।।১।।
“আজ অফিস থেকে ফিরতে একটু লেট হবে ।” জুতো পরতে পরতে কথাগুলো বলছিল অর্ঘ্য, অর্ঘ্য চৌধুরী । দেবাংশী আর অর্ঘ্য এই দমদমের ফ্ল্যাটে এসেছে বছর খানেক । বিয়ের পর পরই এই ফ্ল্যাটটা নিয়েছিল ওরা । প্রায় বছর দেড়েক হলো ওদের বিয়ে । অর্ঘ্য বেরনোর আধঘন্টা পর প্রায় দেবাংশী বেরোয়, ফেরেও অর্ঘ্যর আগে । অর্ঘ্যর অফিস থেকে ফিরতে প্রায়ই লেট হয় এখন, প্রোমোশনের সাথে সাথে কাজের চাপ বেড়েছে, দায়িত্বও বেড়েছে, নিজের জন্য সময়টাও একই হরে কমেছে । ধূসর জীবনে ঝুপ করে কখন একাকিত্ব, হীন মন্যতা ঢুকে পড়েছে, থাবা বসাচ্ছে নিঃসঙ্গতা, ভার্চুয়াল জগতের কৃপায় বুঝতে একটু সময় লাগছে বৈকি । এখানেও তাই ।
অর্ঘ্য আর দেবাংশীর বিয়েটা অ্যারেঞ্জড । অর্ঘ্য দেবাংশীর ভাত কাপড়ের দায়িত্ব, দেবাংশীর সমস্ত প্রয়োজন মেটাবার দায়িত্ব হাসিমুখে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল । দেবাংশীর চাকরি নিয়েও কোনদিন কোন আপত্তি তোলেনি, সবথেকে বড় কথা, অর্ঘ্যর মা বাবা দেবাংশীকে সত্যি নিজের মেয়ের মতই দেখেন । নিজগুনে দেবাংশী একে একে সবার মন জয় করে নিয়েছে । অর্ঘ্য-রও ভাললাগা মন্দলাগা, অর্ঘ্য কী খেতে ভালবাসে, ছোটখাটো সমস্ত বিষয়ের উপরেই নজর থাকে দেবাংশীর ।
সবকিছুই একদম পারফেক্ট, একটা সংসারে সুখ শান্তির জন্য আর কী চাই । কিন্তু তাও, অর্ঘ্য দেবাংশীকে দেখে যতটা খুশি মনে হয় বাইরে থেকে, ঘরের ভিতরের গল্পটা তার থেকে অনেকটা আলাদা ।
।।২।।
শনিবার দেবাংশীর ছুটি থাকে, অর্ঘ্যর সপ্তাহে একদিনই ছুটি । আজ দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর একটু নিজের মত করে সময় কাটাচ্ছিল দেবাংশী । দুপুরের ঠাঠা পড়া রোদে খটখট করে বাইরেটা, কিন্তু ঘরের ভিতরটা বেশ ঠান্ডা ওদের । আয়নাটায় রোদ পড়ে প্রতিফলিত হচ্ছে সারা ঘরে, আলোয় আলো ঘরটা, আনমনা হয়ে ওদের বিয়ের ছবিটার দিকে তাকিয়েছিল দেবাংশী, ফোনের মেসেজ টোনে টনক নড়ল ।
-“কী গো কী করছ?”
-“কী আবার করব, একটু ভাত ঘুম দেব ভাবছি ।”
-“আর আমি এখানে খেটে খেটে মরছি, আর উনি দেবেন ভাতঘুম ।”
-“সে আর কী করা যাবে, যার যা কপাল, কাজ করো যায় ।”
-“সকাল থেকে যেটা বলতে বলছি, সেটা না বললে কাজ করব না ।”
-“উফফ, জ্বালিও না তো বাপু, কিছু বলতে পারবো না ।”
-“না, বলতেই হবে….”
