পথে হলো দেরী

pathe-hlo-deri-muktodhara story

pathe-hlo-deri-muktodhara story

||১||

“মা প্লিজ আবার তুমি শুরু করো না, আমি তোমায় বহুবার বলেছি যে আমি এসব নিয়ে চাই না কথা বলতে |” তাড়াতাড়ি ফাইল গোছাতে গোছাতে উত্তর দিলাম আমি | আমি, দেবলীনা মিত্র, শোভাবাজারে থাকি মা বাবার সাথে | দিদি একটি, সে বিবাহিত, চাকরি করি, ডিভোর্সী |

হ্যাঁ ডিভোর্সী, বিগত দেড় বছরের আইনি জটিলতার পথ পেরিয়ে বছর খানেক হলো আমি মুক্ত, স্বাধীন | কিন্তু মেয়েদের এই স্বাধীনতা সমাজে আজও সোজা চোখে দেখতে পারা যায় না | অগত্যা, আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয় | শিকলের কালশিটে পড়া পায় আর একবার শিকল বাঁধতে মরিয়া হয়ে উঠেছে আমার মা, বাবা, দিদি | সেই প্রসঙ্গেই সুপাত্রের ছবি দেখানোর জন্য জেদাজেদি চলছিল | আমি কোনোক্রমে পাত্তা না দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম |

তাড়াহুড়ো করে অফিস পৌঁছে ফাইল ঘাটতেই দেখলাম মা-এর সেই ‘সুপাত্র’-র ছবি, আমার কাছে তাড়াহুড়োয় চলে এসেছে | দেখে নিজের মনে বেশ কিছুক্ষন হাসলাম | পাত্রের যে বয়স হয়েছে বোঝা যাচ্ছে | এই বয়সেও বিয়ের কত শখ | আমি তো বিয়ে, প্রেম, পরিণয় এসব শব্দগুলো যেখানে তার থেকে শতহস্ত দূরেই থাকি | এই স্বার্থপর লোভী সমাজের থেকে আর কিছু পাওয়ার নেই, তাই |

||২||

মা বাবার পর দিদি এই মহান গুরুদায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে | দিদি নিজে বিয়ে করে সুখী, তাই বিয়েতে বিশ্বাসী, কিন্তু আমার ব্যাপারটা আলাদা, যেটা বোঝার মত মনের অবস্থা হয়তো এবাড়ির কারও নেই |

আস্তে আস্তে এখন এটাই সবার কথায়, ভাব ভঙ্গিতে বুঝেছি, আমি আরো একবার বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়লে সবার জন্যই মঙ্গল | কি মঙ্গল জানি না | তবে নিজের জন্য যে মঙ্গল সূচক কিছুই নেই, তা জানি |

যা হোক, বাড়িতে এই নিয়ে রোজনামচা বেশ কিছুদিন ধরেই চলছিল | ভেবে দেখলাম, নিজের ভালোমন্দর চিন্তা না হয় ছেড়ে দিয়েছি, এতে যদি আমার আশপাশের সবার সত্যিই মঙ্গল হয় তাহলে তাই হোক |

||৩||

‘কোন রকম সাজ সরঞ্জাম নয়, নিতান্ত সাধারণভাবে শুধু রেজিস্ট্রি টুকু সম্পন্ন হোক’, এই শর্তটা রেখেছিলাম | পাত্রপক্ষ সেই কথা মেনে নিয়ে যে আমার ইচ্ছার মর্যাদা দিয়েছে এতে আমি কৃতজ্ঞ |

আমার আরেকবারের বিয়েকে কেন্দ্র করে বাকি আত্মীয় স্বজনদের উল্লাসের শেষ নেই | সারা বাড়িতে আলো জ্বললেও জ্বলছে না শুধু আমার মনে |

একটা সময় হাউহাউ করে কাঁদতাম | সময় এগোতে থাকে, তারপর ঘরের কোণে মুখ লুকিয়ে কাঁদতাম, একটা সময় পর চোখের জল শুকিয়ে যায় | কষ্ট হলেও কাঁদতে পারি না আর এখন | অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে এখন | বার বার এটাই মনে হচ্ছে, আবার কি দরকার ছিল? এই তো বেশ ছিলাম, মা বাবার মুখ চেয়ে প্রথমবারও, আর এখনও | সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন নিজেই আহ্বান করছি |

ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় কপালের টিপটা ঠিক করছিলাম, এমন সময় দরজা ঠেলে দুটো ছোট্ট বাচ্চা ঢুকলো |

“তুমিই আমাদের নতুন মা?”

