আমন্ত্রণ ( প্রথম পর্ব )

।।১।।

“মালতী, তোকে কতবার বারণ করেছি আগের দিনের খবরের কাগজের সাথে নতুন কাগজ রাখবি না। কতবার বলতে হয় বলতো তোকে?” বলতে বলতেই দ্রুত হাতে কাজগুলো গোছাতে লাগলেন নীলিমা দেবী, ডঃ নীলিমা ভট্টাচার্য।

ঘড়ির কাঁটা তখন সবে ৭টার ঘর ক্রস করেছে মাত্র, মালতী যেদিন বুঝে যায় মাসির মেজাজ গরম আছে, আর রা কাড়ে না মুখে, বেশী কিছু না বলে নিজের কাজ সারতে থাকে ও।

মালতী ছোট্ট থেকে নীলিমা দেবীকে মাসি বলেই ডাকে, আগে ওর মা কাজ করতো এবাড়িতে, এখন ও। ওর বিয়ে, ছেলেপুলের লেখাপড়ার অনেকটাই খরচ এসেছে আর এখনও আসে এই মানুষটার থেকেই।

তাই শুধু মুখে না শ্রদ্ধাটা সত্যি সত্যিই করে মানুষটাকে।

আর একটু পর খাবার দাবার গুছিয়ে মালতী বেরিয়ে গেলেই খেয়ে-দেয়ে বেরিয়ে পড়বেন হাসপাতালের উদ্দেশ্যে নীলিমা দেবী, ঠিক কাঁটায় কাঁটায় রুটিনে বাঁধা ওনার জীবন, তাই এই ৫৬ বছর বয়সেও এখনও ফিট, দিব্যি একাই আছেন, স্বামী গত হয়েছেন ছয় বছর আগে, আর একমাত্র ছেলে আকাশ তো… 

তাই শোভাবাজারের এই দোতলা বাড়িটায় একাই থাকেন দিব্যি, হসপিটাল থেকে ফিরে সারা সন্ধ্যে রাত অবধি রুগী দেখেন, একতলাটায়; ততক্ষণে মালতী আবার সব গুছিয়ে দিয়ে চলে যায়। তারপর ৯:৩০টার মধ্যে খেয়েদেয়ে ঘুম। আবার পরদিন সকালে মর্নিং ওয়াক, হসপিটাল – এই ভাবেই চলে যাচ্ছে আর কী। চা-ওলা ছোটু থেকে শুরু করে ধোপার দোকানের গোপাল, নীলিমা দেবীকে পাড়ার প্রত্যেকেই যথেষ্ট শ্রদ্ধা করেন, কারণ একটাই, এমন দাপুটে মানুষ, এত বড় ডাক্তার, অথচ সবসময় সবার আপদে বিপদে এই মানুষটাকে পায় সক্কলে। কেন যেবার, পাড়ার মুদিখানার বিস্টুর বৌ-এর যখন প্রসববেদনা উঠল, তখনও এই মানুষটাই তো ছিল, বা দু’বাড়ি পরেই মিত্তির বাবুর মেয়ের যখন হঠাৎ রাত দুপুরে অসহ্য পেট যন্ত্রনা, সিস্ট ধরা পড়ল, তখনও এই মানুষটাই।

তাই, নিজের দোতলা বাড়িতে হতেই পারে মানুষটা একা, কিন্তু এতগুলো মানুষ ওনার পাশেই আছেন, বেশ বোঝেন সেটা নীলিমাদেবী।

এই যেমন এখন, আজ যা দেরী হয়েছে, মালতী বুদ্ধি করে ব্রেকফাস্টও ফয়েল মুড়ে প্যাক করে ব্যাগে না পুরে দিলে খাওয়াই হতো না। এভাবেই আশেপাশের এই অতি সাধারণ মানুষগুলোর নিখাদ ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, না থাকলে শ্বাসটাই নিতে পারতেন না নীলিমাদেবী।

