“আজ অবধি মুখের উপর কেউ কথা বলতে পারেনি, তোমার সাহস দেখে তো আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি, তুমি নিজের ছেলেকে নিয়ে ‘আমন্ত্রণ’-এই থাকবে, ব্যস। আমি আর কোন কথা শুনতে চাই না।” বলে চলে গেলেন নীলিমাদেবী।
রুহি বলে মেয়েটার, ওর ছেলেটাকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত ঠাঁই নীলিমাদেবীর বাড়িতেই। সবাই বলছে, ওরে তোর ভাগ্য খুব ভাল রে। এরকম একটা মানুষের হাত তোর মাথার উপর, তোর ছেলের মাথার উপর পড়ল, এবার আবার সব কিছু নতুন করে শুরু কর। কিন্তু রুহিই বুঝতে পারছে না, হঠাৎ রুহিই কেন? এতো ভাল মানুষ, এভাবে নিজে থেকে সাহায্যের হাত এগিয়ে দেওয়া, ক’জন করে? ও তো এই কটা মাস ধূসর পৃথিবীটাকে দেখেছে, সেখানেই এরকম একজন ব্যক্তিত্বের মানুষ।।। কী করে হতে পারে?
বোঝা না বোঝার মাঝে দাঁড়িয়ে আর বেশী কিছু ভাবার সুযোগ পেল না রুহি। ‘আমন্ত্রণ’-এ যখন ওই মানুষটার হাত ধরে ও আর ওর নবজাতক পা রাখল তখন বিকেল ঢলে সন্ধ্যে নামতে শুরু করেছে।
****************
(কয়েকদিন পর)
আজ ক’দিন ধরে খালি বাড়িটার ইঁট, কাঠ, পাথরগুলো বড় খুশী। আজ বহুদিন পর অনেক মানুষজনের গলার স্বর শুনতে পেয়েছে যে। দিনভর হইহই, হুড়োহুড়ি, বাচ্চা, বাচ্চার মা, বাচ্চার আয়া, মালতী, নীলিমাদেবী সব মিলিয়ে বড় জমজমাট বাড়ি। আর এই ক’দিন যাবদ খালি বাড়িটা, একাকীত্ব গ্রাস করেনি নীলিমাদেবীকে। বাইরে সবাই যা বলুক, নীলিমাদেবী নিজে তো জানেন, উনি কেন নিয়ে এলেন মা ছেলেকে।
***************
-“আরে, আরে, আরে তুই আবার রান্নাঘরে এলি কেন? তোকে আমি রেস্ট নিতে বলছি, বাচ্চার কাছে থাকতে বলছি যত, তত তুই এদিক ওদিক করে বেড়াচ্ছিস?”
এই কয়েকদিন এই মানুষটার মাঝের তুমি-আপনিটা তুই-তুমিতে পরিণত হয়েছে। ‘আমন্ত্রণ’ এখন রুহির সৌজন্যে একাকীত্ব কী তা ভুলতে বসেছে। কথাটুকু বলেই কড়াই-এর দিকে চোখ গেল নীলিমাদেবীর, “একী তুই পোস্ত রাঁধতেও জানিস?”
-“হ্যাঁ, হিন্দুঘরে বিয়ে হওয়ার দরুণ শিখেছিলাম অনেক কিছুই, পোস্তটা রাহুলেরও খুব প্রিয়, আর তোমারও তো খুব পছন্দের।”
-“বটে, কে বলল শুনি?”