……..ওদের দুজনের প্রশ্নে আমি ক্ষনিকের জন্য হতবাক হয়ে রইলাম | মা-এর দেখা সুপাত্রর দুই সন্তানও আছে, একথা তো কেউ আমায় বলেইনি | হঠাৎ দেখলাম দরজা খুলে দিদি আর মাও এলো | আমি ওদের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলাম, বললাম,”তোমাদের নাম কী?”

“আমি ঐশিক” |

“আমি ঈশিকা” |

একটি ছেলে, একটি মেয়ে | দেখতে ভারী মিষ্টি, দেখেই মায়া পড়ে যাবে, এতো সুন্দর এরা | আমি বললাম,”তোমরা কোন ক্লাসে পড়?”

“আমি টু আর ঈশিকা লোয়ার ওয়ান |”

মা ওদের বাইরে যেতে বলল, ওরা আমায় টাটা বলে বাইরে গেল |

মা বলতে গেল কিছু, আমি থামিয়ে বললাম,”তোমার সুপাত্র যে দুই সন্তানের বাবা, সেটা আমায় বলার প্রয়োজন বোধ করোনি, এখন সেটা নিয়েই বলবে তাই তো?”

মা ইতস্তত করছিল, দিদিও কোনো ভাষণ দিতে উদ্যত হচ্ছিল, আমি দুজনকেই থামিয়ে,” থাক, বলোনি যখন এখনও নাই বা বললে |” বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম |

||৪||

রেজিস্ট্রি, মালাবদল, সিঁদুরদান ব্যস এই কটা উপাচারেই সীমাবদ্ধ সবটা | আমি একটু স্বস্তির নিঃস্বাস ফেললাম | এতক্ষন আমার হবু স্বামীর দিকে তাকাবার প্রয়োজন বোধ করিনি | সই করার আগের মুহূর্তে দেখলাম, এক ঝলক দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই জানি | বিয়ের আগে কোনো দেখা সাক্ষাৎ, কখনো কথাও বলিনি, কিন্তু দেখে আমার মনে হলো, মানুষটা সৎ, চোখ দুটো স্বচ্ছ | ভিতরে এক আর বাইরে এক এরকম মানুষ নয় হয়তো |

বিয়ের উপাচার মিটতেই ঐশিক আর ঈশিকা আমার কাছে এল | ওদের মুখে ‘নতুন মা’ ডাকটা শুনে শত কষ্ট বুকে চাপা থাকলেও সত্যি শান্তি পেলাম | ওদেরকে পাশে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ” ডাকনাম দুটি কী শুনি?”

টুকাই আর টুকুন, ভারী মিষ্টি নাম | হঠাৎ খেয়াল হলো আমি আমার স্বামীর নাম টুকুও তো জানি না এখনো | বিয়ের আগে মা বাবার কথায় শুনেছি একটা নাম ঈশান | ওটাই কী?

হ্যাঁ, ওটাই, টুকুনদের থেকে জানলাম ওদের বাবা ঈশান লাহিড়ী |

||৫||

মিঃ ঈশান লাহিড়ীর বাড়ি থেকে আর আমার বাড়ি থেকে একটা জয়েন্ট রিসেপশন ছোট করে দেওয়া হয়েছিল | মিটতে রাত হলো | এবাড়ি আসা থেকে টুকাই আর টুকুনই আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী |

ফুলশয্যার কিছু নিয়ম কানুন করার পর আমি খানিক বিরক্ত হয়েই ঘরে ঢুকলাম | ফুলশয্যার খাট দেখেই মনের ভিতরটা জ্বলে উঠল, ইচ্ছা করলো সবকিছু ছিড়ে ফেলি, ভেঙ্গে সব তছনছ করে দি | এতো ন্যাকামোর কী খুব দরকার ছিল? টুকাই আর টুকুন ছিল তাই রক্ষে | ওরা অতসুন্দর খাট দেখে আনন্দে খাটে উঠে লম্ফ-ঝম্ফ শুরু করেছে | ফুল নিয়ে খেলছে ছিঁড়ে ছিঁড়ে, আমি সোফায় বসে ওদের প্রাণ ভরে দেখছিলাম |