****************

“হ্যাঁ, এই ওষুধগুলো কন্টিনিউ করো, ১৫দিন পর রিপোর্ট দিয়ে যাবে।” রোগীকে ছেড়ে সবে জলটা খেতে যাচ্ছেন তখনই কানে এলো চেঁচামেচির আওয়াজ। কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করেই চেম্বারের বাইরে বেরলেন নীলিমা দেবী। মেন গেটের কাছে একটা জটলা, বাবলুটা পাশ দিয়েই যাচ্ছিলো হনহনিয়ে, এই হসপিটালেরই বয়, ওকে থামিয়েই প্রশ্ন করলেন, “এই কীসের এত গোলমাল রে? কী হয়েছে ওখানে?”

-“আর বলবেন না ম্যাডাম, একটা মেয়ে লেবার পেইন নিয়ে গেটের বাইরে, অবস্থা ভালো না, বাড়ির লোকই বা কী, এই অবস্থায় ফেলে দিয়ে গেছে? নাকি কেউ নেই, কে জানে, আমিও ওদিকেই যাচ্ছি।”

-“সেকী? এখন কী সার্কাস দেখবে সবাই? আশ্চর্য তো!”

ঝড়ের গতিতে ভিড়ের দিকে এগিয়ে গেলেন, সামনের ভিড়টা ঠেলে সরিয়ে এগোতেই…

সাধারণত, এসব কেসে হসপিটাল কখনোই নিজের মাথায় ঝামেলা নিতে চায় না, কিন্তু নীলিমা দেবী যেখানে আছেন, সেখানে কোনো রোগী বিনা চিকিৎসায় পড়ে থাকবে? নাহ, এটা সম্ভব না। তাই এবারেও মেয়েটাকে প্রসব বেদনায় বেশীক্ষণ কাতরাতে হয়নি, এই মানুষটার দয়ায় আর প্রভাবে বেচারীর অন্তত ঠাঁই টুকু জুটলো মেঝে থেকে বেডে। এটাই বা কতজনের হয় যাদের পকেটের জোর না থাকে।

মেয়েটার পোশাক আশাক দেখে খুব একটা সম্পন্ন পরিবার একেবারেই মনে হয় না। শতছিন্ন বেশভূষা, অযত্নে চুলগুলো উসকো খুস্কো, চোখটা আধবোজা, যন্ত্রনায় অজ্ঞান হয়ে গেছে। নীলিমাদেবী আর এই মুহূর্তে ওর ঠিকুজীকুষ্ঠীর অপেক্ষা করতে পারেননি। নীলিমাদেবীর পটু হাত বুঝল, আর বেশী দেরী করা যাবে না। কাবেরীকে বললেন টেবিল রেডি করতে, এরকম ঘটনা এর আগেও ঘটেছে কিন্তু এই ধরনের কেসে পেশেন্টের বাড়ির লোক কিছু বুঝে উঠতে না পেরে এই হাসপাতালেই নিয়ে আসে। খুব একটা অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, প্রভাব, টাকার জোর না থাকায়, সবকিছু ভগবানের উপরই ছেড়ে দেন। যদিও নীলিমাদেবীর মতন মানুষ থাকলে চিকিৎসা শুরু হতে খুব একটা দেরী হয় না, কিন্তু বাকীরা টাকা জমা না পড়া অবধি অপেক্ষা করান। কতবার এরকম হয়েছে যে নীলিমাদেবী নিজে ক্যাসকাউন্টারে টাকা জমা দিয়ে চিকিৎসা শুরু করে দিয়েছেন, পেশেন্ট পার্টি পরে টাকার জোগাড় করে দিয়ে দিয়েছে, বা অনেকসময় পুরোটা দিতেও পারেনি।

কিন্তু, আজ তো এর সাথে কেউই নেই। তাই ভালো, মন্দ যা কিছুই হোক না কেন, দায়িত্ব কে নেবে?

