” বেলটা বাজছে দেখ ওরা বোধহয় চলে এলো”-
ফ্ল্যাটে একটা ছোট্ট পার্টি আয়োজন করেছে শতাব্দী, ওর আর সৌগতর Anniversary উপলক্ষে | তাই জোগাড়ে ব্যস্ত শতাব্দী, সৌগতকে দরজাটা খুলতে বললো | ঘনিষ্ট কিছু বন্ধু বান্ধবীকে আসতে বলেছে | আর আশপাশের ফ্ল্যাটের কিছু জনও আমন্ত্রিত |
ওদের পাশের ফ্ল্যাটে নতুন এসেছেন মিস নীহারিকা রায় | নামপ্লেটে এ লেখা বলে তাও মিস না মিসেস বোঝা গেলো, নয়তো চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই বিবাহিত, নাকি অবিবাহিত, নাকি বিধবা, নাকি ডিভোর্সী | আশপাশের ফ্ল্যাটের মালাদি, জয়াদির কাছে কানা ঘুঁষো শুনছিলো শতাব্দী |
মহিলা নাকি খুব ধুরন্ধর | খুব একটা সুবিধের না | তার কথাবার্তা চালচলনই কেমন অন্যধারা | শতাব্দীর এখনো সরাসরি আলাপের সুযোগ হয়নি, তাই এই পার্টিতে নিমন্ত্রণও করেছে, দেখায় যাবে মহিলা কেমন |
এসব ভাবনার মাঝেই মালাদি, জয়াদিরা সব চলে এলো, একটা নতুন কাজের মেয়ে রেখেছে শতাব্দী, লবঙ্গ | ৯-১০ বছর হবে | ওকে শিখিয়ে রেখেছে সবাই এলে যেন কেউ খালি হাতে না থাকে, সবার হাতে হাতে খাবার দিতে থাকে যেন |
মালাদি জয়াদির সাথে একটু কথা বলতে বলতেই লবঙ্গ বললো,” দিদি, কোন বাসন বের করবো গো? বাসন যে সব সগড়ি |”
শতাব্দী-“উফফ! তোকে ওসব বের করতে বলিনি, যা এঁটো বাসন গুলো মেজে ফ্যাল, আর গেস্টদের জন্য ডিনার সেট বের করে নেবো |” বলেই আবার কথা বলতে লাগলো শতাব্দী | মালাদি বললো মিস রায় কে না ডাকলেই পারতে | মহিলা সুবিধের নয়, কখন কি ঝামেলা করে |
শতাব্দী অবাক হয়ে বললো,” তোমায় এসব কে বললো?”
মালাদি,” আরে আমার বর আর মিস রায় একই অফিসে কাজ করে আলাদা ডিপার্টমেন্টে | আমার বরই বলছিলো, মহিলা খুব বড় পোস্ট হোল্ড করে, খুব মুখকাটা, সুবিধের নয়, আবার ডিভোর্সিও |”
শতাব্দীরা সবাই সেটা শুনে “এবাবা”, “ইস..”, “ওবাবা” এসব বিশেষণ প্রয়োগ করে উপহাস করতে লাগলো |
“কি রে লবঙ্গ, বাসন মাজা হলো তোর? সবাই তো আসতে শুরু করে দিলো”, “আমাদের কফি গুলো দিয়ে যা | – শতাব্দী
” আচ্ছা দিদি”, হাঁপাতে হাঁপাতে কফি নিয়ে হাজির হলো লবঙ্গ ছোট হাতে |
“ঠিক আছে যা’ সবাই আস্তে থাকলে সবার হাতে কফি গুলো সার্ভ করবি, আর আমি সেট গুলো বের করে রাখছি, ওতেই সবাইকে খাবার দিবি |”
“আচ্ছা দিদি”, ছোট্ট লবঙ্গ বিনুনি দুলিয়ে মাথা নাড়লো | ছোট্ট লবঙ্গ জানে না এটা কিসের পার্টি, ও তো সবার পোশাক হাঁ করে দেখছে | দেখছে আর কচি মনে ভাবছে- ” আহা ! কি সুন্দর পোশাক গো | কতই না দামি | আমি তো এমন পোশাক কখন দেখিইনি | কি সুন্দর সুন্দর খাবার আনানো হয়েছে হোটেল থেকে, কি ভালো গন্ধ তার | যদি একবার চেখে দেখতে পেতুম, ভেবেই জিভে জল এসে যাচ্ছে লবঙ্গর |” মাছ খেতে খুব ভালোবাসে লবঙ্গ, কিন্তু গরিবের আবার ইচ্ছে | নুন আন্তে পান্তা ফুরোয় সেখানে দিবাস্বপ্ন দেখে কি লাভ? লবঙ্গ ছোট হাতে কাজ করতে লাগলো আর মায়া ভরা চোখে পার্টির জাঁক জমক দেখে অবাক হতে লাগলো |