বেশ খানিকটা খুনসুটির পর, অবশেষে, দেবাংশী লিখল, “ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি, শান্তি ? এতদিন হয়ে গেল এখনো তোমার পাগলামো গেল না, যাও কাজ করো ।”
দেবাংশী ফোনটা রেখে চোখ বুজল, পাশ ফিরে ঘুরতে যেতেই কাঁধে ব্যথা পেল, ওহ, কালশিটেটা এখনও আছে, ব্যাথাটা এখনও যায়নি, আস্তে আস্তে চোখ বুজল দেবাংশী ।
।।৩।।
বাড়ি ফিরতে আজ বেশ খানিকটা রাতই হলো অর্ঘ্যর । আসলে দেবাংশীর জন্য একটা সমুদ্র সবুজ রঙের শাড়ী কিন্তু গেছিল, সেটা কিনতেই আরো দেরী হলো, আগের দিন কথা কাটাকাটিতে ধাক্কাটা একটু বেশীই জোরে দিয়ে ফেলেছিল অর্ঘ্য, সারপ্রাইজ দিলে যদি ব্যাপারটা একটু ঠান্ডা হয় ।
******************
বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবছিল অর্ঘ্য, কেন জানি না, ওর সবসময়ই মনে হয় দেবাংশী যা কিছু করে ওর জন্য কোন কিছুতেই কোন খামতি থাকে না, কিন্তু, যেন ও ওর মন থেকে কাজগুলো করে না, যেন দায়িত্ব আর কর্তব্যের মোড়কে ঢাকা থাকে সেগুলো । মনের মানুষের জন্য মিষ্টি ভালোবাসার স্পর্শের খুব অভাব যেন সেখানে । পুরোটাই মনে হওয়া, এর বেশী কোন ভিত্তি নেই যদিও ।
আবোল তাবোল ভাবনার মাঝেই নিজের বাড়ি ততক্ষনে পৌঁছে গেছে অর্ঘ্য, ভাবনায় দাঁড়ি টেনে বাড়ি ঢুকল ।
******************
“আমিও এবার সবটাই জানিয়ে দিতে চাই, তুমি একদম চিন্তা কোরো না । হুম…” ফোনে কথা বলতে বলতেই দরজা খোলার শব্দে ফিরে তাকাল দেবাংশী ।
-“সরি গো, আজ অনেকটা রাত হয়ে গেল, একটু জল খাওয়াবে?”
-“হ্যাঁ, তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও, আমি সব দিচ্ছি ।”
-“আচ্ছা শোনো, এটা ধরো ।”
-“কী এটা?”
-“দেখোই না, তোমার জন্য আনলাম ।”
….প্যাকেটটা খোলার পর, দেবাংশী বলল, “শাড়ি ! হঠাৎ? কিন্তু আমি তো সবুজ রং ভালোবাসিনা ।”
-“তাতে কী? আমার খুব পছন্দের রংটা, তাই আনলাম, আর তোমায় দেখতে ভাল লাগবে । তোমার জন্য সেই অর্থে কখনো শপিং করার সুযোগ পাইনি, তোমার তাই কোনটা পছন্দ অপছন্দ জানি না তেমন ।”
দেবাংশী হেসে প্যাকেট আর ফোনটা রেখে রান্নাঘরে গেল ।
******************
বারবার ফোনটার টুংটাং শব্দে খানিক বিরক্ত হয়েই ফোনটার দিকে তাকাল অর্ঘ্য । কোন পাসওয়ার্ড জাতীয় কিছুই দেওয়া নেই, যেন পুরোটাই খোলা চিঠি । ফোনটা হাতে নিয়ে পড়তে লাগল অর্ঘ্য । ঘড়িতে সেকেন্ডের কাঁটা যত না এগোচ্ছিল তার থেকেও দ্রুত শক্ত হচ্ছিল অর্ঘ্যর চোয়াল, মেরুদন্ড দিয়ে যেন একটা চোরা স্রোত বয়ে যাচ্ছিল, কোন আবছায়া নেই, পুরোটাই খুব স্পষ্ট, শুধু অর্ঘ্য বুঝতে আর দেখতে দেরী করে ফেলেছে ।
।।৪।।