****************

ক্রিটিকাল ছিল কেসটা, মা বাচ্চা দুজনেই যে বাঁচবে একটা সময় সেটা মনে হচ্ছিল না আর, বেশ কিছুক্ষণের চেষ্টার পর যখন নীলিমা দেবী ঐ অভাগীর সদ্যোজাতকে হাতে ধরলেন, রক্তাক্ত ঘর্মাক্ত অবস্থায় যখন সদ্যজাতর চিলচিৎকার কান্না শুনলেন, সে যে কী পরিতৃপ্তির, তা বলে বোঝানোর না। ছেলে হয়েছে, দায়িত্ব হস্তান্তর করে ওটি থেকে বেরিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নিজের চেম্বারে বসলেন, এক কাপ কফি নিয়ে। ব্যালকনি দিয়ে নীচের সাজানো বাগানটার দিকে চেয়ে একটা স্বস্তির নিঃস্বাস নিলেন, কোথাও যেন একটা পরম নিশ্চিন্তি, কাউকে যেন মনে মনে বলা কিছু কথা… 

-“ম্যাডাম।”

-“হ্যাঁ, এস।”

-“বাচ্চার ওয়েট বেশ কম, আন্ডার ওয়েট আর এমনি বাকী সব ঠিক আছে।”

-“ঠিক আছে, আসছি আমি। ওর বাড়ির কারো কোন খোঁজ?”

-“নো ম্যাডাম।”

একটা চিন্তার ভাঁজ পড়ল নীলিমাদেবীর কপালে। কয়েকমুহূর্ত চুপ থেকে যেতে বললেন সিস্টারকে। মেয়েটা একটু নর্মাল হোক, কথা বলতে হবে ওর সাথে, এভাবে একা… উঠে পড়লেন নীলিমা দেবী।

।।২।।

বাড়ি ফিরে, রোগী দেখার পর খেতে বসেও বারবার একই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল, কিছুতেই বের করতে পারছিলেন না মাথা থেকে। বাড়িতে একাই থাকেন তাই কাউকে বলার মতোও নেই, মালতী আজ ফুলকপিটাও কেমন একটা বানিয়েছে, পুরোটা আর খেতে পারলেন না। উঠে বারান্দাটায় বসলেন একটু। আজ মনটা কিছুতেই ঝাড়া হাত-পা হতে পারছে না, বহুদিন পর, বহুকাল পর এরকমটা হচ্ছে। আজ রাত দশটা বেজে গেছে, অথচ ঘুম আসছে না। চোখে, বারবার মেয়েটার মুখটা ভেসে আসছে, এই অবস্থায় একা, কতই বা বয়স, বড় জোর ২২,না না তাও হবে না, যন্ত্রণায় যখন কাতরাচ্ছিল, ওর মায়াভরা চোখদুটো দেখে কিছুতেই নিজেকে স্থির রাখতে পারছিলেন না।

কেমন আছে এখন কে জানে? ছোট্ট বাচ্চাটাকে নিয়ে এইটুকু একটা মেয়ে একা কী করবে কে জানে? আবোলতাবোল ভাবতে ভাবতেই চোখ গেল শেল্ফে সাজানো ফটোফ্রেমগুলোর দিকে। আজ এই পুরো বাড়িতে উনি একা, অথচ এক সময় এই বাড়ি গমগম করতো। প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন, নিজের থেকে সিনিয়র অখিলেশদাকে। শ্বশুর শাশুড়ি স্বামী সন্তান নিয়ে ভরা সংসার, সারাদিনের ব্যস্ততায়, সন্ধ্যের আড্ডায় জমজমাট থাকতো এই ‘আমন্ত্রণ’। স্বামী স্ত্রী সন্ধ্যের প্র্যাকটিস শুরু করেছিলেন অনেক পরে, তখন হসপিটাল থেকে ফিরে অখন্ড অবসর। শাশুড়িমার হাতের রান্না নীলিমাদেবীর সব থেকে প্রিয় ছিল, অসাধারন রাঁধতেন মানুষটা। সাধারণ গৃহবধূ হয়েও ছিলেন অসম্ভব স্মার্ট, আর শুধু পোশাক আশাকে নয় তার সাথে চিন্তায় মননেও আধুনিক। 

