প্রহর শেষে…

prahar sese story image

prahar sese story image

||১||

“বেলটা বাজছে খুলতে পারছিস না নাকী?”, মার গলা খাঁকরিতে বিরক্ত হয়ে উঠল মিলি | মিলি আশুতোষ গাঙ্গুলী আর রমা গাঙ্গুলীর একমাত্র মেয়ে, এবছরই মাসটার্স কমপ্লিট হয়েছে ওর | বাগুইহাটির ফ্ল্যাটে শিক্ষক আশুতোষ বাবুর ছোট্ট সংসার |

মিলি দরজাটা খুলতেই দেখল একটা পার্সেল নিয়ে সামনের ব্যক্তিটি দাঁড়িয়ে |

-“কী ব্যাপার?”

-“ম্যাম, লাবণ্য গাঙ্গুলীর নামে একটা পার্সেল আছে |”

-“পার্সেল? আমার নামে? কে পাঠিয়েছে বলুন তো?”

-“বলতে পারব না সেটা, আপনি কাইন্ডলি সই করে এটা নিয়ে নিন |”

মিলি সই করে পার্সেলটা নিয়ে নিল বাধ্য হয়েই, ততক্ষনে রমাদেবী রান্নাঘর থেকে দেখতে চলে এসেছেন, ব্যাপারটা কী?

-“কীরে, কে পাঠিয়েছে পার্সেল?”

-“সেটাই তো বুঝতে পারছি না মা |”, পার্সেলের প্যাকিং খুলতে খুলতে জবাব দিল মিলি |

-“ছাড় না খুলতে হবে না, বেকার ঝামেলা হয় যদি, যদি বোম টোম থাকে…|’

রমা দেবীর মুখের কথা শেষ হলো না, মিলি বলল,”মা প্লিজ, এত পাতলা প্যাকেট, বোম থাকবে?”

“থাকতেই পারে…”,বলতে বলতেই রামাদেবী দেখলেন প্যাকেট থেকে বেরল আর একটা প্যাকেট, তবে সেটা স্বচ্ছ | তার ভিতর রয়েছে একটা নতুন সিডি, দেখে তো দু’জনই অবাক, একটা সিডি এসেছে পার্সলে? মিলি তো তড়িঘড়ি সিডি নিয়ে ছুটল ঘরে, ল্যাপটপ পাড়ল, রমা দেবীও ছিলেন সাথে, ল্যাপটপে সিডিটা চালালো মিলি | এটা কোন ভিডিও সিডি না, একটা অডিও সিডি, কারও গাওয়া রবীন্দ্র সঙ্গীত, রেকর্ডেড | মিলি তো স্বাভাবিক ভাবেই আকাশ থেকে পড়ল, একটা পুরুষ কন্ঠ, রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়ে পাঠিয়েছে | মিলির তো কিছুই মাথায় ঢুকছে না, প্রেরক এটা জানল কী ভাবে যে মিলি গান, স্পেশালি রবীন্দ্র সঙ্গীত এত পছন্দ করে? কেরে বাবা? ভুল করে অন্যকারোটা ওর কাছে চলে আসেনি তো? তাই বা কী করে হবে? পরিষ্কার প্যাকেটে ওর নাম লেখা, তাহলে?

****************

এখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে, আশুতোষবাবু ফিরে এসছেন, চপ মুড়ি মাখা হচ্ছে ড্রয়িং রুমে | রমা দেবী খেতে ডাকলেন মেয়েকে, আশুতোষবাবুকেও গল্প বলছেন রহস্যজনক সিডির | মিলির মন থেকে এখনও নামছে না গানটা, অবাক তো হয়েইছে, সর্বোপরি গানের গলাটা মারাত্মক, আর কেমন যেন চেনা চেনা, তবে এই গলায় গান প্রথম শুনলো মিলি, “তোমার খোলা হাওয়া…”|

গানটা বার বার শুনে নিজের মনেই কখন অজান্তে যেন এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া লাগল মিলির | এত সুন্দর গলা, এত যত্ন করে গাওয়া গান, কে এ?

||২||

-“কইরে, কাটলি টিকিটগুলো?”

কানে হেডফোন লাগিয়ে একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনছিল বিভোর হয়ে, মা-এর ধাক্কায় হুঁশ ফিরল মিলির |

-“কাটলি টিকিটগুলো?”