রাত বাড়তে লাগলো, পার্টি শেষের পথে, কিছু অতিথি চলেও যাচ্ছেন খাওয়া শেষে | লবঙ্গ একটু অন্যমনস্ক ছিল | ছোট হাতে এতো ভারী প্লেট আনা নেওয়া করতে বড় কষ্ট হচ্ছিলো | হঠাৎই হাতটা ফস্কে গেলো | শব্দ পেয়েই শতাব্দী ছুটে এলো, ” ব্যস করে ফেললি কাজ? এতো দামি প্লেট ভেঙে ফেললি তো ? এতবার করে সাবধান করলাম, কত দাম জানিস এগুলোর? এক পয়সা পাবি না এমাসে | যা সাফ কর তাড়াতাড়ি , লোকজনের পায়ে লেগে নয়তো আরেক কীর্তি হবে | যা সাফ কর |”
ভুল হয়ে গেছে দিদি, মাইনে কেটো না গো, ছোট্ট ভাইটার খুব অসুখ | বলেই কান্নায় ভেঙে পড়ে লবঙ্গ | “নাকি কান্না থামিয়ে কাচের টুকরো গুলো পরিষ্কার কর যা |”
***************
লবঙ্গ কাচের টুকরো গুলো তুলতে লাগলো কাঁদতে কাঁদতে | এমন সময় এক দিদি এসে বললো, ” কাচের টুকরো গুলো ফেলে দাও আর চোখ টা মোছো “| লবঙ্গ হাঁ করে তাকিয়ে রইলো, দিদি আবার বললো, ” ওগুলো ফেলে চোখটা মুছতে বলছি, হাতে কাঁচ ফুটে যাবে, সরে এস | লবঙ্গ চোখ মুছে নিলো ,” কিন্তু…..” | “চুপ, আমি কথা বলছি তোমার দিদির সাথে, তুমি ছোট, তাই মাঝে কথা বলবে না |”
” excuse me , মিসেস শতাব্দী দত্ত |” নিজের নামটা কানে যেতেই পার্টিতে মত্ত শতাব্দী ঘুরে তাকালো |
” আরে মিস রায় ! প্লিজ ভেতরে আসুন, এতো দেরি করলেন আসতে, আমি ভাবলাম আসবেনই না , আপনার সাথে আলাপই হয়নি |” – শতাব্দী |
নীহারিকা-,” একটা মিটিং ছিল তাই দেরি হলো |”
শতাব্দী লবঙ্গর দিকে তাকিয়ে,” কিরে তুই এখনো এগুলো তুলিসনি?”
নীহারিকা-” আমিই ওকে বারণ করেছি, ও অনেক ছোট, এটা ওর কাজ নয় মিসেস দত্ত | আপনার এরকম insensitive ব্যবহারটা কিন্তু আমি আশা করিনি |
শতাব্দী রেগে গিয়ে,” মানে? কি বলতে চাইছেন আপনি?”
ততক্ষনে কথা শুনে ফ্ল্যাটের ভেতর উপস্থিত সবাই তাকিয়ে কি হয়েছে সেটা দেখবার জন্য |
নীহারিকা -“আমি স্পষ্ট কথা বলতেই পছন্দ করি, আপনি জানেন এই কাজের জন্য আপনার শাস্তিও হতে পারে? ওর ও তো শিক্ষা পাওয়ার অধিকার আছে, শৈশব টা ভালোভাবে কাটানোর অধিকার আছে, সামান্য প্লেট ভেঙেছে বলে টাকা কাটবেন হুমকি দিচ্ছেন,আর কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করছেন লোকদেখানো আদিখ্যেতা করে নাম কেনার জন্য |তার থেকে দুটো পয়সা থাকলে ওটা ভালো কাজে লাগান না |”- নীহারিকা |
শতাব্দী- ” দেখুন আপনি কিন্তু আমায় অপমান করছেন |”
নীহারিকা হেসে বললেন, ” আপনার মানের হুঁশ আছে তাহলে | থাকলে এটুকু একটা বাচ্চাকে এভাবে বলতেন না | এটা করা উচিত, এর এটা ঠিক, এটা ভুল এসবই বলবেন ,না নিজেও দায়িত্ব নিয়ে কিছু করবেন? সবাই যদি ভাবে আর একজন করবে তাহলে তো খুব মুশকিল, নিজেও নিন কিছু দায়িত্ব |”
ঘর জুড়ে নিস্তব্ধতা , শতাব্দীর মাথা নীচু , সাথে আরো অনেকেরও |
নীহারিকা ছোট্ট লবঙ্গর দিকে তাকিয়ে বললেন, ” আমি ওকে নিয়ে গেলাম | আমি চলে যাওয়ার পর আমার সম্পর্কে আরো কিছু কুট কাচালি পারলে করে নিন | তাতে আমার কিছু যায় আসে না |” বলে নীহারিকা লবঙ্গ কে নিয়ে বেরিয়ে গেলো |
এভাবেই সপাটে চড় পড়লো কিছু তথাকথিত ভদ্র মানুষের গালে, যারা সমাজের liberty-র কথা বলে | কিন্তু দায়িত্ব নিয়ে সমাজকে আরো অন্ধকারে ঠেলে দেয় | এবার দয়া করে একটু না হয় মানুষ হই আমরা , দায়িত্ব নি আমরাও |