-“কেন, কালই তো মালতীকে বলছিলে, তখনই শুনলাম তো।”
-“হ্যাঁ, ঠিকই। কিন্তু পোস্তটা পিউ খুব ভাল করত, ওরকমটা কেউ আর পারে না, মালতীও চেষ্টা করে, পারে না, আমিও পারি না, দেখি আজ তুই।।।”
কী বলে ফেলেছেন কয়েক মুহূর্ত পর খেয়াল করলেন নীলিমাদেবী।।।
রুহি নীলিমাদেবীর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে, আর কথা না বাড়িয়ে নীলিমাদেবী চলে গেলেন বাইরে।
*****************
রুহি এই নিয়ে দু’বার খেয়াল করল এই ঘটনাটা। মানুষটা যার কথা বারবার বলেন তাকে আজ অবধি দেখতে পেল না কেন ও? অনেক দূরে থাকে কী? আর তার কথা বলেই এরকম ব্যবহারই বা করে কেন মানুষটা? তবে মানুষটাকে যে মিস করে তা এই ক’দিনে বুঝে গেছে রুহি।
****************
(কয়েক মাস পর)
রুহি আবার নতুন করে লেখাপড়া শুরু করেছে। এই মানুষটা না থাকলে এই নতুন জীবনটা পাওয়া সম্ভব হতো না কোনদিন, এঁর ঋণ শোধ করা কোনদিনও সম্ভব না। সব হারিয়ে আবার সব কিছু পেয়ে আজ আর কিছুরই অভাব নেই রুহির। মাথার উপর ছাদ, খাদ্যসংস্থান, সুস্থ জীবন সবটুকুই তো এই মানুষটার দৌলতে। আজ জন্মদিন মানুষটার, রুহি আজ তাই অনেক কিছু প্ল্যান করেছে। আজ প্রাইভেট প্র্যাকটিসের অফ ডে, তাই আজ বাড়ি ফিরে কোন কাজ থাকার কথা না। কিন্তু আজই আসতে এত দেরী হচ্ছে কেন? অজানা আশঙ্কায় বুকটা কাঁপছিল রুহির। সব তো হারিয়েছে, আর কিছু হারাতে চায় না। অপেক্ষা করতে করতে কখন ঘড়ির কাঁটা সন্ধ্যে ৭টা পেরিয়ে গেছে, কে জানে। নীলিমাদেবীর গাড়িটা আসতে দেখে একটু আশ্বস্ত হলো রুহি।
*****************
আজ এক পেশেন্টের অবস্থা খুব ক্রিটিকাল ছিল। যাই হোক, শেষ অবধি মা-বাচ্চা দু’জনই ভাল আছে। আর বয়স হচ্ছে, আর শরীর সায় দিচ্ছে না রে, দে একটু জল দে।”
-“ঠিক ধরেছি, বয়স যে হচ্ছে বোঝাই যাচ্ছে, ঐ জন্যই খেয়াল নেই।” খানিক মুখ টিপে হেসে বলল রুহি।
-“এই রে, আবার কী ভুললাম বলতো? উমমম।।। কিছু তো মনে করতে পারছি না।”
রুহি বেশী কথা না বাড়িয়ে নীলিমাদেবীকে চোখ দুটো বুজতে বলে ছুটলো রান্না ঘরে, ফিরে এলো সঙ্গে সঙ্গেই, হাতে বাটিতে নীলিমাদেবীর পছন্দের শিমাই-এর পায়েস।
নীলিমাদেবী চোখদুটো চেয়ে দেখলেন যখন, সত্যিই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। প্রস্তুত ছিলেন না একদমই। যে মানুষটা আজ থেকে কয়েকবছর আগেও ধর্ম বৈষম্য, গোঁড়ামিতে এতটা ডুবে থাকত, সেই আজ নিজের রান্নাঘর, বাড়িতে এক মুসলিম মেয়েকে আশ্রয় দিয়েছেন স্বেচ্ছায়। আর আজ, সেই তার হাত থেকেই নিজের জন্মদিনের পায়েসটাও খেলেন। সত্যি নীলিমাদেবী নিজেও কোনদিন ভেবেছিলেন কী? নাহ, সত্যিই ভাবেননি।
***************
পায়েসটুকু খেয়ে প্রাণভরে ভরে রুহিকে আশীর্বাদ করলেন নীলিমাদেবী, হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসে তো অবাক। কী করেছে এইটুকু মেয়েটা। জানলোই বা কীভাবে এত নীলিমাদেবীর পছন্দ অপছন্দ?
-“কী ব্যাপার বলতো, আমার পিছনে কী স্পাই লাগিয়েছিস নাকী, আর এতকিছু জানিস তুই এইটুকু বয়সে?”
-“চোখ কান খোলা রাখলেই জানা যায়। মনে আছে সেদিন মালতীদিকে বলছিলে, ‘রোজ রোজ রুটি না করে কখনো লুচি করতে পারিস তো, একদিন লুচি খেলে কী এমন ক্ষতি হবে?’ সেদিনই বুঝলুম লুচি তোমার খুব প্রিয়। বিপাকে পড়ে খেতে পারো না।”
আজ বহুদিন পর ওনার জন্মদিনটা বড় ভাল কাটল। বিগত কয়েক বছর ধরে বাকী দিনের সাথে কোন পার্থক্য থাকে না এ দিনটার । আকাশ বরাবর ফোন করে বটে, আবার গিফ্টও পাঠায়। কিন্তু ওই টুকুই। আগেরবার একটা হাতঘড়ি পাঠিয়েছিল, খুব বেশী পরা হয় নি। এবছর এখনো ফোনও করল না। নীলিমাদেবী ঠিক করে নিয়েছেন, যাই হয়ে যাক, আজ কোনভাবেই ফোন করবেন না। রোজ উনিই ফোন করেন, দেখা যাক ছেলের আদৌ মনে পড়ে কী না।
-“একটা আবদার ছিল।।।”
কথাটায় একটু অবাকই হলেন নীলিমাদেবী, “আবদার? কী আবদার?”