-“ও হ্যাঁ, মানে না, এখুনি কেটে নিচ্ছি মা, একদম ভুলে গেছিলাম |”

-“দিনরাত ঐ গান নিয়েই থাকে তুই |”, গজ গজ করতে করতে রমা দেবী পাশের ঘরে গেলেন |

আসলে এই সপ্তাহে মিলির, আর আশুতোষ বাবুর পরম প্রিয় বন্ধু মনোহর বাবুরা সপরিবারে দীঘায় বেড়াতে যাচ্ছেন, সেই নিয়েই টিকিট কাটার কথা | তার আগে অবশ্যই কালকে ওনারা সবাই চলে আসছেন, দুদিন থেকে তারপর দীঘার জন্য বেরনো হবে | আর পরশু রবীন্দ্র জয়ন্তী, ২৫শে বৈশাখ, দিনটাও ভাল, আর ওদের আবাসনে জলসার আয়োজনও করা হয় | খুব ভাল ভাবে কাটে দিনটা, তাই এবার আশুতোষবাবু মনোহর বাবুদেরও ডেকে নিলেন |

||৩||

মিলি ছোট থেকেই রবীন্দ্রনাথ অন্তঃ প্রাণ | রবীন্দ্রনাথের গান, রবীন্দ্রনাথের লেখা সব কিছু যেন মিলির রক্তে | আসলে এই ব্যাপারটা ও পেয়েছে পূর্বপুরুষদের থেকেই | আশুতোষবাবু যথেষ্ট রবীন্দ্র চর্চা করেন, ওনার বাবাদের আমলেও ছিল গান, বাজনা, কবিতা, গল্প, নাটকের এই অভ্যাস, সবমিলিয়ে শিল্পী পরিবার | আগে তো ওনারা ওনাদের শ্যামবাজারের বনেদী বাড়িতেই থাকতেন, সেখানে যৌথ পরিবারে মানে আশুতোষ বাবুর কাকা জ্যাঠারা, আশুতোষ বাবুর ভাইরা, সবাই থাকতেন একসাথে, রীতিমতো জলসা বসত, তো সেই কালচারটা ফ্ল্যাটে উঠে এসেও রয়ে গেছে | আর রবীন্দ্রনাথ সেই ছোট্ট থেকে ছোট্ট মিলির রক্তে | ও নিজে খুব ভাল গান গায়, লেখালেখির দিকেও বেশ ঝোঁক |

****************

ইতিমধ্যে সেই অজ্ঞাত পরিচয় পুরুষটির গাওয়া বেশ কটি গানের সিডি বাড়িতে পার্সেল রূপে এসেছে, সব কটিই রবীন্দ্র সঙ্গীত | অবশ্যই মিলির খুব পছন্দের | এখনও সে উদ্ধার করতে পারেনি কে করছে এটা? মিলির মা তো মজা করে আগেরদিন বলেই ফেলল,”গান গেয়ে শেষে প্রেম নিবেদন করছে হয়তো |”

মিলি এখন অন্যমনস্ক ভাবে ভাবছিলো, সত্যি কী তাই? এত সুন্দর গলা, মানুষটা তাহলে কতটা সুন্দর, সে যেই হোক, সে তার মানে মিলিকে খুব ভাল করে চেনে, জানে, ওর পছন্দ অপছন্দের তালিকাটাও স্পষ্ট তার কাছে | তাহলে কে সে? মিলি বুঝতে পারছে নাই বা কেন? কিন্তু এখন কে সেই অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি তা ভাবার দিকে মন না দিয়ে ইচ্ছে করে হারিয়ে যেতে সেই উদাত্ত গভীর কন্ঠে, যা প্রকৃতই অসাধারণ |

||৪||

আজ সকাল থেকেই তুমুল ঝড়বৃষ্টি, কাল আবার রবীন্দ্র জয়ন্তী, আবাসনের ‘জলসা’র রিহার্সাল এখন তুঙ্গে | বসার ঘরে মহড়া চলছে, সঙ্গে রমা দেবীর হাতের গরম পিয়াজি আর বেগুনি, তার মাঝেই এল আজ আবার পার্সেলটা |