এমন সময় ঈশান বাবু ঘরে এলেন | ফটোয় যতটা বয়স লেগেছিল, ততটা বয়স সামনে থেকে মনে হয় না | ঢুকেই টুকাই আর টুকুনকে আলতো করে ধমক দিলেন | আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, ” আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না |” এই প্রথমবার ঈশান বাবু সরাসরি আমার দিকে চাইলেন, তাকিয়েই মুখ ঘুরিয়ে ওদের বললেন অন্য ঘরে যেতে | আমি বললাম, “থাকুক না” | ওরাও যেতে চাইছিল না | কিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যেই ওদের পিসি মানে আমার ননদিনী ওদের নিয়ে গেলেন | দরজা বন্ধ করে ঈশান বাবু খাটে সোজাসুজি আমার সামনে বসলেন |

দরজাটা বন্ধ করায় আমার প্রবল অস্বস্তি হচ্ছিল | ঈশান বাবু আমায় সহজ করে দিয়ে বললেন,”আপনাকে কিছু কথা বলার ছিল, বিয়ের আগে কখনোই বলার সুযোগ হয়নি, তাই এখনই বলতে চাই |”

আমি বললাম,”তা বেশ বলুন না |”

“আমার আপনাকে বিয়ে করার একমাত্র কারণ আমার দুই সন্তান |” বলে ঈশানবাবু উঠে দাঁড়ালেন | “আমার স্ত্রী, প্রেমিকা, যাই বলুন না কেন, সেটা আমার প্রথম স্ত্রী স্বাগতা, টুকুনের জন্মের সময় মারা যায় |” বলে আমায় পর্দা সরিয়ে ঘরেরই আরেকটা অংশে নিয়ে গেলেন, এদিকটা আসিনি আগে | এই অংশটায় ঈশানবাবুর পড়ার টেবিল, চেয়ার, অজস্র বই, আর তার মাঝেই দেয়ালে ঝুলছে ওনার প্রথম স্ত্রীর ছবি, টাটকা জুঁই-এর মালায় |

আমি ছবিটার দিকে তাকিয়েই ছিলাম,উনি বিশাল বাঁধানো ফটোটার দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই হলো আমার স্বাগতা | ও জুঁই খুব ভালবাসতো |” বলে মুগদ্ধ দৃষ্টিতে স্বাগতার দিকে চেয়ে রইলেন | আমি অবাক হয়ে ওনাকে আর ফটোয় বন্দী নারীকে দেখছিলাম, যেন ধ্যান মগ্ন ঋষি, চারপাশের পার্থিব সব কিছুকে তুচ্ছ করে ধ্যান জ্ঞান শুধুই ওনার স্ত্রী, ওনার ভালবাসা | ভালবাসা তো এরকমই হওয়া উচিত, তাই না? শাশ্বত, যা কোনদিন বদলাবে না | কিন্তু কজনের ভাগ্যেই বা এটা জোটে? ওনার এই রূপ দেখে আমার সত্যি তাই খুব ভাল লাগল | সত্যিকারের ভালবাসতে এখনো তাহলে কেউ কেউ পারে |

কিছুক্ষন পর প্রশ্ন করলাম,”ভালবাসেন এত এখনও?”

ঈশানবাবু ফটো ফ্রেমের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে উত্তর দিলেন,”খুব” |