পাড়ার কুকুরগুলো রাত বাড়ার সাথে সাথে এত উপদ্রব শুরু করে।।। আবার চিৎকার শুরু করল। হালকা ঠান্ডা পড়তেও শুরু করেছে। জানলা দিয়ে বেশ ঠান্ডা আসছে আজ। উঠে জানলাটা বন্ধ করে দিলেন নীলিমাদেবী। ঘরের আলো আঁধারী পরিবেশটা ভারী সুন্দর। গোল ল্যাম্পশেডটা কিনেছিলেন উনি আর অখিলেশ সিঙ্গাপুর থেকে, এত বছর পর এখনও এত সুন্দর আছে। ঘরের কোনায় মানিপ্ল্যান্টের উপস্থিতি, ধবধবে সাদা ঘরের কাঠের আসবাব, আসবাবের সাথে সঙ্গত খয়েরী পর্দা, বেডসীট, আর মৃদুমন্দ হাওয়ার সঙ্গে উইন্ডচিম-এর টুংটাং, বেতের চেয়ার টেবিল, ছোট্ট কার্পেট, এই সবকিছু নিজে হাতে সাজিয়েছিলেন নীলিমাদেবী, কত সাধ করে। কিন্তু এই সমস্ত সাজ সজ্জাই আজ বৃথা। একাকীত্বে মোড়া এই ‘আমন্ত্রণ’।
রুহিই বললো কয়েকমুহূর্ত পর, “তুমি না থাকলে আজ আর আমি আর আমার ছেলে এই পৃথিবীতেই থাকতাম না হয়তো, তোমায় আজ থেকে মা বলে ডাকতে পারি?”
বাইরে অকাল বর্ষণের বজ্রাঘাত, সঙ্গে বিদ্যুতের ঝলকানি, বৃষ্টি আসছে বলেই এরকম ঠান্ডা হাওয়া শুরু হয়েছে মনে হয়।
নীলিমাদেবী কী বলবেন খুঁজে পেলেন না খানিক্ষণ , শুধু ওনার কোঁচকানো গাল বেয়ে নেমে আসা নোনতা জল জানান দিচ্ছিল ভিতরের ঝড়টার, কীভাবে ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। আজ এত বছর ধরে জমে থাকা যন্ত্রণা অভিমানের পাহাড় যেন কেউ এক ধাক্কায় নাড়িয়ে দিল বেশ খানিকটা।
নীলিমাদেবী কিচ্ছু না বলে রুহির কপালে সস্নেহে এঁকে দিলেন চুমু, পরম মমতায়। রুহির মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, ওর এই আবদারে ওনার কোন আপত্তি নেই।
নীলিমা আঁচল দিয়ে চোখটা মুছে ঘরের মধ্যে রাখা ছোট্ট ডিভান বালিশে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসলেন, হাতে পছন্দের বই, চোখে চশমা। বাইরে বৃষ্টি শুরু হলো।
ঘড়ির কাঁটা তখন প্রায় সাড়ে দশ, রুহি ছেলেকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে নিজে খেয়ে এসে বসল নীলিমাদেবীর পায়ের কাছটায়, কার্পেটের উপর।
– “ছেলে ঘুমোলো ?”
– “হুম।”
– “বলবি কিছু?”
– “হুম।।। আচ্ছা মা, তুমি যে বারবার বলো, ‘পিউ’ কে মা? কোথায় থাকে? ছবি দেখিনি তো কোন? বাইরে থাকে? তোমার কে হয়?”