তাই নিজের কেরিয়ার নিয়ে কোনদিনও কোন আপোষ করতে হয়নি নীলিমাদেবীকে। বাড়িতে সন্ধ্যেয় ফিরেই মুখের সামনে হাজির থাকত, চা, মুড়ি, তেলেভাজা। শ্বশুরমশাই-এর সাহিত্যিক মহলে বন্ধুত্ব থাকায়, নিজের প্রকাশনী থাকায় আর তার ওপর লেখালেখির ঝোঁক থাকায় প্রায়ই বড় বড় মানুষদের সাথে আড্ডা বসতো। সবমিলিয়ে সারাটাদিন ব্যস্ততা আর প্রতিটা সন্ধ্যে আড্ডায়,গল্পে খুব ভাল কাটত ‘আমন্ত্রণ’-এর। তারপর সময়ের সাথে সাথে আকাশ এলো, নীলিমার আদরের ছোট্ট তাতান। ওকে নিয়ে ছুটোছুটি, তাড়াহুড়ো, দৌড়াদৌড়ি করতে করতে কবে যে আকাশটা এত বড় হয়ে গেল, আর নীলিমাদেবী এতটা বুড়িয়ে গেলেন, বুঝতেই পারলেন না। আজ ঐ গমগম করা বাড়িটাই খাঁ-খাঁ করে, একটা মাত্র মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসে, তার পায়ের আওয়াজে বাড়ির প্রতিটি ইটও যেন নিরাশ, মুক্তি চায় ওরাও। তাতানটা কতদিন আসে না, আগে নিয়মিত ভিডিও কলটা করত অন্তত, এখন সেটাও…

সহজে কাঁদেন না নীলিমাদেবী, কিন্তু আজ বড্ড ইচ্ছে করছে কাঁদতে, কিন্তু পারছেন কই? কী অদ্ভুত এই পৃথিবী, কোথাও সন্তান একা, কোথাও বুড়ো বাপ মা একা।

ধীর পায়ে উঠলেন নীলিমা দেবী। রাত হয়ে গেল আজ। শেল্ফে সাজানো ফটোফ্রেমগুলোয় যেন ধুলো জমেছে, কাঁচের মধ্যে থেকে তাতানের ছোট বেলার ফটো বের করে নিজের আঁচল দিয়ে মুছে নিজেই হাসলেন, এটা সেই পাটনার ছবি, তাতান তখন সবে কথা বলতে শিখেছে, চিলচিৎকার করে কিছু একটা বলতে চেষ্টা করছে। নিজের মনে হাসতে হাসতে শেল্ফের দিকে তাকাতেই ফটোটা চোখে পড়ল। এই ফটোটা তো সব ফটোর আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিলেন নীলিমাদেবী, দেখতে চান না বলে। মুখের হাসি নিজের অজান্তেই কখন মিলিয়ে গেছে। হাতে নিলেন ফটোটা। বাইরে ঘড়িতে ঢংঢং করে ১২টার ঘন্টা পড়ল।

।।৩।।

আজ খুব একটা গরম নেই, শীতের আমেজ পড়তে শুরু করেছে, জানলা দিয়ে হালকা মিঠে রোদ গরাদ গলে পড়েছে পাশের খাটটায়, সেদিকেই আনমনে তাকিয়ে ছিল মেয়েটা। ঘরে ঢুকলেন নীলিমাদেবী। কাল রাত থেকেই মনটা চঞ্চল, আজ তাই আর দেরী করেননি বেশী।

