আজকে যে বিষয় নিয়ে বলতে চলেছি , তা সবার পছন্দ নাও হতে পারে | কিন্তু সমাজের সবদিকটাই সমানভাবে দেখা উচিত তাই আজকের গল্প |
আমি পারমিতা ঘোষ, বিবাহিতা , চাকুরীজীবি, স্বামী প্রকাশ ঘোষ, আর আমাদের সন্তান পিকু ওরফে অনীককে নিয়ে ছোট্ট সংসার | চার বছরের দাম্পত্য জীবনে পিকু আমাদের মধ্যে আসে বিয়ের বছর দুই পরে | আমরা লেক টাউনে একটি ফ্ল্যাট কিনে শিফট হয়েছি মাস কয়েক হলো | আগে ভাড়া থাকতাম কেষ্টপুরে | ইদানিং প্রতিনিয়ত একটি ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছি | প্রতিবারই ঘুরে ফিরে ব্যাপারটি একই জায়গায় নির্দেশ করছে, যার ফলে আমি প্রথম প্রথম পাত্তা না দিলেও এখন যারপরনাই বিব্রত বোধ করছি মাঝে মাঝেই |
খুলেই বলি, কিছুদিন আগেই আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের তৃনা বৌদির সাথে বিকেলের চা পর্ব আর সাথে টুকটাক আড্ডা দিছিলাম ছুটির দিন উপলক্ষে | হঠাৎ ই তৃনা বৌদি খোশ গল্পের মেজাজ ছেড়ে বেশ গম্ভীর ভাবে প্রশ্ন করলেন,” ছেলেকে কোন স্কুলে ভর্তি করছো?” প্রশ্নটি শুনে আমি বেশ বিস্মিতই হলাম | এতটুকু ছেলে তাকে স্কুলে ভর্তি করানোর কাজটা যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ , তা ওনার না বলা অবধি আমার সত্যিই মনে হয়নি | যা হোক আমি বললাম. “এখনো ভাবিনি কিছু, ওতো খুব ছোট , কিছুদিন পর ভাববো |
তৃনা বৌদি সঙ্গে সঙ্গে আমার কথার খেই ধরলেন , ” এই তো এটাই তো ভুল করে এখন কার মা বাবারা| ভাবতে আগে থেকেই হয় বুঝলে, নয়তো শেষ সময়ে কিছু করার থাকে না | শোনোইংলিশ মেডিয়ামটা কিন্তু মাস্ট আর ছেলেকে এখন থেকেই শেখাতে শুরু করো, গ্রূমিংটা খুব জরুরি, নয়তো কম্পিটিশনে টিকতে পারবেনা বুঝলে?”
আমি মুখে মেকি হাসির রেশ টেনে বললাম ,” মাথায় রাখবো , আপনার ছেলেকে দেখছি না যে?”
তৃনা বৌদি নিজের ভাব ভঙ্গি এমন করলেন যেন ছেলে সাক্ষাৎ দেশের প্রধানমন্ত্রী ,” ওতো সময় ই পায়না যা চাপ স্কুলের , ওর কথা আর বোলো না |”
তা সেদিনকার মতো গল্প মিটিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে এলাম | কিছুদিন পরই দেখলাম ওনার অনুপস্থিতিতে নিজের ফ্ল্যাটের বারান্দায় সিগারেট এর ধোঁয়া ওড়াচ্ছে | প্রসঙ্গত, সেই ছেলে এখনো স্কুলের গন্ডিও পেরোয়নি |
আগের সপ্তাহে, আমার দিদির বাড়ি পুজোয় নেমন্তন্ন ছিল, তো স্বামী সন্তান সমেত সেখানে পৌঁছানো হলো | গরম সিঙ্গাড়ায় কামড় বসিয়েছি , এমন সময় আমার দিদি এমন ভাবে কথা শুরু করলেন যেন বাচ্চা মানুষের অব্যর্থ টোটকা এক্ষুনি আমার কানে দিয়ে দেবে, আর যা পেয়ে আমার জীবন ধন্য হয়ে যাবে, ” পিকুর ব্যাপারে কি ভাবছিস?” আমি যারপরনাই বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বললাম,”কি ভাববো?”
বিশাল ভুল কিছু বলে ফেলেছি এমন ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে দিদি আবার বললো,”আরে ! কি ভাববি মানে? ওতো বড় হচ্ছে | স্কুলের ব্যাপারে কি ভাবছিস? কোন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করবি ভাবতে হবে না? শোন্ তা না হলে কিন্তু একটা অপদার্থ তৈরি হবে, আর তোদেরও তো তৈরি হতে হবে | তার জন্যও স্কুল আছে কিন্তু, তোদেরও তো ইন্টারভিউ হবে, এগুলো ভেবেছিস কিছু?”
সব শুনে, তখন বাড়ি তে অত লোকজনের সমাগম দেখে আমি কথাগুলো কোনোরকমে হজম করে চলে এলাম |
ইংলিশ মিডিয়াম মানেই পণ্ডিত আর বাংলা মিডিয়াম মানেই অপদার্থ এরকম ভাবনা যদি সন্তানের মা বাবাই পোষণ করেন , তাহলে তারা বাচ্চাদের কিভাবে তার মাতৃভাষাটা কে চেনাবেন?
