মতন বাইরেই খেতে বেরিয়েছিল, ঠিক দুপুর ১টার পরে তাই ফোনটা করেছিলাম, বাইরে খেও না, খাবার দিয়ে দিয়েছি ব্যাগে। তুমি তো জানতেও না তোমার ব্যাগে কখন খাবার গুছিয়ে দিয়েছি এসেছি, কখনোই তো হয়নি এমনটা, তাই প্রশ্ন আসার আগেই অনেকটা আনন্দ হয়েছিল তোমার, তাই না? সবাই তো জানল তুমি রোজকার মত বাইরেই গিয়েছিলে, ফিরে এসে যখন নিজের কেবিনে টিফিন করলে, তখন তো বাকী ডেস্ক ফাঁকা। আর কোন প্রমাণ না রাখার জন্যই ফয়েলে খাবার প্যাক করে দিলাম, জানতাম রোজ রিফিনের পর তোমার ঘর পরিষ্কার করতে আসে। ব্যস, আর কোন প্রমাণই রইল না, কেউ জানলোই না তুমি ঐদিন দোকানের না আসলে আমার দেওয়া টিফিনই করেছিলে। সেইদিনই পল্লবের তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, তুমিই বলেছিলে কথায় কথায়, বোনের বিয়ে, অনেক ভেবেই তাই ঐ সময়টাই বাছলাম, আর তোমার তো আর কেউ…উফফ…

অনেক খবর নিয়েই ঐ দিনটা সিলেক্ট করেছিলাম,খালি ভাবতে পারিনি সাগ্নিক পৌঁছবে হঠাৎ। ওটা আমার ক্যালকুলেশনের মধ্যেই ছিল না যে। যদিও তাতে তেমন কিছু প্রব্লেম হয়নি। তারপর, আর কী…

রক্ত লাল চোখের জল নিজে হাতে মুছে নিল দেবাংশী। যন্ত্রণার ছাপ পেরিয়ে ঠোঁটের কোণে যেন বাঁকা হাসির রেখা উঁকি দিচ্ছে।

গোলাপ সমেত বইটা বন্ধ করে বুক শেলফে তুলে রাখল দেবাংশী – ভাল থেকো অয়ন, আর ভাল থাকতে দিও এবার,আর কোনো উপায় ছিল না এর থেকে মুক্তির| ঘরের দরজা খুলে রেডি হয়ে বেরলো দেবাংশী, আর কিছুক্ষণ পরই গাড়ি রওনা দিল ‘বসু পরিবার’-এর উদ্দেশ্যে, সঙ্গে, মেয়ে, স্বামী। একটা শান্তির নীড়ের স্বপ্ন নিয়ে দেবাংশী বাইরের জগতের কাছে সাদা, ঘরের কোণে আয়নার সামনে কালো অবয়ব, আসলে সবে মিলেমিশে বড়ই ধূসর এ চরিত্র। সিঁথিতে তখন জ্বলজ্বল করছে সিঁদুর, অবশেষে।

।।সমাপ্ত।।

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

সাঁঝের শিশির (অন্তিম পর্ব)

।। ১।।   ( বেশ কিছুদিন পর ) সারা বাড়িতে এই লাগোয়া বারান্দাটাই টিকলির সবথেকে প্রিয়। সামনে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে বাগান মতো, তারপর রাস্তা। আগে

Read More »

সাঁঝের শিশির (ষষ্ঠ পর্ব)

।।১।। (কিছুদিন পর) “আরে আমি নিজেই ফিরে যাব, রতনদা তো আছেই, আবার তুই আসবি কেন?” “তুই তো আচ্ছা হাঁদা, বলছি রতনদাকে ফেরত পাঠাতে, আর এবার

Read More »

সাঁঝের শিশির (পঞ্চম পর্ব)

।।১।। “এবার বিশ্বাস হল তো, মেয়েটা খামোখা কেন মিথ্যে বলবে বলো তো? আর আমি তো প্রথমেই দেখেছিলাম, তোমায় বলেওছিলাম, তুমিই আমার কথা বিশ্বাস করোনি, এখন

Read More »

সাঁঝের শিশির (তৃতীয় পর্ব)

“তুমি একবার আমার কথাটা শোনো, আচ্ছা আমার মিথ্যে বলে কি লাভ বলতো? আর তোমার মনে হয় আমি এই অবস্থাতেও মিথ্যে কথা বলব এখনও?” “সত্যি মিথ্যের

Read More »

সাঁঝের শিশির (দ্বিতীয় পর্ব)

।।১।। “কি গো টিকলিরাণী, খাও। কখন থেকে খাবারের থালা নিয়ে বসে আছ? তোমার প্রিয় পাস্তা করে দিলুম যে, ভাল হয়নি?” অন্যমনস্ক টিকলি সামনের বাগানটার দিকে

Read More »

Share with