“কী? শরীর ঠিক তো?”, “ছেলে কী বলছে?”, “ঘুম হয়েছিল?”, এমনই টুকরো টুকরো প্রশ্নগুলোর অতি সামান্য কটা শব্দে উত্তর সারল মেয়েটা। নীলিমাদেবী অভিজ্ঞ চোখে বুঝলেন সমস্যাটা কোথায়। এই মুহূর্তে হাতে খানিকটা সময় রয়েছে, হাত ঘড়ির কাঁটার দিকে চেয়ে জরিপ করে নিলেন সেটা। বসলেন বেডের পাশটায় চেয়ার টেনে। মেয়েটার উদাস দৃষ্টিটা কোথায় গিয়ে হারিয়েছে, খেই পেলেন না, খানিক গলা খাঁকরি দিয়ে বললেন, “তোমার নামটা কী?”

মেয়েটা যেন শুনেও শুনলো না, কয়েকমুহূর্তের বিরতিতে আবার বললেন নীলিমাদেবী, “তোমার বাড়ি কোথায়? বলো কিছু যাতে তোমায় আমরা হেল্প করতে পারি, এভাবে তো কোন সমস্যার সমাধান হবে না।”

মেয়েটি এখনও নির্বাক, শুধু চেয়ে রয়েছে শূন্য দৃষ্টিতে নীলিমাদেবীর দিকে। নীলিমাদেবী আবার বললেন, “আমি নিজে দায়িত্ব নিয়ে তোমার ডেলিভারিটা করিয়েছি, অনেক কমপ্লিকেশন্স ছিল, তাই এখন তোমার শরীরের যা অবস্থা, আমার ডাক্তার হিসেবে জানাটা দরকার সবটা, তোমার জন্যই। তোমায় এখন প্রপার শিডিউলে থাকতে হবে। বুঝতে পারছ তুমি, কী বলছি আমি?”

ততক্ষণে মুখ খুললো মেয়েটা, “ম্যাম”।

প্রথমেই এই শব্দটা আশা করেননি নীলিমাদেবী, মেয়েটার অবস্থা দেখে তেমন শিক্ষিতও মনে হচ্ছে না।

কয়েকমুহূর্তের মধ্যেই মেয়েটা আবার বলল, “ম্যাম, আমার নাম রুহি, আমি।।।”

এটুকু বলেই কয়েকমুহূর্ত যেন কী একটা ভেবে নিল ও। নীলিমাদেবী এই উত্তরটাও প্রত্যাশা করেননি, কোথাও যেন ভীষণরকম ধাক্কা খাচ্ছিল মনটা। অনেক কিছু ঘুরছিল একসাথে মাথায়, কিন্তু বলার কিছু ছিল না তখন, উপায়ও ছিল না।

মেয়েটাই আবার বলল, “হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার পর, রাহুলের সাথে আমার সম্পর্ক সেই শুরু, তারপর…” বাচ্চাটার দিকে তাকিয়েই বলল রুহি, “এই যে এ চলে এল, আমাদেরই দোষ। তড়িঘড়ি বিয়েটা করতে বাধ্য হই, দুই বাড়িই স্বভাবিকভাবেই মানেনি, কিন্তু আর কোন উপায় ছিল না, অনেক দেরী হয়ে গেছিল। কিন্তু তারপর রাহুলও আমায় ছেড়ে দেবে, আমার বিশ্বাস হয়নি। আর একা আমি কী-ইবা করতাম? জানি না ও কোথায় আছে, কিছুই জানি না আমি। পড়াশোনাটাও করিনি, ক্লাস ১১ অবধি। আর এই ক’টা মাস যে কীভাবে কেটেছে।।। শেষ সময়ে পারিনি আর টানতে, হাসপাতাল অবধি পৌঁছানোরও আর ক্ষমতা ছিল না আমার। এ ক’টা মাস এক মাসিই কাজ জুটিয়ে দিয়েছিল, যে বাড়িতে মাসি রান্না করত, সে বাড়িতেই। কাজটা না পেলে আর…”