ব্যস এর বেশি কিছু বলার প্রয়োজনও ছিল না আর ,আইনত ওনার স্ত্রী হলেও ওনার আর আমার মধ্যে একটা দেওয়াল সব সময়ই তোলা ছিল | সেই দেয়ালের গন্ডি পেরিয়ে আমিও এগোতে চাইনি, উনিও না | ঈশানবাবু নিজেকে নিয়েই মগ্ন থাকতেন, পার্থিব কোন কিছুর সাথে যেন ওনার কোন যোগাযোগই নেই | এভাবেই সময় তার নিয়মে এগোতে লাগল |

||৬||

এবাড়িতে আসার পর আমার প্রথম জন্মদিনটা এসে পড়ল | টুকাই আর টুকুনের দৌলতে আমার জন্মদিনটা মনে পড়লো তাও | এবাড়িতে টুকাই আর টুকুনই আমার কাছে এক ঝলক মুক্ত বাতাস | ওদের হাজারো দুস্টুমি, অবুঝ সারল্য, ওদের খেলা, সবকিছুর সাথেই আমি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যাচ্ছি | আর এই মায়ার বাঁধনটা ভালও লাগছিল আমার, আর কিছু না পাই এদের ‘ছোট মা’ তো হতে পারলাম, এটাই বা কম কী | তাই দিনের বেশির ভাগ সময়টাই কাটে আমার ওদের নিয়ে | প্রথম থেকেই ওদের আপন করে নিয়েছিলাম আর ওরাও আমায় অনেক ভালোবাসা দিয়েছে |

শ্বশুর মশাই, শ্বাশুড়ি মাও খুব ভাল | অন্তত আমার ভালো লাগা খারাপ লাগার খেয়াল টুকু রাখেন | আমি খুব একটা খারাপ নেই এটা স্বীকার করতেই হয় |

অফিস যাওয়ার আগে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গোছাচ্ছিলাম, দুস্টু দুটো আমার ঘরে এসে আমায় উইশ করলো | আমি বললাম, “কী গিফ্ট দিবি তোদের ছোট মাকে?”

টুকুন ঝুঁটি দুলিয়ে উত্তর দিল,”দুইখানা গিফ্ট আছে তোমার জন্য” বলে এক খানা চকলেট-এর সেলিব্রেশন প্যাক আমার হাতে দিল | অনেকদিন পর পছন্দের চকলেট গিফ্ট পেয়ে মনটা খুশি হয়ে গেল, আমি বললাম,” থ্যাংক ইউ, আমার সোনা দুটো | আর একটা গিফ্ট?”

টুকাই আর টুকুন আমার গলা জড়িয়ে ধরে সমস্বরে বলে উঠল,”আজ থেকে তোমায় নতুন মা না, শুধু মা বলব |”

……এই মুহূর্তটা আমার কাছে অন্যতম সেরা মুহূর্ত হয়ে থাকবে, আমি এভাবে কোনদিন আমার দুই সন্তানকে পাব, কোনদিন মা হব, কল্পনাই করিনি | ওদের এই আধো আধো কথায়, নরম হাতের ছোঁয়ায়, ওদের দুস্টুমিতে, ওদের পাগলামিতে আমি আজ সত্যিই সম্পূর্ণ হলাম | আমি জিজ্ঞেস করলাম,” এত বড় ক্যাডবেরি তোরা পেলি কোথায়?”

টুকুনবাবু বিজ্ঞ হয়ে উত্তর দিলেন,”কেন, কালই তো বাবাকে দিয়ে আনিয়ে রেখেছিলাম আমরা |”

আমি শুনে বললাম,”বাবা জিজ্ঞেস করেনি কেন?”

টুকাই বলল,”হ্যাঁ করেছে তো, আমরা বললাম আজ মা-র জন্মদিন |”

মানে ঈশানবাবুও জেনে গেছেন | একবারও উইশ করলেন না তো? ধুর কী সব আজেবাজে জিনিস ভাবছি | ভাবনায় বিরতি টেনে অফিস বেরলাম |

||৭||

অফিস কলিগদের পক্ষ থেকে ছোট খাটো একটা পার্টি ছিল, সেরে ফিরতে রাত হলো | রাতে বাড়িতে আমার মা বাবা, শ্বশুর শাশুড়ি মা, বাড়ির সবাই মিলে (ঈশানবাবু ছাড়া) একটা ছোট পার্টি রেখেছিল | সব মিটিয়ে ঘরে যেতে যেতে অনেকটা রাত হলো | ঈশানবাবু এসবের মধ্যে ছিলেন না, উনি ওনার স্টাডিতে ছিলেন | আমিও আশা করিনি যে উনি থাকবেন | ঘরের এদিকের অংশে আলো নিভিয়ে শুতে গেলাম | শরীরটা বেশ খারাপ লাগছে, মনে হচ্ছে জ্বর আসবে | এমন সময় রাতদুপুরে উনি এসে একটা ডায়েরি আর পেন দিলেন আর শুভ জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালেন | আমি হেসে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, “একটু বেশিই তাড়াতাড়ি শুভেচ্ছা জানিয়ে ফেললেন যে | “

