||১||
“সত্যিই দিন দিন দুর্বল লাগছে আজকাল, দেখি রিপোর্টগুলো আজ |”, বলতে বলতেই ঘুমের আমেজ কাটিয়ে উঠে পড়ল পলাশ |
ঘরে তখন আলতো নরম রোদের খেলা শুরু হয়েছে, সোনালী রোদের ধারা চুঁইয়ে নামছে জানলার কাঁচ বেয়ে | এমন সময় ফোনে নন্দিতার ছবি, অল্প হেসে নন্দিতার হাসি মুখটার দিকে হাঁ করে দেখছিলো পলাশ | ফোনটা যে ধরতে হবে সেটাও খেয়াল নেই, শেষ মুহূর্তে ধরলো ফোনটা | ওপাশ থেকে নন্দিতার ঘুম জড়ানো আদুরে গলাটা ভেসে এল | দিনের শুরুতেই টুক করে একটু প্রেম বিনিময় করে নেয় ওরা | কথা শেষে ফ্রেশ হতে গেল পলাশ |
||২||
পলাশ বনেদী বাড়ির ছেলে, বাড়ি দেখে, ওর পোশাক আশাক চাল চলনেই সে আভাস পাওয়া যায় | বংশ পরম্পরায় পারিবারিক ব্যবসা চলে আসছে, পলাশ ও সবে ব্যবসায় হাত পাকাতে শুরু করেছে |
নন্দিতার সাথে পলাশের প্রেম মাস আটেক, কিন্তু এর মধ্যেই যেন মনে হয় জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক, খুব ভালবেসে ফেলেছে ও নন্দিতাকে | বাড়িতে যদিও খুব একটা সাপোর্ট করছে না ব্যাপারটাকে, তাও ও ঠিক লড়তে পারবে, নন্দিতা পাশে থাকলে | যেদিন থেকে ও নন্দিতাকে দেখেছে…কী জানি, জানে না কবে ভালবেসে ফেলেছে, শুধু এটুকু জানা কথা নন্দিতা ছাড়া আর কাউকে ভালবাসা পলাশের পক্ষে সম্ভব নয় |
*****************
দোকানে বেরোবে পলাশ, ওদের দু-তিনটে পারিবারিক ব্যবসা, ও বসে ওদের সোনার দোকানটায় | রেডি হয়ে টেবিলে বসল ও, মা খেতে দিচ্ছে, খেয়েই বেরিয়ে পড়বে, তারপর সময় করে একবার রিপোর্টটা আনতেও যেতে হবে |
ডালটা দিয়ে ভাত মেখে মুখে পুরল পলাশ, মা পাশে বসে বললেন, “দেখ বাবা, তোর বাবা দাদা কেউই কিন্তু ঐ মেয়েটার সাথে তোর ঘোরা ফেরা পছন্দ করছে না, তুইও একটু কথা শোন না বাবা |”
খেতে খেতে এরকম কথা শুনে রাগে কান লাল হয়ে গেল পলাশের | তাও নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করল, খানিক চুপ থেকে বলল,”মা আমি একটা কথা বুঝি না নন্দিতাকে নিয়ে এত অসুবিধা কিসের বাবা আর দাদার?”
মিনতি দেবী খানিক আমতা আমতা করে বললেন,”তোর দাদা বলছিলো মেয়েটিকে আরও দুই ছেলের সাথে দেখেছে, তাহলেই বোঝ |কেউ তো এমনি এমনি বলছে না |”
“কী যা তা বলছ মা | ধুর |” পাতে খানিক জল ঢেলে উঠে পড়ল পলাশ |
****************
বেরিয়ে পড়ল পলাশ, ও নিজের গাড়িতেই যায় | ড্রাইভ করতে করতে এই কথাটাই ওর মাথায় ঘুরছিলো, কিন্তু তাও ও নন্দিতাকে যথেষ্ট বিশ্বাস করে, ও জানে ওর নন্দু খারাপ কিছু করতে পারে না | অবশেষে ওদের দোকানের সামনে পৌঁছে গেল পলাশ |
||৩||
চেম্বারের এল.ই.ডি লাইটের চাকচিক্যের মাঝেও যেন একরাশ অন্ধকার, ঠান্ডা এ.সি রুমেও যেন ঘাম দিচ্ছে পলাশের | ওর হাতে রিপোর্টগুলো… রিপোর্টগুলো জানান দিচ্ছে ওর ক্যান্সারের সম্ভাবনা | মেরুদন্ড দিয়ে যেন একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল, কিছু বলার মত অবস্থাতেও নেই |
টেবিলে ফোনটা নন্দিতার বেজে বেজে কেটে গেল | কী বলবে এবার ওকে ও? মা, বাবা, দাদা, বৌদি…উফফ, আর পারছে না পলাশ | এখনই এসব কেন?