***************

ফ্ল্যাটের কাছের স্বচ্ছ জানলা প্রবল বর্ষণে ঝাপসা | ব্যালকনিতে রাখা টবগুলি অনেকদিন পর বারিকণার স্পর্শ পেয়ে উচ্ছল, কখনো দমকা হাওয়ায় গাছের সবুজ পাতাগুলো কচি ডাল সমেত পাথরের মেঝেকে চুম্বন করছে, কখনো সবুজ ডালগুলো হাওয়ায় যেন খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে | এরই মাঝে মিলির কানে বাজছে,”মন মোর মেঘের সঙ্গী উড়ে চলে দিক দিগন্তের পানে… নিঃসীম শূন্যে…শ্রাবন বর্ষণ সংগীতে… রিমিঝিম রিমিঝিম রিমিঝিম “, হ্যাঁ শ্রাবন মাস নয় এখন, কিন্তু মিলির মনে এখন শ্রাবনের ধারা নেমেছে, এ ধারা বিরহের নয়, প্রেমের |

মহড়া থেকে বেশ কিছুটা সময় মিলি বিচ্ছিন্ন, একাকী, হঠাৎ বাকীদের ডাকে হুঁশ ফিরল | মনে মনে একটা অবয়ব তৈরি হয়ে গেছে মনের মানুষটার | হ্যাঁ, এখন যেন মানুষটা একান্ত আপনই হয়ে গেছে, হয়তো বা তাকে ভালই বেসে ফেলেছে, জানে না মিলি, শুধু এখন ঐ গানের সিডিগুলোর অপেক্ষায় থাকে ও | কে এ? তাও জানে না, শুধু জানে সে মিলিকে খুব ভাল করে বোঝে, এত ভাল মা বাবার পর হয়তো কেউ বোঝেনি | মানুষটার কন্ঠের প্রেমে তো মিলি পড়েইছে, এবার সামনে দেখার জন্য মনটা বড় বেশি আকুল হচ্ছে |

আজ সিডির সাথে একটা চিরকুটও এসেছে, এই প্রথম,”তোমায় নতুন করে পাব বলে |”, জানে না মিলি এই হেঁয়ালির মানে, কিন্তু এই হেঁয়ালির একটা নেশা যেন লেগে গেছে ওর মনে… অনেক কষ্টে আবার নিজের কাজে মন বসাল মিলি |

||৫||

আজ ২৫শে বৈশাখ, টাটকা জুঁই-এর মালাটা গুরুদেবের বড় বাঁধানো ছবিতে পরালেন আশুতোষ বাবু | এখুনি হয়তো ওনার বন্ধুরাও এসে পড়বেন | ধুপটা জ্বালছিল মিলি, পরনে শাড়ি, কপালে টিপ্, কানে ঝুমকো, চোখে কাজল, বলতে অপেক্ষে রাখে না কতটা মোহময়ী সুন্দরী লাগছে মিলিকে |

কিছুক্ষনের মধ্যেই হইহই করে এসে পড়লেন মনোহর বাবু, ওনার স্ত্রী, মেয়ে | জমজমাঠ আড্ডা বসে গেল | দু’দিন বাদেই বেড়াতে যাওয়া, তার প্লানিং, সঙ্গে আবার রবীন্দ্র জয়ন্তীর জলসা |

***************

মনোহর বাবুদের একটা গান গেয়ে শোনালো মিলি | মিলির বাবা আর মনোহরবাবু আসলে সেই ছেলেবেলা থেকে দুই অভিন্ন হৃদয় বন্ধু, অনেকদিন পর দুই বন্ধু একসাথে, মারাত্মক আড্ডা হবে সেটাই স্বাভাবিক |

ডাইনিং টেবিলে চিংড়ির মালাইকারি দিয়ে ভাতটা মাখতে মাখতে মনোহর বাবু হঠাৎ বললেন,”মিলিকে তো আর আলাদা করে দেখার কিছু নেই, সেই ছোট্ট বেলা থেকে দেখছি, তারিখটা এবার ঠিক করলেই তো হয়, শুভ কাজে দেরী কেন?”

আশুতোষবাবু ইশারায় বন্ধুকে এখন এই আলোচনাগুলো স্থগিত রাখতে বললেন | মিলি খাচ্ছিল, আচমকাই তাল কাটল, তাহলে কী তলে তলে মা বাবা মনোহর কাকুর ছেলের সাথেই বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে? ওকে জানালোও না? মিলির সব গুলিয়ে যেতে লাগলো, বাবা এরকম করলো কেন? খুব কষ্ট হচ্ছিল মিলির, একটা চাপা যন্ত্রনা, মিলি কী মা বাবার কাছে এতটাই বোঝা হয়ে গেছে? একবার ওকে কিছু জানালোও না?