অর্ঘ্য আর দেবাংশী মুখোমুখি । শব্দের কোনো প্রয়োজন নেই, চোখই যেন সবটা বুঝিয়ে দিচ্ছে, অর্ঘ্যর মনের একরাশ জিজ্ঞাসা আর হতাশার, আর দেবাংশীর চোখে স্বীকারোক্তি ।
******************
-“আমি জানি, তুমি এখন এটাই ভাবছো, কেন? কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি তোমায় বলতেই চাইছিলাম, অনেকদিন ধরে । আমি নিজেও বুঝিনি, কবে এসব হয়ে গেল, কিন্তু আমি চেয়েছিলাম সংসার করতেই । তোমায় যেদিন প্রথম তোমার অফিস কলিগের সাথে রাতের আঁধারে আমার পাশে শুয়ে শরীরী কথাবার্তা বলতে দেখে ফেলেছিলাম, তারপর থেকেই তোমার ভালবাসার স্পর্শে আমার মনটা জাগত না, শরীরটা শুধু যন্ত্রের মতো কাজ করতো । তুমি হয়তো আমায় ভালবাসতে চেয়েছিলে, ভাল রাখতেও চেয়েছিলে, কিন্তু আমিই তোমায় আর ভালবাসতে পারিনি । জানি, তুমি বলবে ক্ষনিকের দুর্বলতা কখনো একটা সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে না, কিন্তু তার জন্য না, তোমার মধ্যে দায়িত্ব কর্তব্যের বাঁধা শিকল পেয়েছি, সেখানে কোন ভুল নেই, কিন্তু ভালবাসার ছোঁয়া কখনো পাইনি । তোমার বিচিত্র শরীরী চাহিদাটাও, শুধু যন্ত্রের মতো, যেখানে কোনো ভালবাসা নেই, আমার পক্ষে মেটানো সম্ভব হচ্ছিল না, খুব কষ্ট হতো । মাঝে মাঝেই শরীরের কালশিটগুলো, যেগুলো কিনা তোমার কথায় ছিল ভালবাসার চিহ্ন, জানান দিতে শুরু করলো সম্পর্কে পোঁতা শেষ পেরেকটার ।
তোমায় আমি সত্যিই কখনোই ভালবাসতে পারিনি, ভালবাসা কী বোঝার আগেই আরো অনেক জটিলতা বুঝতে হয়েছে ।
সৌম্যককে আমি ভালবাসি, হ্যাঁ, ভালবাসি । আমার আজ বলতে কোন দ্বিধা নেই, যে আমি ভালবাসি । এই সমাজ আমায় “নষ্ট মেয়ে, দুশ্চরিত্র” এসব বিশেষণ বলতে ছাড়বে না, তাও আমি জানি । কিন্তু ভালবাসার, ভালথাকার অধিকার তো আমারও আছে, তুমি তোমার মতো করে ভালো থাকতে শিখে নিয়েছো, আমি আমার মতো করে । আমি সৌম্যককে কেন ভালবাসি, জানি না । আমি তোমায় কেন ভালবাসতে পারিনি, তাও জানি না, শুধু নিজের যন্ত্রনাগুলো বললাম মাত্র । আমি ভালবাসতে চাই, ভালো থাকতে চাই, বাঁচতে চাই, জীবনটা তো আমার ।”
এতক্ষন বলার পর থামল দেবাংশী । নিশ্চুপ অর্ঘ্য, সামনে বসে, মাথা নীচু । কিনে আনা সবুজ শাড়ীটাও যেন খুব ঠাট্টা করছিল অর্ঘ্যকে ।
*******************
‘পরকীয়া’য় অবশ্যই আপত্তি আছে, একজন মানুষ যে তোমার প্রতীক্ষায় থাকে দিনের পর দিন, তাকে ঠকিয়ে অন্য্ একজনের মধ্যে উষ্নতা খোঁজাটা পরকীয়াই । কিন্তু, একজন মানুষকে ভালবেসে, তাকে পাশে নিয়ে পথ চলা, যে ‘তোমায়’ ভালবাসে, শুধু তোমার শরীরকে নয়, যে তোমায় বাঁচতে শেখায়, তাকে ভালোবাসায় পাপ কীসে? বিবাহ বহির্ভুত তাই পাপ? তাহলে, ভাল না বেসে সংসার সংসার খেলা খেলে পাশের মানুষটাকে অনবরত ঠকানো, তাকে কী বলবেন?