একসাথে এতগুলো প্রশ্ন ধেয়ে এল নীলিমাদেবীর দিকে, কীভাবে সামলাবেন খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
কিন্তু সত্যি বলতে কী, এড়াতে চাইছিলেন না, বরং বলতেই চাইছিলেন অনেকদিন ধরে কাউকে, শুধু শোনানোর জন্য, বলার জন্য কাউকে পাচ্ছিলেন না। কেউ ছিলই না যে সবটা শুনবে, বুঝবে।।। বিশ্বাস করবে।বলতে লাগলেন অবশেষে –
– “বহুদিন পর আমি ছাড়া পিউ নামটা অন্য কেউ উচ্চারণ করলো। পিউ প্রথম যেদিন আমার বাড়িতে পা রাখে, সত্যি বলছি সেদিন মেয়েটাকে তেমন বুঝিনি সেভাবে, আগেই আকাশের কাছে অনেক কিছু শুনেছিলাম ওর ব্যাপারে, ঐ মেয়ে কখনো বাড়ির বৌ হতে পারে, কারও স্ত্রী হতে পারে এই নিয়েই ঘোর সংশয় ছিল আমার, সেই সংশয় মনে নিয়েই প্রথম আমার দেখা পিউ-এর সাথে।
পিউ-এর ভাল নাম পল্লবী, তবে কোনদিনই সে নাম ডাকিনি। আজও মনে পড়ে, ও প্রথম এসেছিল একটা হলুদ কমলা কুর্তিতে।।। খুব মিষ্টি দেখতে লাগছিল, ফর্সা টুকটুকে একটা ছটফটে মেয়ে। খোলাচুলে হন্তদন্ত হয়ে এসেছিল আমার সামনে। আমিই ডেকেছিলাম। তবে, আজ যাই বলি, সেদিন সেই মিষ্টি মেয়েটাকে দেখে বিরক্তই হয়েছিলাম।
বাড়ির বৌ-এর তকমা হয়তো সেদিনই নিজের অজান্তে দিয়ে দিয়েছিলাম, ঐজন্যই হয়তো আর শাড়ীর বদলে কুর্তিতে দেখে তেমন ভালো লাগেনি।।।
যাইহোক, ওর চোখে আমার জন্য আমি এতটুকু ভয় দেখিনি, শুধু সেদিন না কোনও দিনই। অথচ আমায় ভয় করে চলে না এমন কেউ নেই বললেই চলে। খুব অবাক লেগেছিল সেটা। এতটুকু মেয়ের এত সাহস? নিজের অজান্তেই ওর চোখে আমার জন্য কোন ভয় না দেখে আমার ইগোয় হয়তো আঘাত লেগেছিল, হয়তো লাগেনি, কে জানে। কিন্তু পিউ, আমার, আকাশের, সবার জীবনে কেমন তরতর করে ছড়িয়ে পড়ছিল। মিশে যাচ্ছিল সবকিছুর সাথে। আমি চাইলেও পারছিলাম না, হাত থেকে যেন বেরিয়ে গেছল সবকিছু।
কিন্তু পিউকে এত অপছন্দের কারণ আমার নিজের কাছেই স্পষ্ট নয়, আজও। ওর জন্য আমার নিজের ছেলে যখন আমায় ভুল বুঝে দূরে সরতে লাগল, তখনও বুঝিনি, দোষটা কার। প্রথম যেদিন শুনলাম, পিউ একজন বংশ পরিচয়হীন, অনাথ আশ্রমে বড় হওয়া মেয়ে, আমার এই আধুনিক, শিক্ষিত সত্ত্বাটা কোথাও যেন মুখ লুকিয়েছিল ধর্মীয় গোঁড়ামি, বংশ মর্যাদার মেকী গুঞ্জনের আড়ালে। তাই, ওর সমস্ত গুনের মাঝেই বারবার প্রকট হতো ওর দোষ না থাকা এই জন্মদাগটা। আমি পারছিলাম না, কিছুতেই পারছিলাম না ওকে আপন করে নিতে, কিন্তু ও? ও তো কখনো এমনটা করেনি। সবসময় নিজের টুকু দিয়ে খেয়াল রেখেছে আমার, বুঝতে দেরী করে ফেললাম।
