।।১।।
মিষ্টির থালাটা তুলে নিয়ে উঠল রাই । দেওয়ালে তখনও ভাতৃদ্বিতীয়ার চন্দনের ফোঁটাটা শুকোয়নি । অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে ছিল রাই । এই নিয়ে কতগুলো বছর পেরিয়ে গেল… চোখের কোণে জলটা মুছে নিয়ে চলে গেল রাই ।
****************
এখন আস্তে আস্তে উত্তুরে হাওয়াটা বইতে শুরু করেছে, বারান্দায় দুপুরে কাজ সেরে একটু বসে রাই । এই সময়টা ওর একান্ত আপন, ওর নিজের, পুরোনো অ্যালবামটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল, সাদা কালোর দুনিয়ায় নিজেকে হারিয়ে ফেলছিল একটু একটু করে……
-“দাদা, এই দাদা।”
-“ষাঁড়ের মতো চেল্লাচ্ছিস কেন, বল না কী বলবি?”
-“তুই চল আমার সাথে ।”
-“পারছি না, যা এখন এখান থেকে, ভাইটাল ম্যাচ চলছে ।”
-“যাবি কী না ?”
-“বললাম তো পারব না ।”
-“তাহলে পাশের পাড়ার কুশল ছেলেটাকে তুই কিছু বলবি না তাই তো ?”
প্রসঙ্গত, কুশল ছেলেটা রাইকে খুব বিরক্ত করছিল ক’দিন ধরেই, ব্যাপারটা রণজিৎ-এর কানে পৌঁছতেই কুশলের হাত পা-টা ভাঙতে বাকী রেখেছিল শুধু ।
……………… ভাবতে ভাবতেই নিজের মনে হেসে উঠল রাই, এখনকার এক সন্তানের মা, তখনকার এক কিশোরী, তখন কত ভালো ছিল দিনগুলো । কিছু হলে মুখ গুঁজে কাঁদার জন্য ঠাম্মার কোল ছিল, মা-র নিবিড় আশ্রয় ছিল, বাবার হাত ছিল মাথার উপর, আর সবশেষে নিজের প্রাণের থেকেও প্রিয় দাদা ছিল পাশে । আর আজ সবথেকে প্রিয় মানুষটাই আর পাশে নেই ।
আঁধার নামছিল, এখন তো বেলা ছোট, ঘরে ফিরছিল পাখিগুলো, আকাশটা সোনালী, পশ্চিম দিকটা রক্ত লাল আবিরে মোড়া, অ্যালবাম-এর ছবিগুলো বারবার রাইকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে অতীতে । ঐ যে রাস্তা দিয়ে সব ফিরছে, ওরাও তো এরকম আনন্দ করতো, আচ্ছা ঐ যে একবার রাই আর দাদা কানামাছি খেলতে খেলতে একবার ধাক্কা দিয়ে দিয়েছিল রাইকে ওর দাদা না বুঝতে পেরে, রাই সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পুরো মাথা ফেটে কী অবস্থা, জ্ঞান আসতে শুনেছিল দাদা সারারাত হাসপাতালে বসে শুধু কেঁদেছে । সেই নিয়ে দাদাকে কম খ্যাপাত ও? “এবাবা, ছেলেটা কেমন কাঁদে, ছি ছি…”, এরকম কতবার বন্ধুদের সামনে দাদার লেগপুল করেছে ও । তখনকার দিনগুলোই ভাল ছিল । উঠে পড়ল রাই । আজ ও বাড়িতে একাই, মেয়ে আর স্বামী গেছে ওর ননদের বাড়ি, ভাইফোঁটার আয়োজন ওখানেই হয় বরাবর । রাই-এর এই দিনটা একটু একা থাকতে ইচ্ছে করে । ভাবনা থামিয়ে নিজের কাজে মন দিল রাই, তখন বাড়িতে বাড়িতে শাঁখ বাজছে ।
।।২।।