সামনে বসা ডঃ সেন বললেন,”আপনি এখনই এতো ভেঙে পড়বেন না, আগে বায়োপসি রিপোর্টটা হাতে পান ….|”
ডাক্তারের বাকি কথাগুলো আর কানে যাচ্ছে না পলাশের | নেমে গাড়ি স্টার্ট দিল, আজ তো নন্দিতার সাথে দেখা করার কথাও ছিল | হঠাৎ মেসেজ ঢুকল নন্দিতার | নন্দিতা অনেকদিন ধরেই আবদার করছিল, ওর একটা রিস্টলেট চাই সোনার | পলাশই ওদের দোকানের কালেকশনের ফটো দেখিয়েছিল, আজ পলাশ কথা দিয়েছিল দেবে, সেটাই মনে করাচ্ছে নন্দিতা |
পলাশের নিজেকে আজ বড় বিধ্বস্ত লাগছিল, একা থাকতে খুব ইচ্ছে করছে আজ | ফোনটা লাগালো নন্দিতাকে, গাড়িটা সাইড করে |
-“হ্যালো, বলছি কাল দেখা করি?”
-“না বেবি, তুমি কিন্তু প্রমিস করেছিলে |”
-“হ্যাঁ, আসলে শরীরটা ভাল নেই একদম | এই জাস্ট চেম্বার থেকে বেরলাম রিপোর্টগুলো নিয়ে | কাল দেখা করি না |”
-“ধ্যুর, আরে কিছু হবে না, তুমি আমার কাছে চলে এস, একদম ফিট হয়ে যাবে…|”
পলাশের কথা বলতেও ইচ্ছে করছিল না আর, কেটে দিলো ফোনটা | আচ্ছা নন্দিতা তো একবারও জিজ্ঞেস করলো না ওর কী হয়েছে, বা রিপোর্টে কী এল? নাহ, কী সব ভাবছে? নিশ্চই বেচারীর মন খারাপ, ও কাল সকালেই গিয়ে ওকে সারপ্রাইজ দেবে |
||৪||
নন্দিতার খুব রাগ, সকাল থেকেই ফোনে ট্রাই করে করেও পাচ্ছে না | বড় অবুঝ মেয়েটা, এরকম করলে হয়?
কিছুক্ষন চেষ্টার পর আপাতত ফোনটা রাখল পলাশ | কাল থেকে নিজেও মানসিকভাবে যথেষ্ট বিধ্বস্ত, কাউকে এখনো কিছুই জানায়নি ও | একবার মনে হচ্ছে জানাবে, তাহলে মোরাল সাপোর্ট টুকু পাওয়া যায়, আবার ভাবল, মা, বাবা, দাদা, বৌদি, ছোট্ট ভাইঝি এদের সবার মুখের হাসিটা একনিমেষে মিলিয়ে যাবে যে | নন্দিতার কী হবে? নন্দিতা ওকে ছাড়া তো থাকতেই পারে না | এসব ভাবতে ভাবতেই ঘড়ির কাঁটা যে কখন ঘুরে গেছে দেখেইনি পলাশ | ও ঠিক করলো, বায়োপসি রিপোর্ট পেলে তবেই যা বলার বলবে, কাউকে এত টেনশন দেবার কোন মানেই হয় না |
*****************
কাল হাতে আসবে বায়োপসি রিপোর্টটা, তাহলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে | কাউকে কিচ্ছু বলেনি পলাশ, একা একা গঙ্গার ঘাটে বসেছিল নন্দিতার অপেক্ষায়, এখনো পাত্তা নেই | আরও কিছুক্ষণ পর নন্দিতা এল |
“কী মনে পড়ল তবে? তুমি তো ফোনই ধর না, দেখাও কর না |” অভিমানী স্বরে পলাশ প্রশ্ন করল |
-“কী করব? রাগ হয়েছিল আমার খুব তোমার উপর | আচ্ছা বলো কেন এত জরুরি তলব?”
-“এমনি তোমায় দেখতে ইচ্ছে করছিল |”
-“ওলে বাবলি, তোমায় তো বলেছি ভিডিও কল করে নেবে, তাহলেই হবে |”
-“সামনে থেকে দেখা আর ভিডিও কল কী এক?”
-“না তা নয়, আচ্ছা বাদ দাও, বলো আমার জন্য কী এনেছ?”