উনি হেসে বললেন,”কী করব বলুন, আপনাকে একা পাওয়াই তো মুশকিল | তাই এটাই সঠিক সময় মনে হলো | এই ডায়েরিতে নিজের মনের সমস্ত কথা লিখে হালকা হবেন | আচ্ছা আমি তো আমার জীবনের কথা আপনাকে বলেছি, আপনি কখনো বলেননি তো?”

আমি মৃদু হেসে উত্তর দিলাম,”আপনি তো কখনও জানতে চাননি |”

-“বেশ আজ জানতে চাইছি, বলুন না |”

-“কি আর বলব? বলার মত সেরকম কিছু নেই | তথাকথিত স্বামী শব্দের আড়ালে একজন এমন মানুষকে পেয়েছিলাম যে নারীদের শরীর সর্বস্ব, বাড়ির কাজ সামলানো, আর সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র ছাড়া কিছুই ভাবত না | তাও চেষ্টা করেছিলাম, লাভ হয়নি | মা হওয়ার চেষ্টা করেছিলাম, সেটাও হয়নি | টেস্ট শুধু আমার হয়েছিল, পুরুষের কোন খামতি থাকতেই পারে না, এই ধারণায় বিশ্বাসী ছিল ওবাড়ির লোকজন | টেস্ট সব নরমাল ছিল, তাও বংশ রক্ষা করতে পারলাম না বলে অশান্তি চরমে উঠছিল | আর সইতে পারিনি, ভেঙে যায় তারপর বিয়েটা |”

অতীতের ক্ষতগুলো সামনে আনতে গিয়ে বহুদিন পর আবার কখন চোখ দুটো দিয়ে নোনতা জলের ধারা বইতে শুরু করেছে সে খেয়ালই করিনি | ঈশানবাবু হঠাৎ আমার হাতটা শক্ত করে ধরলেন, বললেন,”এই যে বলে হালকা হলেন, কাঁদলেন, এবার দেখবেন ভাল লাগবে | অনেক রাত হলো, শুয়ে পড়ুন |”

সত্যিই অনেকদিন পর কেঁদে অনেকটা হালকা লাগছিল | উনি অজান্তেই আমায় অনেক কিছু দিয়ে দিলেন | টুকাই টুকুনের মা হতে পেরে আমি সত্যি সুখী আজ | এসব ভাবতে ভাবতেই শুয়ে পড়লাম |

||৮||

ঘুম ভাঙল, একটা ঘোরের মধ্যে, বুঝলাম গায়ে জ্বর | কিন্তু ওঠার ক্ষমতা নেই, গলা শুকিয়ে কাঠ, কাকে ডাকব | ঈশানবাবু স্টাডিতে ঘুমোচ্ছেন, বার দুই চেঁচিয়ে ডাকলাম | কোন সাড়া নেই | জ্বরের ঘরেই বেহুঁশ হলাম |

যখন জ্ঞান এলো, দেখলাম আমার কপালে জলপট্টি দেওয়া হচ্ছে | টুকাই টুকুন কাঁদোকাঁদো মুখে আমার খাটের পাশে দাঁড়িয়ে | শাশুড়িমা আমার জ্বর কমলো কিনা দেখছেন থার্মোমিটার নিয়ে | মাথা ঘুরিয়ে তাকাতে দেখলাম ঈশানবাবু আমার মাথায় জলপট্টি দিচ্ছেন, দেখেই ওঠার চেষ্টা করলাম | কিন্তু উনি আমায় উঠতে বাধা দিলেন, বললেন,” আপনি আমায় একবার ডাকতে তো পারতেন, আমি তো পাশেই ছিলাম |”

আমি অতিকষ্টে উত্তর দিলাম,” ডেকেছিলাম, সাড়া পাইনি |” শুনে দেখলাম ওনার মুখটা এমন হয়ে গেল যেন অত্যন্ত লজ্জিত | আমি মনে মনে হেসে ফেললাম |