“মা, টুনি লাইটগুলো আজকে খুলতে হবে না, প্লিজ, আরও ক’টা দিন থাকুক ।”, মায়ের কাছে বসে বকবক করছিল তিতলি, রাই-এর একমাত্র সন্তান, এখন ক্লাস সেভেনে পড়ে । কিছুক্ষণ আগেই ওরা ফিরেছে । তিতলি ঝলমলে হাসিমুখ নিয়ে মাকে দেখাতে ব্যস্ত কী কী গিফ্ট পেল, রাই-ও মেয়ের দিকে তাকিয়ে ভাবছিল, কী এমন ভুল করল ও, যে সব এইভাবে পাল্টে গেল? রাই-এরও তো এভাবে আনন্দ করার কথা আজকের দিনটায়, কিন্তু…. । নাহ, আর ভাবতে পারছে না ও, কাল আবার তিতলির স্কুল, বিজয়ের অফিস । বিজয়ের এখন অফিসে কাজের অনেক চাপ, ভগবানের দয়ায় এখন ওদের সংসারটা স্বচ্ছল, আগের অর্থ কষ্টটা এখন অনেকটাই মিটেছে । বিজয় এখন বড় ইনকাম ট্যাক্স অফিসার । আগে সামান্য কেরানীর চাকরি নিয়েই ঢুকেছিল, সেই জন্যই এই ‘অযোগ্য’ পাত্রকে রাই-এর বাড়ির লোকজনের খুব একটা পছন্দ হয়নি ।
।।৩।।
খবরের কাগজটা রেখে চা-এর কাপটা তুলে চুমুক দিল বিজয় । চা খেতে খেতেই ফোন এল বিজয়ের । হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল কিছুক্ষনের মধ্যেই । ওর এটা এখন ডেইলি রুটিন হয়ে গেছে, আজ এখানে কাল ওখানে ।
*****************
বিজয় আর রাই-এর ভালবাসার বিয়ে । বিয়ের এত বছর পরও টান কমেনি বরং বেড়েছে । বিজয় বেরিয়ে যেতে ঘরের কাজগুলো সারছিল রাই ।
ধুলো ঝাড়তে গিয়ে ওদের বিয়ের ফটো-ফ্রেমটা হাতে নিল রাই, সবার সাথে তোলা গ্রূপছবি । ভাল করে মুছে ফটোটার দিকে চেয়েছিল রাই, সবাই আছে ছবিটায়, দাদা ছাড়া । এত রাগ তোর? এত অভিমান? বোনকে একবার আশীর্বাদও করেনি । বিয়ের কোন অনুষ্ঠানে ছিলি না তুই । ছবিটার ওপর কয়েক ফোঁটা নোনতা জল পড়ল, তাড়াতাড়ি মুছে নিল রাই । দাদা কেমন আছে কে জানে?
****************
-“দাদা, আমার পছন্দ নিয়ে কী তোর doubt আছে?”
-“বাজে কথা বলিস না ।”
-“না, আমার জানাটা দরকার, বল, doubt আছে?’
-“আরে বোঝার চেষ্টা কর, ও একটা সামান্য কেরানী, আর সায়ন, কত বড় বিজনেস, ব্রাইট ফিউচার, বি প্রাকটিক্যাল রাই, বোকামো করিস না ।
-“দাদা আমার কাছে টাকা আর স্টেটাস-এর থেকে মানুষটা বেশি ইম্পরট্যান্ট, আর আমি ওকে ভালবাসি, তাহলে এত কথা আসছে কেন?”
-“সংসারে অভাব ঢুকলে প্রেম জানলা দিয়ে পালাবে, এত বড় বড় কথা তখন কোথায় থাকে দেখব, হুহ… ।”
-“তুই কিন্তু এবার আমার বেসিক পছন্দ নিয়ে প্রশ্ন তুলছিস, আর আমার লাইফ আমি বুঝে নেব, এত কথা বলছিস কেন? যেখানে মা বাবাও রাজী হয়ে গেল শেষ পর্যন্ত ।”
-“বেশ, যা খুশি কর না তুই, আমি এসবের মধ্যে নেই ।”
-“ওকে, আমার বিয়েতেও থাকিস না তাহলে ।”
বেশ কিছুক্ষনের নিস্তব্ধতা….তারপর,”বেশ, তাই হোক ।”, এই তিনটি শব্দ বলে চলে যায় রণজিৎ ।
একটা ঝাঁকুনিতে অতীত থেকে বর্তমানে টেনে আনল রণজিৎকে । ট্যাবে ফটো স্ক্রল করছিল রণজিৎ, বোনের বিয়ের ছবিগুলো । রাই-টা কেমন আছে কে জানে? ভাগ্নী হয়েছে শুনছিল । কিন্তু না, এখনও কোন কথা বলে না এরা । ইগো, অভিমান মিলে ভালবাসা, ভাইবোনের টানের থেকেও যেন বড় হয়ে যাচ্ছিল, তাই আপন ভাইবোন হয়েও আজ ওরা এত দূরে । আজ বহু বছর পর দেশে ফিরছে রণজিৎ, নিজের বাড়িতে । উপলক্ষ, অবশেষে বিয়ে করতে রাজী হয়েছে ও, তাই এবার বিয়ে উপলক্ষে অবশেষে ওর বাড়ি ফেরা ।