নন্দিতার আবদার দেখে হাসি পেয়ে গেল পলাশের, সাথে একটু অবাকও লাগল, নন্দিতা একবারও জিজ্ঞাসা করেনি সেদিন থেকে পলাশকে যে ও কেমন আছে? অথচ পলাশ দিনরাত নন্দিতার খবর রাখে | যাকগে, এসব ভুলভাল চিন্তাকে প্রশ্রয় না দিয়েই নন্দিতার হাতটা ধরল পলাশ, বলল, “চোখটা বোজো |
-“কেন? আচ্ছা ঠিক আছে, বুঝেছি, সারপ্রাইজ!”, বলে হাসিমুখে নন্দিতা চোখ বুজল |
নন্দিতার পছন্দের রিস্টলেটের বক্সটা ওর হাতে তুলে দিল পলাশ | গিফ্টটা পেয়ে ওর আনন্দ দেখার মত |
হাঁ করে ওর হাসিমুখটাই দেখছিল পলাশ, হঠাৎ প্রশ্ন করল,”আচ্ছা তুমি আমায় ছাড়া বাঁচবে?”
তাল কাটল খানিকটা | “কী যা তা বলছ? তুমি কোথায় যাবে আমায় ছেড়ে? আমি বেঁচে থাকতে তোমার কিছু হতে পারে না জানি আমি, আমার ভালোবাসায় এটুকু জোর আছে |” থামল নন্দিতা | নন্দিতার চোখ দুটো ছলছলে | পলাশের কাঁধে মাথা রাখল নন্দিতা, সামনে তখন গঙ্গায় প্রবল জোয়ার, সাথে ঝোড়ো হাওয়া, সবটুকু উথাল পাথাল হচ্ছে যেন |
||৫||
বায়োপসি রিপোর্টটা হাতে | ঘরে এ. সি চলছে তাও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, নিজের ঘর সম্পূর্ণ অন্ধকার করে বসে আছে পলাশ | আজ বাড়ি ফিরে কিছু খায়ওনি | মা এর মধ্যেই বার দুই ডেকে গেছে জল খাবার খেতে আসার জন্য | সাবেকী আমলের ঘড়িটা ঢং ঢং করে জানান দিল সন্ধ্যে সাতটা | ব্লাড ক্যান্সার থার্ড স্টেজ না কি, এতদিন এতটুকু বুঝল না কিছু ভিতরে ভিতরে কর্কট এভাবে দানা বাঁধছে |
নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে এখন পলাশের | মা, বাবা, নন্দিতা, দাদা, বৌদি ওর ছোট্ট ভাইঝি পুপু, কীভাবে বলবে এদের? কী বলবে? নন্দিতার সাথে ঘর বাঁধার স্বপ্নটা যে সবে দেখতে শুরু করেছিল, এখনই এসব হতে হলো? নন্দিতার কী হবে এবার?
****************
রাত দশটা, ছোট্ট পুপু ডাক্তারি কাগজটার ভাষা, মানে, তাৎপর্য অত তো বোঝে না, ঘরে ঢুকে হাতড়ে ওটাই সামনে পেয়ে খেলতে খেলতে চলে গেছল পাশের ঘরে | বিধ্বস্ত পলাশ ছাদে, কার্নিশে রাখা টবগুলো ঝোড়ো কালবৈশাখীর হাওয়ায় তখন জীবনী শক্তি খুঁজতে ব্যস্ত ছিল, তখনই কাগজটা পুপুর বাবা মানে পলাশের দাদা বিকাশের হাতে পড়ে |
******************
এখন ড্রয়িং রুম ঘিরে নীরবতা বলা ভুল, যেন শেষ হওয়ার আগেই শেষ হয়ে গেছে সবটুকু, এক লহমায় | বিকাশ সবার মতো ভেঙে পড়ার মানুষ না, শেষ অবধি চেষ্টা চালিয়ে যায়, এতটাই ও পজিটিভ চিন্তা ধারায় বিশ্বাসী | বিকাশ বলল,”আমাদের তো টাকার অভাব নেই, ওকে বড় ডাক্তার দেখাব, যত টাকা লাগে লাগুক | ভেলোর নিয়ে যাব, বিদেশে নিয়ে যাব, আমি হাল ছাড়ছি না | চেষ্টা তো করতেই হবে |” শক্ত করে পলাশের হাতটা ধরল বিকাশ, সেই শক্তির কাছে মারণ কর্কটও নস্যি |