***************

খাওয়া দাওয়ার পর মা বাবা, কাকু, কাকিমারা সব গল্প করছিলেন বসার ঘরে | মিলির একা থাকতে ইচ্ছে করছিলো, কানে এখনো বাজছে সিডির পাঠানো গানগুলো | জানে না কীসের কষ্ট, কিন্তু যেন একটা কিছু হারিয়ে ফেলার কষ্ট হচ্ছে | যখনই একটু মনটা প্রেমের জোয়ারে ভাসতে শুরু করেছিল তখনই এটা হতে হলো? ও তো এখনো জানেও না গানের পিছনের সেই সুন্দর মানুষটাকে | যখন কপালে নেই তখন এগুলো হলোই বা কেন? এসব ভাবতে ভাবতেই কখন চোখটা লেগে গেছে বুঝতেই পারেনি |

ঘুম ভাঙল মনোহরবাবুর মেয়ের ডাকে, মিষ্টি, ওর নাম, মেয়েটাও ভারী মিষ্টি, এই বছর কলেজে ঢুকেছে | মিলি ধড়মড়িয়ে উঠে দেখল আর বেশি সময় নেই, তাড়াতাড়ি তৈরি হতে গেল ও, এখুনি অনুষ্ঠান শুরু হলো বলে |

আলমারি থেকে শাড়িটা বের করতে গিয়েই থমকাল মিলি, রহস্য পুরুষ একবার একটা চিরকুটে আভাস দিয়েছিল তার প্রিয় রং কাঁচা হলুদের রং | মিলির হঠাৎ মনে হলো ঐ হলুদ শাড়িটাই পরলে কেমন হয় | কেন জানে না, ইচ্ছে হলো পরতে, পরলও | ভাল করে সাজতে বসলো মিলি, কে জানে আর কতদিন নিজের মত করে সাজতে পারবে, তখন তো আশেপাশের মানুষগুলোর ভালোমন্দ লাগার কথা বেশি করে ভাবতে হয় |

ড্রয়িং রুম থেকে একটা কোলাহল ভেসে আসছে | রেডি হয়ে নিজের ঘর থেকে ড্রয়িং রুমের দিকে যেতে গিয়েই মিলি দেখল আরও একজনের আগমন ঘটেছে ফ্ল্যাটে, মনোহর বাবুর ছেলে আদিত্যর | মিলির সাথে আদিত্যর যে কত কত বছর পর দেখা কে জানে, ছেলেবেলায় খুব ঝগড়া করত দু’জনে | মিলি দুপুরে ওরকম শুনেছিল তাই হয়তো নিজের অজান্তেই একটু লজ্জা পেল, পরক্ষনেই মনটা কেমন বেরঙিন লাগল, কেন জানে না |

“খুব সুন্দরী হয়ে গেছিস তো |”, আদিত্যই প্রথম বলল |

মিলি হেসে বলল,”কবে বিদেশ থেকে ফিরলে আদিত্য দা?”

মিলি আদিত্য দা-ই বলত | আদিত্য বিদেশে লেখাপড়া করতে গেছিল, ব্যস এটুকুই জানত , এর বেশি আর কিছুই খোঁজ রাখেনি | আর আদিত্যর সাথে মিলির ঝগড়া লাগত কারণ, ছোটবেলায় গানের লড়াই খেলতে খেলতে মিলি দেখত আদিত্য রীতিমত হেঁড়ে গলায় গানটা গায়, আর মিলির গানের গলা ভারী সুন্দর… স্বাভাবিকভাবেই মিলির খুব বিরক্ত লাগত | ও গান যেমন ভালবাসে, তেমনই সুন্দর কন্ঠের অধিকারী মানুষগুলোকে অসম্ভব সমাদর করতেও জানে |

আদিত্য যে আজ আসবে জানতোও না মিলি, একটা তসর রঙের পায়জামাতে তাকে বেশ লাগছিলো | আদিত্য হেসে উত্তর দিল ,”এই তো ফিরলাম ক’দিন আগে, তোকে তো কতদিন পর দেখছি, গান শোনাতে হবে কিন্তু, যদিও আমায় গান গাইতে বলে লজ্জা দিস না |” বলেই হেসে ফেলল |

*****************

জলসা শুরু হলো, মিলি গানও গাইল, শুধু গান গাওয়ার সময় একেবারে সামনের সারিতে বসা আদিত্যর চোখ দুটোয় চোখ আটকে যাচ্ছিল | সে মুগধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মিলির দিকে, প্রাণ ভরে যেন শুষে নিচ্ছে মিলির কন্ঠের সঙ্গীতটাকে |