।।৪।।
(বেশ কয়েকদিন পর)
আজ সকাল থেকে বড় তাড়াহুড়ো চলছে রাই-এর, বিজয় তো এসব ব্যাপারে কিছু বলেও না, কনফিডেনশিয়াল ব্যাপার । বিজয় তাই আজ খুব তাড়াতাড়িই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে ।
“উফফ, সকাল থেকে খালি একবার টিভিটা দেখ, টিভিটা দেখ, সব ping করেই চলেছে, কী হয়েছেটা কী? বলতে বলতেই টিভিটা চালাল রাই । নিউজ চ্যানেলগুলো সার্ফ করতে করতেই চোখ আটকাল রাই-এর ।
এ কী দেখছে ও ! হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল রাই । টিভিতে বিজয়কে দেখাচ্ছে, একটা বিশাল বড়সড় রেড-এ সাকসেসফুল আজ এই অফিসার । আনন্দে, গর্বে চোখে জল এসে যায় রাই-এর এই মুহূর্তগুলোয়, ও কোন ভুল করেনি বারবার এটা চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করে ওর, কিন্তু বিজয়কে তো মিডিয়া, প্রেস-এ এর আগেও দেখিয়েছে, কিন্তু এ কে? থমকে দাঁড়াল রাই । এ কাকে দেখছে ও । মিঃ সায়ন বসাক । ইনকাম ট্যাক্স, ব্ল্যাক মনির আইনি জটিলতায় আজ তার মাথা হেঁটে ক্যামেরার সামনে । এই সেই সায়ন? হ্যাঁ তাই-ই তো । পুলিশের ভ্যানে করে নিয়ে চলে গেল । হ্যাঁ, এই-ই যাকে রাই বিয়ে করতে ‘না’ বলে দিয়েছিল, বিজয়কে ভালবেসে । এর থেকে বড় জিৎ আর কীই বা হতে পারে?
******************
-“হ্যালো, হ্যালো, কে বলছেন…?”
ওপাশ থেকে কোন শব্দ নেই, তবে কেউ ধরে আছে, নিঃশ্বাসের শব্দ শুধু । রাই আবার বলল, “হ্যালো”, এবার যেন ওপ্রান্তের গলার আওয়াজটা কানে গেল রাই-এর । নাহ, ওর চিনতে ভুল হয়নি, এই গলা ওর বহুদিনের চেনা, সেই মানুষটার যে ওর খুব খুব কাছের, ওর একান্ত আপন, ওর নিজের দাদা ।
কষ্টে, আনন্দে গলাটা বুজে আসছিল রাই-এর । কিচ্ছু বলার ক্ষমতা ছিল না ওর, ওপাশেও একই অবস্থা, কিছু বলার ভাষা নেই, হয়তো বা শব্দের প্রয়োজনও নেই, গলছিল এভাবেই কত বছরের মান অভিমান-এর বরফ, ইগো-এর লড়াই ।
আর নিজেকে আটকাতে পারল না রাই, “দাদা” ।
কত্ত কত্ত বছর পর এই ডাকটা ডাকল ও, ওপাশের মানুষটাও আজ কত কত দিন পর এই ডাকটা শুনতে পেল । চোখের জল নিঃশব্দে নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়েই যাচ্ছে ।
-“আমি দেশে ফিরেছি, আসবি তো বাড়িতে?”
বহু বছর পর আবার ভাইবোনের কথা জমে উঠল, চোখে খুশির জল ।
-“ক্ষমা করে দিস আমায়, তোর পছন্দ সঠিক ছিল, আমিই চিনতে পারিনি….।”
-“ওসব ছাড়, কখন তোকে দেখব দাদা?….” এমন টুকরো টুকরো কথার সাক্ষী রইল বারান্দার সেই টুনিগুলো ।
******************
(একবছর পর)
সব বাড়ির মতো আজ রাই-এর বাড়িতেও একই সুর, তবে এবারে আর দেওয়ালে নয়, …..”ভাই-এর কপালে দিলাম ফোঁটা…. যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা ।”