আমার টাইফয়েড ধরা পড়ে | সুস্থ না হওয়া অবধি ঈশানবাবু আমার সাথে খাটেই শুতে লাগলেন যাতে অসুস্থ অবস্থায় কোন অসুবিধায় না পড়ি | মাঝে একটা বালিশের প্রাচীর থাকত | আমি কোনদিনই সেই প্রাচীরকে কেউ টপকাক চাইনি |

একদিন কোনভাবে ঘুমের ঘরে নিজেকে আবিষ্কার করলাম ওনার বুকে | এক মুহূর্তের জন্য হলেও আমার ভাল লেগেছিল, মিথ্যা বলব না, সত্যিই ভাল লেগেছিল | আমার হাতটা ওনার বুকে রাখি, কিন্তু পরক্ষনেই মনে পড়ে, এ জায়গা তো আমার নয়, এ জায়গা তো সেই মহিলার যিনি না থেকেও আজও জীবিত ওনার মনে প্রাণে | আমি সঙ্গে সঙ্গে সোরে যাই |

||৯||

জানি না কি পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু কিছু তো পরিবর্তন হয়েইছে | এখন অনেকটা সুস্থ, কিন্তু অসুস্থ হয়েই যেন বেশি ভাল ছিলাম | কারণ, অসুস্থ অবস্থায় যে উদ্বিগ্নতা, যে চিন্তা ঈশানবাবুর চোখে দেখেছিলাম, তা আমার জন্যই ছিল, সেটা বার বার কেন জানি না আবার দেখতে ইচ্ছে করছে |

ঘর গোছাতে গোছাতে ফটোফ্রেমে বন্দি সেই নারীর দিকে চোখ গেল | প্রথম যেদিন দেখেছিলাম সেদিন তো এরকম ছিল না | আজ কেমন যেন হিংসা হচ্ছে | ‘তুমি না থেকেও তার হৃদয়ের সর্বস্বটা জুড়ে বসে আছ, আর আমি তার এত কাছে থেকেও…..’| এসব কি হাবিজাবি ভাবছি আমি? কেন এরকম হচ্ছে, এই প্রথম কারও জন্য ভাবতে ভাল লাগছে | কই আমার প্রথম বিয়েতেও তো কখন এরকম হয়নি | তাহলে এখন কেন? আমার তো এসব হওয়ার কথা নয় | তাহলে কি শেষ বেলায় এসে আমিও ভালবেসে ফেললাম? আমার জন্য ভালবাসা জিনিসটাই নয়, এটাই জানতাম এতদিন | আজ সবকিছু কিরকম ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে |

||১০||

দিন যেতে লাগল, আমি আস্তে আস্তে একটু একটু করে প্রেমে পড়েই গেলাম ঈশানবাবুর, উনি আমায় ভালবাসেন না জেনেও | রোজকার মতো রান্নাঘরে এসব ভাবতে ভাবতেই সকালের কর্মকান্ড শুরু করি | অন্যমনস্ক থাকার জন্য বুঝতেই পারিনি টুকুনটা কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে | ওকে পড়া ধরতে ধরতেই হাতের কাজ সারছিলাম | পিছন ঘুরে অন্যমনস্ক ভাবে কাজ করতে করতে খেয়ালই করিনি, কখন রান্না ঘরের গ্যাস থেকে আগুন লেগে গেছে | কিছু বোঝবার আগেই আগুন অনেকটা ছড়িয়ে পড়েছিল রান্নাঘরে | যেভাবে হোক টুকুনকে এখান থেকে বের করতে হবে, এটাই খেয়াল ছিল | রান্না ঘরের দরজা ছোট, আর সেখানেও আগুন পৌঁছে গেছিলো | কোনোক্রমে টুকুনকে কোলে নিয়ে রান্নাঘরের বাইরে শ্বশুর মশাই-এর কোলে ছুড়েদি | রান্নাঘরের দরজায় দাউ দাউ করে আগুন ততক্ষনে জ্বলতে শুরু করেছে, বেরোনোর সুযোগই পেলাম না |