আমার বৌদি, ফ্লাট কেনার পর এই আমাদের ফ্ল্যাটে এলেন, গৃহ প্রবেশের সময় আসতে পারেনি | সঙ্গে আমার ভাইপোও ছিল | প্রথম এসেছে তাই খাওয়া দাওয়ার আয়োজন ছিল বইকী | তো আমার ফ্ল্যাটের ড্রয়িং রুমে স্বামী বিবেকানন্দের বলা কিছু কথা আমি বাঁধিয়ে ফ্রেম করে রেখেছিলাম | আমার ভাইপো ঋক কে তার সামনে ফ্যাল ফ্যাল করে অনেক ক্ষণ তাকিয়ে থাকতে দেখে বলেই ফেললাম , ” কি হয়েছে? পছন্দ হয়েছে এটা? নিয়ে যাবি তো নিয়ে যা না |”
ঋক আমায় ততোধিক বিস্মিত করে জবাব দিলো ,” না না পিপি , আমি আসলে ঠিক করে পড়তে পারছিলাম না |” ঋক এর কথা থামিয়ে আমার বৌদি বেশ গর্বের সাথেই উত্তর দিলো ,” ওর বাংলা টা ঠিক আসে না আসলে |
সত্যি বলছি বিশ্বাস করুন ,করুণা হয় এদের জন্য, একজন বাঙালি হয়ে বাঙালির সুবিশাল সৃষ্টি, রসবোধ, সবকিছু থেকে এরা বঞ্চিত , নিজের মাতৃভাষাকে সুস্পষ্ট উচ্চারণ না করে বিকৃত উচ্চারণ করাটাকেই এরা “এচিভমেন্ট” হিসাবে নেয় | এদের কি সত্যিই প্রকৃত শিক্ষিত বলা যায়? আর মা বাবাও তাতে অসম্ভব গর্ব বোধ করেন | এগুলো কি সত্যিই বুদ্ধিমত্তার পরিচয়?
আমাদের এই মুহূর্তের কথা মাথায় রেখে একথা অনস্বীকার্য যে ইংরেজি ভাষা বলার ও লেখার দক্ষতা প্রয়োজন,সত্যিই প্রয়োজন, বিভিন্ন কর্মস্থলের কাঠামোই তেমন, এটা মানতেই হবে | কিন্তু তাই বলে নিজের মাতৃভাষাকে দায়িত্ব নিয়ে অপমান করা কে আর যাই বলা যাক না কেন, প্রকৃত শিক্ষা বলা যায় না |
আমি এমন অনেক ক্ষেত্রে দেখেছি, বড় বড় নামী দামী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে বাচ্চাদের এডমিশন হয় না তার মা বাবার ইংরেজি বলার দক্ষতার অভাবের জন্য | এখানে মা বাবার ইংলিশ বলা টা কি করে একটা মাপকাঠি হতে পারে একটা ঐটুকু বাচ্চার স্কুলে ভর্তির জন্য? নাকি স্পোকেন ইংলিশ জানলেই তবেই একজন মা বাবা যোগ্যতা অর্জন করেন এই সমস্ত নামী দামী স্কুলের কাছে যে হ্যাঁ, আমার সন্তানকে শিক্ষা দেওয়ার যোগ্যতা আমার আছে | আর যারা ইংরেজি বলতে পারেন না তারা তো কোনো যোগ্যতাই রাখেন না | তাই না?
আমার একজন পরিচিত-র সাথে কথা হচ্ছিলো, সে থাকে কলকাতায়, কিন্তু উত্তর কলকাতায় কোন “ভালো স্কুল” তার নজরে পড়েনি বলে তার ঐটুকু বাচ্চাকে পাঠায় দক্ষিণ কলকাতার একটি নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে | বাচ্চাটি সন্ধের শেষে যখন বাড়ি ফেরে, তখন আমার মনে শুধু একটিই প্রশ্ন জাগে ,” খুব দরকার ছিল কী এতটা কষ্ট দেবার ? অযথা নয় কী এটা?”
কিছু কিছু স্কুলে আবার নিয়ম আছে, মা নিজের সুবিধা মতো খাবার যেমন খুশি বানিয়ে দিতে পারবেন না সন্তানকে | যার মানে ওই স্কুলের রুটিন অনুযায়ী একেক দিন একেক রকম খাবার পড়তে হবে টিফিন বক্সে | এটাও হয়তো প্রকৃত শিক্ষা প্রদানের একটি ধাপ |
নামী দামী স্কুলে পড়া সত্ত্বেও সাধারণ জ্ঞানটুকু নেই, ২৩ শে জানুয়ারি,২৬শে জানুয়ারী, ২১ শে ফেব্রুয়ারীর গুরুত্ব জানে না এরকমও অনেক দেখতে পাই, তবে এসব কিছুই সবার জন্য প্রযোজ্য নয়, ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, কিন্তু আমরা মা বাবারাই যদি ভুলে যাই ইংরাজীর সাথে সাথে মাতৃভাষাটাকেও চেনা জরুরি , তাহলে সন্তানরা কী চিনবে? কাকে চিনবে? এরা পরবর্তী প্রজন্ম কে কী শেখাবে? রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, জীবনান্দ, সবই অধরাই থেকে যাবে এদের কাছে |
প্রকৃত শিক্ষা , মূল্যবোধ এগুলো তো সন্তান তার বাড়ি থেকেই শেখে | শুধু একটা নামী স্কুল কী সেটা দিতে পারে? মানুষ হওয়ার হলে সে মানুষ ঠিকই হয় | যার হওয়ার হওয়ার নয় সে কিছুতেই হয় না |
নিজেরা হাতে করে দায়িত্ব নিয়ে নিজেদের মাতৃভাষার কবর না খুঁড়ে বরং চেষ্টা করি দুই ভাষাকেই সমান আদর দিতে | কারন জানা প্রয়োজন দুই ভাষাকেই | শেক্সপীয়ার পড়তে পড়তে না-হয় একটু একটু রবীন্দ্রনাথকেও চিনলো আমাদের সন্তান, ক্ষতি কী?