*****************

তারপর থেকে তেমন কথা হয়নি, শুয়ে শুয়ে রাত্রে মিলির বারবার মনে আসছিল আদিত্যর চোখগুলো |

||৬||

দীঘায় ঘণ্টাখানেক হলো পৌঁছেছে মিলিরা | রেস্ট নিয়ে বিকেলের দিকে বেরল ওরা | ঝোড়ো হাওয়ায় উথাল পাথাল হয়ে আছড়ে পড়ছে সাদা ঢেউগুলো | চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল মিলি, সমুদ্রের ঢেউগুলো বারবার পা ছুঁয়ে যাচ্ছে | সূর্যাস্তের কনে দেখা রক্তাভ আভায় সমুদ্র যেন সৌন্দর্যে সবাইকে টেক্কা দিচ্ছে, তার সৌন্দর্য থেকে চোখ ফেরায় কার সাধ্যি | হঠাৎ আদিত্য এসে দাঁড়াল একলা মিলির পাশে |

কিছুক্ষনের নীরবতা ভেঙে আদিত্যই বলল,”আমাদের ব্যাপারে মা বাবা কথা বলছেন জানিস তো?”

মিলি কিছুক্ষন চুপ থেকে শুধু একটাই কথা বলল, “জানি |”

-“তোর এ ব্যাপারে কিছু বলার নেই?”

মিলি এবার ফিরে তাকাল আদিত্যর দিকে, আলো আঁধারের খেলা শুরু হয়ে গেছে তখন, তাকিয়ে একটু হেসে বলল,”আমার বলা না বলায় কী কিছু থেমে থাকবে?”

-“হ্যাঁ, অবশ্যই, তোর মতটা তো যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, তোর কী এই বিয়েতে মত নেই?”

মিলি এবার একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,”যদি বলি মত নেই, যদি বলি অন্যকাউকে ভালবাসি, তুমি কী আমার জন্য বিয়েটা ভেঙে দেবে?”, বলেই মিলি,”এক্সকিউজ মি”, বলে বেশ কিছুটা দূরে সরে গেল |

আদিত্য আর কিছু বলেনি | বালির উপর ফেলে যাওয়া মিলির পায়ের ছাপ অনুসরণ করে মিলির সরে যাওয়াটা দেখছিল শুধু |

*******************

হোটেলে ফিরতেই আবার একটা পার্সেল পৌঁছাল মিলির হাতে | মিলি এটা একেবারেই এক্সপেক্ট করেনি, স্বপ্নেও না | তাহলে সে মিলি কোথায় যাচ্ছে, কী করছে সব খবর রাখছে? আজ সিডির সাথে একটা চিরকুটও আবার, “ভালবাসি, ভালবাসি”, ব্যস এই দুটো শব্দ, যা মিলির আশপাশটা এলোমেলো করে দেবার জন্য যথেষ্ট ছিল | ধপ করে বসে পড়ল মিলি, কী করবে ও? ওরও তো নিজের অজান্তেই এই মানুষটাকে ভাল লাগতে শুরু করেছে | মাথাটা জাস্ট খারাপ হয়ে যাচ্ছে এবার ওর | ব্যালকনিতে দাঁড়াল, চোখ বুজে , ঝোড়ো হাওয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে যাক ওকে, সাথে ওর সমস্ত ভাবনাগুলোকেও | কিছুক্ষন পর একটা বেতের মোড়ায় বসল, চোখ বুজে সমুদ্রের গর্জন শুনছে একমনে, কত রাত হয়ে গেছে জানা নেই | হঠাৎ কানে এল একটা কন্ঠ, খুব চেনা মনে হলো গলাটা | একটু শুনে চোখ খুলল মিলি, দেখল ওদের টানা ব্যালকনির আর এক প্রান্তে “এ কী লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ” গাইছে আদিত্য, মিলির দিকে তাকিয়ে |

মিলি যে কতটা হতবাক হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না | তাকে আরও অবাক করে দিয়ে আদিত্য গান থামিয়ে বলল,”ভেবেছিলাম ধরে ফেলবি ঠিক, পারলি না”, বলেই আবার হাসল আদিত্য |

মিলি হাঁ করে কিছুক্ষন তাকিয়ে বলল,”মানে ঐ সিডিগুলো সব তোমারই…”,মিলির কথা আর শেষ হলো না |

