আজ, আরও একবার, না, কোন গল্প নয়, বেশ কটা কথা বলতে চাইছে মনটা। প্রতিবাদ করতে লেখার আশ্রয় ছাড়া আর উপায় কী?
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে, মানে, খাওয়া, ঘুম, ওঠা, বসা, প্রেম, মা-বাবা, এসব কিছুর সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে একটা শব্দ, যেটা আজ থেকে ২০-২৫ বছর কী, ১০-১৫ বছর আগেও এতটা শোনা যেত না। ‘ধর্ষণ’, হ্যাঁ, এই একটা শব্দ, যেটা খবরের কাগজ খুললে, বা না খুললেও, টিভি, স্মার্ট ফোনের দৌলতে দিনে একবার অন্তত আমাদের কানে আসবেই।
ধর্ষণ করে খুন, বা তার আরও কিছু সমার্থক শব্দ, শ্লীলতাহানি, কোন না কোন শব্দ থাকেই। শুধু তাই নয়, এরপর যুক্ত হয় তার নৃশংসতার মাত্রা, পারদ চড়তে থাকে একটার উপর আর একটার। আমরা খবরটা পড়ি, গা শিউরে ওঠে ঘটনার ভয়াবহতায়। আলোচনা চলে বন্ধু বান্ধব কিছু কলিগদের মধ্যে। ব্যস, আবার যে যার কাজে।
এখন কথা হলো, কবে বন্ধ হবে এই নারকীয় অত্যাচার?
না, কোন ভবিষ্যদ্বাণী আমাদের জানা নেই, কিন্তু এটুকু জানা আছে, এভাবে কটা আলোচনা আর খবর পড়ে আবার কাজে মন লাগালে আজ দেশে পাঁচটা ধর্ষণ হলে, পরদিন ১০টা হবে। সংখ্যাটা বাড়বে, বাড়ছেও, কমবে না অন্তত।
এখন প্রশ্ন হলো ধর্ষণ কেন হচ্ছে?
না, কোন ড্রেসকোডের থিওরিতে আমি বিশ্বাসী নই। তাই কারণ হিসাবে খুঁজতে গেলে আমার কাছে এই মুহূর্তে দুটো উত্তরই আসছে।
প্রথমত, ধর্ষক বাইরের কোন গ্রহের লোক নয়। আমার, আপনার বাড়িরই কোন ছেলে। এবার জন্মের সময় সে ধর্ষক তকমা নিয়েও জন্মায় না। কিন্তু বড় হয়ে আপাত দৃষ্টিতে সাধারণ দেখতে একটা ছেলেই অমানুষ-এ পরিণত হচ্ছে। তার দায় তার বাড়ি, তার পরিবার, মা বাবা এড়াবে কী করে? ছোট বয়স থেকে মেয়েদের সম্মান করার শিক্ষা যদি সে বাড়ি থেকে না পায়, যদি রোজই দেখে তার বাবা, কাকা, দাদা, তাদের জীবন সঙ্গিনীর উপর অত্যাচার করছে। অথচ প্রতিবাদ করার কেউ নেই, সে তো সেটাই ঠিক ভাববে। একজন শিশু তার মা বাবাকে দেখেই শেখে। সেখানে যদি কোন শিশু একটা অসুস্থ পরিবেশেই বড় হয়, তাহলে তার চরিত্র গঠন হওয়াটা কী আদৌ সম্ভব? বা, বাড়িতে তার কাকা, দাদা কোন ঘৃণ্য অপরাধ করেছে, আর উল্টোদিকে তারই মা, সেই অপরাধী কাকা, বাবা দাদাকেই বাঁচাতে ব্যস্ত, ধামাচাপা দিতে ব্যস্ত, তখন সেই ছেলেটা এর থেকে কী শিক্ষা পাবে?
তাই, আজকে সারা দেশ জুড়ে যখন এই অন্যায় অত্যাচার বেড়ে চলেছে, তখন সেটাকে বদলানোর দায় কিন্তু আমাদের সবার। আর বদলের সূত্রটা কিন্তু একদম গোড়াতেই।
আরও একটা বড়সড় সমস্যা রয়েছে গোড়াতেই। প্রতিটি ঘরে ঘরে আজ ছোট ছোট বাচ্চাদের হাতে তাদের মা বাবা নির্দ্বিধায় মোবাইল তুলে দিয়েছে। এবার সেই মোবাইল এ নেটটা থাকলেই, ব্যস, ওয়েবসিরিজ, ভিডিও সব হাতের মুঠোয়। কৈশোর জীবনে যেখানে ঠিক ভাবে মনটা সুগঠিতই হয় না, সেখানে মন অনেক বেশী কিছু দেখে ফেলে। সে বোঝে না কোনটা ঠিক কোনটা ভুল, সেটা বোঝানোর দায়িত্ব কিন্তু তার বাড়িরই।
খুব কী দরকার মোবাইল অত ছোট বয়স থেকে? তাই এদিকটাও কিন্তু মা বাবার দেখাটা দরকার। সঠিক চরিত্র গঠন, সঠিক শিক্ষার জন্য এটাও কিন্তু জরুরি।
দ্বিতীয়ত, প্রতিবার নৃশংস অত্যাচারের বর্ণনা শুনে আমরা কী করি? হ্যাঁ, আমার প্রশ্ন, আমরা আদৌ কী কিছু করি?