মেয়েটা আর কিছু বলতে পারল না, গলা জড়িয়ে যাচ্ছিল কান্নায়, কতই বা বয়েস।

নীলিমাদেবী যথেষ্ট মেজাজী, রাশভারী মানুষ, কিন্তু কথাগুলো শোনার পর রাগের থেকেও করুণা হলো বেশী। কী বলা উচিত বুঝলেন না, ফরম্যালিটিজগুলো তো পুরো করতে হবে, ওষুধগুলো চেক করে উঠে পড়লেন।

****************

“আজ আর অতটা চাল নিস না তো, বয়স হচ্ছে তো, অত খাওয়া যায়, না খাওয়া ঠিক? কম চাল নে”, মালতী কে বলে বারান্দাটায় চা নিয়ে বসলেন নীলিমাদেবী।

আজ ওনার অফ, আজ আর প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন না। এই বারান্দাটা নীলিমাদেবীর বড্ড প্রিয়, এই বারান্দাটা বড় রাস্তার উপর, অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই চেয়ারটা, এই বারান্দাটা ঘিরে। শ্বশুরমশাই এই চেয়ারটাতেই বসতেন, তারপর স্বামী। এই বারান্দাটা থেকেই ছোট্ট তাতান স্কুল যাওয়ার সময় টাটা করত, ব্যস্ততার জন্য অধিকাংশ দিনই বারান্দায় দাঁড়াতেন না, তাতান মুখ নীচু করে চলে যেত। সেই তাতানই আজ কত বড় হয়ে গেছে, কত দূরে চলে গেল ছেলেটা, এখন তো ওনার অবসরের সময়টাও উনি নিজেই নিজেকে কাজে জোর করে ডুবিয়ে রাখেন, একাকীত্বকে ঢেকে রাখতে।

আজ হাসপাতালে রুহির কথাগুলো কিছুতেই মাথা থেকে বেরচ্ছে না। এতটুকু একটা মেয়ে, শেষ তো জীবনটা। কেন করলো এরকম? কী পেল এসব করে? আর কিছু এচিভ করতে পারবে লাইফে? এচিভ-এর কথায় মনে পড়ল পিউ কী যেন বলতো?

পিউ, এই একটা নাম ওনার জীবনের প্রথম থেকে এখনও অবধি, ওনার সমস্ত ধ্যানধারণা, সমস্ত বিশ্বাসকে টলিয়ে দিয়েছিল মেয়েটা। ভীষণ ছটপটে, প্রাণবন্ত, সবসময় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, আরে বাড়ির বৌ বলে কথা, কিন্তু ওকে দেখে একেবারে জন্যও মনে হবে না কারো, বরং বাড়ির ছটপটে মেয়েই মনে হতো বেশী। সমস্ত ব্যাপারে নিজের মত জাহির করত না বটে, কিন্তু যে ঘটনাটা ওর অপছন্দের সেটা বলতে ছাড়তোও না।

নীলিমাদেবীর কাছে আকাশ যখন প্রথম পিউকে নিয়ে আসে, নীলিমাদেবীর সেই বিচ্ছু মেয়েটাকে দেখে মনেই হয়নি, এইটুকু মেয়েটা বাড়ির বৌ! কিন্তু কথা বলে বুঝেছিলেন, ছোট হলে কী হবে, বাকী অনেকের থেকে অনেক বেশী অভিজ্ঞ, পরিণত মনস্ক। বাস্তববাদী চিন্তাভাবনা মেয়েটার। বারবার নীলিমাদেবীর গড়া চিন্তাভাবনায় আঘাত হানতো মেয়েটা, যথেষ্ট যুক্তি দিয়েই। বলার কিছু থাকতো না আর ওনার। তাই সত্যিই, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই পিউকে প্রথমে একদমই উদ্ভট, আজব, অন্যরকম লেগেছিল নীলিমাদেবীর। বাড়ির বৌ হিসাবে যে জিনিসগুলো কল্পনায় গেড়ে বসেছিল, তার থেকে অনেকটা অন্যরকম ছিল পিউ।