*****************

জ্ঞান হারানোর আগে শুধু মনে আছে কি প্রচন্ড যন্ত্রনা, জ্বালা ব্যস | জ্ঞান ফিরলে জানতে পারি আমার পায়ের দিকের বেশ কিছুটা অংশ আগুনে পুড়ে যায় | আমার প্রায় দেড় দিন পর জ্ঞান ফিরেছে | সারা শরীরে অসহ্য কষ্ট, বুঝতে পারছিলাম না আর বাঁচব কিনা | কিন্তু যখন জানতে পারি এই দেড় দিন ঈশান নার্সিং হোম থেকে এক পাও নড়েননি, ঠায় বসে আছেন, তখন খুব ইচ্ছা করছিল মরি বা বাঁচি, একবার ওনাকে দেখতে |

ও যখন আসে ওঁর চোখের জল, বিহ্বল দৃষ্টি আমায় সবটুকু বুঝিয়ে দিয়েছিল | সবসময় হয়তো ‘ভালবাসি’ শব্দটা বলার দরকার পড়ে না |

||১১||

ঈশানই বলি আমি এখন | আপনি থেকে তুমির যাত্রাটা সহজ ছিল না | গায়ের পোড়া দাগগুলো দেখে মনে হয়, ভাগ্যিস সেদিন ঘটনাটা ঘটেছিল, তাই ও আমায় হারানোর ভয় পেয়েছিল, উপলব্ধি করেছিল ওর মনে আমার জন্য জন্মানো ভালবাসার ছোট্ট চারাগাছটাকে | নার্সিং হোমের রুমে ওর বলা,’ তুমি অন্তত আমায় এক করে দিয়ে যেওনা ‘ কথাটাই আমার কাছে হাজারটা ‘ ভালবাসি ‘ বলার সমান |

আজ আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী | টুকুন, টুকাই-এর সাথে সাথে আরও একজন আসতে চলেছে | গর্ভে বেড়ে উঠছে ছোট্ট ঈশান বা ছোট্ট দেবলীনা, কি জানি? দেরিতে হলেও, ঈশান আজ তোমার জন্যই আমি সম্পূর্ণ হলাম |

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

মুক্তি

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেল, আকাশ তখন থেকে ঠায় বসেই রয়েছে ঘাটে। এখন বাঁধানো ঘাট থেকে করিডোর হয়ে বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরে পুজো দেওয়া অনেকটা সহজ

Read More »

বন্ধু হবি চল

বাক্সপেটরা নিয়ে স্টেশনেই বসে ছিল নয়না, বৃষ্টি পড়েই চলেছে, মুষলধারায়। বাবা বলল আরেকটু অপেক্ষা করতে, এত বৃষ্টিতে তো ছাতাও হার মানবে, আর বেরিয়ে রাস্তাও অজানা

Read More »

টিফিনবাক্স

প্রতিবারের মতন এই বছর ও সমস্ত সরঞ্জাম গুছিয়ে বেরোনোর জন্য ব্যস্ত অমিত, অন্তত সন্ধ্যার মধ্যে বেরোতে না পারলে খুব মুশকিল। পুজোর দিকটা কতদূর কি হলো

Read More »

ক্লিক

।।১।। -“মালিনী, কালকের মিটিংটা কখন ফিক্স করেছ? -“ম্যাম, সকাল ১১টা।” -“ওকে, কনফার্মেশন পেয়ে গেছ?” -“ইয়েস ম্যাম।” -“ওকে গুড। আর।।। এক মিনিট।।।” টেবিল থেকে ফোনটা তুলে

Read More »

শিক্ষা

।।১।। দাপুটে, বদরাগী, মেজাজি এই সব কটা বিশেষণই বেশ ভালো যায় মিসেস বোসের সাথে। রেণুকা বোস আর অমরনাথ বোস সানফ্লাওয়ার এপার্টমেন্টে ১২০০ স্কোয়ারফিটের ফ্ল্যাট 2c

Read More »

বিদায়

।। ১।। রীতিমত জোর করেই নন্দিনীকে পাহাড়ে নিয়ে এলো সঙ্গীতারা। আসার ইচ্ছে তো ছিল না ওর একদমই, শরীর সাথ দিলেও মনটা কোনোভাবেই সাথ দিচ্ছে না।

Read More »

Share with