না, আমি বলছি না, ধর্ষিতার পাশে গিয়ে আহা উহু-র কথা। কিন্তু আমাদের দেশটা তো গণতান্ত্রিক। আমরা জনগণ যদি চাই, সত্যিই যদি চাই, আমাদের বিচার ব্যবস্থা, আইন কী তার ধারা বদলাতে পারে না? নিশ্চয় পারে। কিন্তু, আমরা গা করি না। যতদিন না নিজেদের ঘরে ঘটছে আমরা কেউ পাত্তা সত্যিই দিই না। এটাই তো বন্ধ করা দরকার।
যে এই নৃশংসতা দেখিয়েছে, আইনের সাহায্যে তাকে সারা দেশ এমন শাস্তি দিক, যেন তারপর আর এই কান্ড ঘটানোর কথা ভাবতেও আত্মাটা কেঁপে ওঠে।
বছরের পর বছর ধরে বিচার চলাটা কোন কাজের কথা না। আমরা জনগণরাই পারি আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থায় বদল আনতে।এ কাজ একার নয়। সবাই মিলে না নামলে আমাদের দেশে আমাদের বিচার ব্যবস্থায় বদল কখনোই আসবে না।
এই নৃশংসতা দেখে কেন আমাদের মনে জিদটা চাপছে না যে,ব্যস অনেক হয়েছে এবার বন্ধ হোক। অনেক তো হলো, এবার পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়ে গেছে যে, তিল তিল করে যে যন্ত্রনা দিয়ে ঐ দুধের শিশুকে মারে ঐ পশু, সেই নরক যন্ত্রণার একটা অংশও কী বেঁধে না আমাদের শরীরে? এতটাই কি অমানুষ হয়ে গেছি? তাহলে কেন গর্জে উঠতে পারছি না এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে? বিচার পাওয়াটা তো আমাদের মৌলিক অধিকার, বেশী কিছু তো চাইনি। এটুকু করতে পারলেই ধর্ষক ধর্ষক হওয়ার আগে যেন পাঁচবার ভাবে। কোথাও কোথাও একগালে চড় মারলে আর একগাল বাড়িয়ে দেওয়ার নীতিটা খাটে না। এখানে নৃশংস অপরাধের শাস্তিও যে কত নৃশংস হতে পারে সেটা দেখানোর সময় এসে গেছে। এটা আমাদের করতে হবে। আমাদেরই লড়তে হবে। তাই, এখানেও দায়টা আমাদেরই। এবার আসা যাক, আরেকটু আলাদা প্রসঙ্গে। আমাদের সমাজে বিয়ের পর স্ত্রীকে স্বামীর ‘সম্পত্তি’ হিসেবেই গণ্য করা হয়। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটা বাড়িতে মা ঠাকুমারাও মেনে নিতে বলেন আর এই শিক্ষা দেন, “ও তো তোর স্বামী”।
এবার স্বামী হোক বা না হোক, ধর্ষণ তো ধর্ষণই। কিন্তু, এক্ষেত্রে কোন শাস্তি, নালিশ, প্রতিবাদের জায়গাটাই আমাদের সমাজে নেই, কেন?
সব থেকে দুঃখের বিষয়, এখন ধর্ষণ কাণ্ডে হিন্দু মুসলমান নিয়ে কড়চা করতে ব্যস্ত থাকে দুইপক্ষ। ধর্ষকের কী কোন ধর্ম হয়? কোন ধর্ম ধর্ষণ করার বাণী শোনায় যে আমরা ধর্ষণের মতো একটা চরম ঘৃণ্য অপরাধেও ধর্ষককে না দেখে আগে তার ধর্ম দেখি।
আমরা সবসময় পরের উপর নির্ভর করি, ও বলবে, ও করবে, ইত্যাদি। যেদিন প্রতিবাদটা, বদলটা নিজের মধ্যে থেকে আনতে পারব, প্রত্যেকে একমাত্র সেদিনই কিছু বদলানো সম্ভব। কবে কোন হিরো আসবে, তার অপেক্ষা না করে, বা ভগবান ওর বিচার করবে, সব দায়ভার ভগবানের কাঁধে না দিয়ে,শুধু অপেক্ষা না নিজের কাঁধে ও কিছুটা দায়িত্ব নিই না বরং সবাই।
সেদিন আর কোন আসিফা, কোন টুইঙ্কল-এর বলি হবে না। কোন নির্ভয়াকে অকালে ঝরতে হবে না। একদিন ঠিক সূর্য উঠবে, উঠবেই।