****************

হাঁটুর ব্যথাটা আজ অল্প বেড়েছে, হাঁটুটা সামলে বুকশেল্ফটার কাছে গেলেন নীলিমাদেবীর, পিছনে চোখের আড়ালে রাখা ফটোফ্রেমটা বের করলেন, তাতান আর পিউ-এর বিয়ের ছবি। ধীর স্থির শান্ত তাতানের পাশে পিউ যেন খরস্রোতা নদীর মতো, স্বচ্ছ, চঞ্চল।

এই তো এই ডিভানটার উপর ফিশফ্রাই নিয়ে খেতে বসে গিয়ে কী ঝাড়টাই না খেয়েছিল। কিংবা খাঁচার পাল্লা খুলে উড়িয়ে দিয়েছিল পাখিগুলোকে যেদিন, অবাক হয়েছিলেন নীলিমাদেবী, ভারী অদ্ভুত মেয়ে তো। ঐ ঘর, ঐ জুঁই ফুলের গাছটা, ওদের ঘরের মধ্যে দেওয়াল আলমারিতে রাখা টেডিবিয়ারটা, সবকিছুতেই পিউ জড়িয়ে রয়েছে। নীলিমাদেবী যতই আড়াল করার চেষ্টা করুন না কেন, পিউ এভাবেই জড়িয়ে রয়েছে সবকিছুর সাথে ওতপ্রোতভাবে।

-“কী গো নাও চা-টা, ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো।”

মালতীর কথায় অতীত থেকে বর্তমানে ফিরলেন নীলিমাদেবী। পাড়ার মন্দিরে তখন আরতি শুরু হয়েছে।

***************

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

সাঁঝের শিশির (অন্তিম পর্ব)

।। ১।।   ( বেশ কিছুদিন পর ) সারা বাড়িতে এই লাগোয়া বারান্দাটাই টিকলির সবথেকে প্রিয়। সামনে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে বাগান মতো, তারপর রাস্তা। আগে

Read More »

সাঁঝের শিশির (ষষ্ঠ পর্ব)

।।১।। (কিছুদিন পর) “আরে আমি নিজেই ফিরে যাব, রতনদা তো আছেই, আবার তুই আসবি কেন?” “তুই তো আচ্ছা হাঁদা, বলছি রতনদাকে ফেরত পাঠাতে, আর এবার

Read More »

সাঁঝের শিশির (পঞ্চম পর্ব)

।।১।। “এবার বিশ্বাস হল তো, মেয়েটা খামোখা কেন মিথ্যে বলবে বলো তো? আর আমি তো প্রথমেই দেখেছিলাম, তোমায় বলেওছিলাম, তুমিই আমার কথা বিশ্বাস করোনি, এখন

Read More »

সাঁঝের শিশির (তৃতীয় পর্ব)

“তুমি একবার আমার কথাটা শোনো, আচ্ছা আমার মিথ্যে বলে কি লাভ বলতো? আর তোমার মনে হয় আমি এই অবস্থাতেও মিথ্যে কথা বলব এখনও?” “সত্যি মিথ্যের

Read More »

সাঁঝের শিশির (দ্বিতীয় পর্ব)

।।১।। “কি গো টিকলিরাণী, খাও। কখন থেকে খাবারের থালা নিয়ে বসে আছ? তোমার প্রিয় পাস্তা করে দিলুম যে, ভাল হয়নি?” অন্যমনস্ক টিকলি সামনের বাগানটার দিকে

Read More »

Share with