****************
নন্দিতাকে পুরো সত্যিটা জানিয়েছে পলাশ | ওর থেকে কিছু লুকোতে বা মিথ্যে বলতে কোনদিনই পছন্দ করত না পলাশ, আজও তার অন্যথা হয়নি | তবে পলাশ আশা করেছিল নন্দিতা হয়তো অন্যভাবে রিঅ্যাক্ট করবে, কিন্তু ঘটল কিছু অন্যই | যে সবদিন সাথে থাকার আশ্বাস দিত, আজ তার কথাগুলো কেমন বেসুরো|
-“তোমার এসমস্ত কথা আমার বাড়িতে জানালে আমার বাড়িতে কীভাবে রিঅ্যাক্ট করবে? কীভাবে আমাদের সম্পর্কটা মানবে, বুঝতে পারছি না |”
নন্দিতার এই কথাটা আজ বড্ড কানে লাগল পলাশের, এই নন্দিতাকে তো ও চেনে না | তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসে সেদিন পলাশ, ব্যালকনিতে রাতের অন্ধকার তখন ঝুপ করে আস্তানা গেড়েছে | কিছুক্ষন পর পলাশ ভাবল, সত্যিই তো, নন্দিতার নিজের ভাল ভাবে বাঁচার সম্পূর্ণ অধিকার আছে | ওর মতো একটা নিভন্ত প্রদীপ, যে নিজেই অন্ধকারে, সেখানে নন্দিতাকে টেনে অন্ধকারে ঠেলা তো সত্যিই উচিত নয়, আর পলাশও চায় না নন্দিতার জীবনটা এভাবে শেষ হোক, তার থেকে এই ভাল | কালই ফোন করে নন্দিতাকে বলে দেবে যে যদি ওর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তবেই ও নন্দিতাকে বিয়ের কথা ভাববে, তা না হলে নন্দিতা যেন অন্য কাউকে বিয়ে করে ভাল থাকে | এসব এলোমেলো চিন্তার ভিড়ে ঘুমে জড়াল পলাশের ক্লান্ত চোখ দুটো |
||৬||
কিছুদিন যাবৎ নন্দিতাকে বড় অচেনা লাগছে পলাশের | পলাশকে নিয়ে বাড়িতে হুলুস্থুলু এখন, ডাক্তার ঠিক করা, টিকিট কাটা,এপয়েন্টমেন্ট ,সবাই পুরোটা নিয়ে বড্ড ব্যস্ত | ওর সমস্ত কাছের মানুষগুলোর মধ্যে একমাত্র নন্দিতা ই যেন এড়িয়ে চলছে পলাশকে, শারীরিকের সঙ্গে সঙ্গে তাই মানসিক অবস্থাও ভাল নয় পলাশের | যে মানুষটাকে ও এত ভালবাসে, আজ সে-ই এরকম ব্যবহার ফিরিয়ে দিলো … |
***************
আজ রওনা হচ্ছে পলাশরা ভেলোরের উদ্দেশ্যে | এই কদিনে নন্দিতা ওর শরীরের অবস্থা জানা তো দূর, ওর সাথে স্বাভাবিক কতটুকু কথা বলেছে সন্দেহ | এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা হলো পলাশরা | সো সো করে রাস্তার ধারের গাছ পাতাগুলো পিছলে সরে যাচ্ছে পিছনে, তার সাথে সাথে পিছলে যাচ্ছে পলাশের ভাবনাগুলোও, থই পাচ্ছে না তারা, ভীষণ রকম বিভ্রান্ত লাগছে আজ নিজেকে | নন্দিতা কে চিনতে এতটা ভুল হলো পলাশের? মা বাবাই কী ঠিক বলেছিলো তাহলে?.. নাহ, আর পারছে না, একটু চোখ বুজল পলাশ | মনে মনে ভাবল, সারাজীবন না থাকলে অন্তত শেষ কটা দিন পাশে থাকার প্রয়োজনীয়তা টাও অনুভব করল না? ভালবাসলে কেউ হয় এরকম স্বার্থপর?