আদিত্য বলল,”মনে আছে ছোটবেলায় আমি গান গাইতে পারতাম না বলে কেমন হেনস্তা করতিস, তখনই ঠিক করেছিলাম তোকে প্রপোজ করবো গান গেয়েই, সেটাও হবে রবীন্দ্রসঙ্গীত | তো প্রপোজও করে ফেললাম মিস লাবণ্য, এবার তো কিছু বলুন |”

মিলির তখন মনে কী চলছে মিলিই জানে, এত আনন্দ এত খুশি এভাবে আসবে স্বপ্নেও ভাবেনি, অন্ধকার না হলে দেখা যেত লজ্জায় মিলির মুখ কতটা রাঙা হয়েছিল | মুখটা নীচু করে শুধু বলল,”এতদিন ধরে এগুলো করার কারণটা জানতে পারি কী?”, গলায় যেন হালকা অভিমানী সুর |

“তোর তো মনে প্রাণে রক্তে রবীন্দ্রনাথ | কী করবো বল ওনার থেকে ভাল আর কে-ই বা হতে পারত এই অধমের প্রেম নিবেদনের পথ? তাই রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কেউ মাথাতেও আসেনি |”-আদিত্য |

“দেখলে তো তাহলে আমাদের রবি ঠাকুরই যা করার করল, এটা কিন্তু চালিয়ে যেতে হবে আদিত্য দা | খুব ভাল গাও তুমি… তোমার গান শুনেই…” চুপ করে গেল মিলি, লজ্জায় মাথাটা নীচু |

“এখনো আদিত্য দা? ‘দা’ টা কেটে বাদ গেলে তাহলে ভেবে দেখতে পারি এই সঙ্গীত পর্ব চলবে কী না, আর আমিও তো এবার এক্সপেক্ট করতে পারি রবি ঠাকুরের পরম ভক্ত মিস লাবণ্যের থেকে কিছু, নাকী?

******************

সমুদ্রের গর্জন, ঘন আঁধার, তার মধ্যেই বালিতে দুই জোড়া পা-এর ছাপ এগিয়ে চলেছে একসাথে, কান পাতলে হয়তো শোনা যেত….”প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস, তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ…”…না এখন চৈত্র, না এখন আকাশে আছে রক্ত লাল আভা, তবু প্রেম তো, কী-ই বা যায় আসে আশেপাশে কী হলো তাতে… আর রবি ঠাকুরের থেকে ভালো প্রেম আর কেই বা বুঝিয়েছেন…|

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

মুক্তি

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেল, আকাশ তখন থেকে ঠায় বসেই রয়েছে ঘাটে। এখন বাঁধানো ঘাট থেকে করিডোর হয়ে বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরে পুজো দেওয়া অনেকটা সহজ

Read More »

বন্ধু হবি চল

বাক্সপেটরা নিয়ে স্টেশনেই বসে ছিল নয়না, বৃষ্টি পড়েই চলেছে, মুষলধারায়। বাবা বলল আরেকটু অপেক্ষা করতে, এত বৃষ্টিতে তো ছাতাও হার মানবে, আর বেরিয়ে রাস্তাও অজানা

Read More »

টিফিনবাক্স

প্রতিবারের মতন এই বছর ও সমস্ত সরঞ্জাম গুছিয়ে বেরোনোর জন্য ব্যস্ত অমিত, অন্তত সন্ধ্যার মধ্যে বেরোতে না পারলে খুব মুশকিল। পুজোর দিকটা কতদূর কি হলো

Read More »

ক্লিক

।।১।। -“মালিনী, কালকের মিটিংটা কখন ফিক্স করেছ? -“ম্যাম, সকাল ১১টা।” -“ওকে, কনফার্মেশন পেয়ে গেছ?” -“ইয়েস ম্যাম।” -“ওকে গুড। আর।।। এক মিনিট।।।” টেবিল থেকে ফোনটা তুলে

Read More »

শিক্ষা

।।১।। দাপুটে, বদরাগী, মেজাজি এই সব কটা বিশেষণই বেশ ভালো যায় মিসেস বোসের সাথে। রেণুকা বোস আর অমরনাথ বোস সানফ্লাওয়ার এপার্টমেন্টে ১২০০ স্কোয়ারফিটের ফ্ল্যাট 2c

Read More »

বিদায়

।। ১।। রীতিমত জোর করেই নন্দিনীকে পাহাড়ে নিয়ে এলো সঙ্গীতারা। আসার ইচ্ছে তো ছিল না ওর একদমই, শরীর সাথ দিলেও মনটা কোনোভাবেই সাথ দিচ্ছে না।

Read More »

Share with