জানিস, একবার, ক্রিসমাসের সময়, বড়দিনের আগেরদিনই হবে, আকাশ কাজের জন্য চেন্নাই গেল, আমি আর পিউ রইলাম একা। মালতী কাজ করে চলে গেল, মালতী থাকলেও বেশিরভাগ রান্না পিউই দেখত, মালতীর রান্না বিশেষ পছন্দ করত না ও। সেদিন পালক-পনীর বানাচ্ছিল। আমি লোভী মানুষ, খুব কেকটেক খেয়ে নিয়েছিলাম সেদিন। শরীরটা খারাপ লাগছিলই, একটু রাত হতেই বমি। ওষুধ আমার জানাই আছে, কিন্তু কাহিল অবস্থায় সেদিন পিউ-এর চোখে আমার জন্য যে দুঃশ্চিন্তা দেখেছিলাম। সেদিন বুঝেছিলাম, ঐ অশক্ত শরীরেও, বৃদ্ধ মানুষদের জন্য NGO তে দিনরাত এক করে খাটা মেয়েটার মনটা সোনার থেকে কম কিছু না। সেদিন থেকেই মেয়েটার জন্য আমার মনে হয়তো একটা অন্যরকম জায়গা।।।”

কথাটা আর শেষ করলেন না নীলিমাদেবী। নিজের সাথেই যেন নিজের যুদ্ধ, হেরে গিয়ে জিতে যাচ্ছেন? নাকি জিতেও হারার ভয়? উনি নিজেই জানেন না, শুধু এটুকু জানেন, উনি নিজের অজান্তেই নিজের ‘অপ্রিয়’ মানুষটার কথা বারবার তোলেন, বারবার বলেন, কেন? সে উত্তর অজানাই। মিস করেন নাকি ঐ ছোট্ট মেয়েটাকে? ইগোর লড়াই পেরিয়ে কীভাবে।।। না না, মিস উনি করতেই পারেন না।
– “তারপর আর কী, পিউ একটু একটু করে যেমন ছড়িয়ে যাচ্ছিল এই বাড়ি, এই বাড়ির মানুষের মনে, সর্বত্র। তেমনই ওর কখনো পাগলামো, কখনো সিরিয়াস মুখ, কখনো ওর কোমর বেঁধে করা রান্নায়, কখনো ঠাকুর ঘরে ঢুকে ভুল করে ফেলে – এই সবকিছুর সাথে ভাসছিলাম আমরা, হয়তো আমিও। আমার ছেলে ভালো ছিল, তাই আমিও ভাল ছিলাম, বা ভালো থাকার চেষ্টা করছিলাম হয়তো, কে জানে, জানা নেই।”
একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল যেন সবার অলক্ষ্যে। আজ পিউ, এই আমন্ত্রণ, এই চারদেওয়ালের মধ্যে না থেকেও কতটা প্রাসঙ্গিক, কতটা বর্তমান, অনুভব করছিল রুহিও, এই বাড়িতে তার ক’দিনেরই বা বাস? কতটুকুই বা জানে সে? তাও যেন একটা অদৃশ্য, অমোঘ টান অনুভব করছিল ঐ অজানা মেয়েটাকে জানার জন্য। না না, রিল লাইফের মতো কোন পুরোনো সম্পর্ক, কোন রক্তের সম্পর্ক কোনটাই নেই এখানে, কিন্তু এই বৃদ্ধ মানুষটার ক্লান্ত চোখে অপেক্ষার যন্ত্রনাটা দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছিল রুহির মনটা। নিজের মুখে বলে পিউকে কেন পছন্দ নয়, অথচ নিজেই জানেন না পিউকে আসলে কতটা মিস করেন।
হয়তো ওনার অজান্তেই, ওনার প্রতিটা কথায়, ছোট খাটো প্রতিটি মুহূর্তে তীব্র ভাবে মিশে রয়েছে ঐ মেয়েটা, পিউ। আর তাইই পিউকে দেখতে বড় ইচ্ছে করছিল রুহির। কিন্তু, কী অদ্ভুত, সারা বাড়িতে এত ছবি, কোই কোথাও তো নেই পিউ।
নিজেদের ভিতরের জানার ইচ্ছেটাকে দমন করতে পারল না আর রুহি। বলেই ফেলল তাই, “আচ্ছা পিউর কোন ছবি এতদিন দেখিনি তো। ছবি নেই ওর??”
একটু যেন অতীতের ভাবনায় হারিয়ে গেছিলেন নীলিমাদেবী। অন্যমনস্ক ভাবেই বললেন, “কী ভাবে দেখবি? আমি নিজেই তো।।।”কথাটা অসম্পূর্ন রেখেই নিজেকে সামলে নিলেন, গলাখাঁকরি দিয়ে। ডিভান ছেড়ে এগোলেন বুক শেল্ফটার দিকে, কাঁচটা ঠেলে বের করলেন পিছনে রাখা ছোট্ট ফটো ফ্রেমটা। তখনই বাজল ফোনটা। আকাশের ফোন। ফ্রেমটা রেখে ফোনটা ধরলেন। মায়ের জন্মদিনে মনে পড়ল তাহলে ছেলের? ফটো ফ্রেমে তখন লাল বেনারসীতে পিউ।।।