||৭||
(কিছুদিন পর)
ভেলোর পৌঁছে কটাদিন কেটে গেছে পলাশদের | এখানে আসার পর থেকে নন্দিতার একটি ফোনও আসেনি | আজ ডাক্তারের চেম্বারে যাওয়ার কথা, বেরনোর আগে ফোনটা বৃথাই চেক করে বেরিয়ে গেল পলাশ |
**************
(ডাক্তারের চেম্বারে)
“আপনারা কলকাতায় কোন ডঃ-এর আন্ডারে দেখিয়ে ছিলেন? আর টেস্টগুলো কোথা থেকে করিয়েছিলেন?” ডঃ নায়ার প্রশ্নটা ছুঁড়লেন সামনে |
“কেন? মানে….. “সমস্ত ডিটেলস ডঃ নায়ারকে জানাল পলাশের বাড়ির লোক | তাহলে কী আর কোন আশা নেই? বৃথাই হলো এখানে আসা? এসবে রীতিমত শঙ্কিত পলাশের বাবা দাদার কন্ঠস্বর | পলাশ এখানে নেই, ও বাইরে, পলাশের মা আছেন সেখানে | সবার চোখেই হারানোর তীব্র একটা ভয় | পলাশের নিজের চোখেই যেন এক অন্য ইঙ্গিত, নিজের ভালোবাসাকে হারানোর ভয় যেন নিজের প্রাণ হারানোর ভয়ের থেকেও বেশি করে প্রভাব বিস্তার করেছে |
ডঃ নায়ার আশ্বস্ত করে বললেন,”এত ঘাবড়াবেন না, আসলে সাধারণ মানুষের তো আইডিয়াই নেই, কী ঘটে চলেছে এখন হাসপাতাল, নার্সিংহোম গুলোতে | তাও ভাল আপনারা এই অবধি এসছেন, সবাই তো তাও করে না | পলাশ সম্পূর্ণ সুস্থ, ওর শরীরে কোন ক্যান্সারের চিহ্নই নেই | আপনাদের রিপোর্ট সম্পূর্ণ ভুল |”, বলে এখনকার নতুন সমস্ত রিপোর্ট পলাশের বাবা দাদার হাতে তুলে দিলেন ডঃ নেয়ার |
নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছেন না যেন এরকম অবস্থা ওদের, আরও একবার যেন মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল যেন, তবে এটা স্বস্তির | এতগুলো দিন কী সাংঘাতিক দম বন্ধ করা পরিবেশে কেটেছে একমাত্র যার হয় সেই জানে |
বিকাশ আরেকবার জানতে চাইল,”আপনি সিওর?”
-“২০০%, আপনাদের ডাউট হওয়াটাই স্বাভাবিক, আর একবার চাইলে আপনারা টেস্ট করাতে পারেন |”
পলাশ যখন সবটা শুনল, তখন গলার মধ্যে দলা পাকানো কষ্টটা যেন এক নিমেষে মিলিয়ে গেছে, যেন একরাশ শান্তি | উফফ, এবার তো নন্দিতাকে হারাতে হবে না, ব্যস এটুকুই মাথায় ঘুরছিলো বারবার | উচিত অনুচিতের ব্যবধান, ঠিক ভুলের বিচার সবকিছুই গুলিয়ে গেছে এখন |
তড়িঘড়ি নন্দিতাকে ফোনটা লাগল পলাশ | নাহ, এবারও ধরল না নন্দিতা, ফোনটা বেজে বেজে কেটে গেল আবারও |
||৮||
নন্দিতার এসএমএস টা হাতে নিয়ে দেখছে পলাশ, কাঁদবে না হাসবে, খুশি হাওয়া উচিত নাকী দুঃখী কিছুই বুঝতে পারছে না ও | এসএমএস টার সারমর্ম এই, যে তোমায় ভালবাসা বা তোমার সাথে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয় | তুমি নিজেই নিভু নিভু, তাই সুন্দরী প্রেমিকার মায়া ত্যাগ করো আর প্রেমিকা যখন অন্যকারো হাত ধরতে চাইছে, বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চাইছে তখন আর দয়া করে ব্যাগড়াটা দিয়ো না | আগে তুমি ছিলে তোমার টাকা ছিল, এখন তুমিই নেই তো টাকার রাস্তাও নেই | অতএব আর ফোন না, এবার তুমি এস | এই হলো এসএমএস-এর মোদ্দা কথা |
**************
সামনের খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে পলাশ ভাবছিলো, এই কর্কটের রূপ ধরে যেন স্বয়ং ভগবানই ওর চোখে দেখিয়ে দিল ওর জীবনের আসল কর্কট কে? যে শুধু ওকেই না, ওর পরিবারকেও হয়তো রেয়াত করত না |
***************
হ্যাঁ, একটা ছোট্ট এসএমএস করে সব সম্পর্কের মোহত্যাগ করেছে পলাশ, “নকল কর্কট আমায় আমার জীবনের সারসত্যটা বুঝিয়েছে নন্দিতা | ভাল থেকো, আমি সম্পূর্ণ সুস্থ, আমার কিছুই হয়নি….|”
এরপর নন্দিতার বহুবার ফোন, এসএমএস আসলেও এই প্রান্ত থেকে আর কখনো কিছু যায়নি….কর্কট যেন বাঁচিয়ে দিয়ে গেল পলাশকে…ভাগ্যিস !…