ওরে সমাজ কবে পাল্টাবি?

 ore-samaj-kbe-paltabi muktodhara story

||১||

“সোনা, ভাতটা তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও, মাম মাম-এর আরো অনেক কাজ আছে তো |”, ভাতের দলা নিয়ে ছোট্ট চিকুর পিছলে দৌড়ানো এখন আমার রোজনামচা হয়ে দাঁড়িয়েছে | চিকু আমার একমাত্র ছেলে, এই বৈশাখে পাঁচে পড়বে | ঠাকুমা, দাদুর মানিক, আর ওর বাবার ‘বাবুসোনা’ সবার আদরে ভালবাসায় আজ কত্ত বড় হয়ে গেল, যেন এই সেদিনের কথা, ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে গেছলাম, আবার আমায় ফাঁকি দিয়ে চিকু পালাল |

চিকুর কল্যাণে ঘরগুলোর যা অবস্থা, তা না বলাই ভাল | একটু বড় হওয়ার পর থেকেই এমন কোন জিনিস নেই যা নিয়ে চিকুবাবুর পরীক্ষা করা হয়নি, সে আমার সাধের লিপস্টিকই হোক বা বাবার শেভিং ক্রিম, ঠাম্মার ধূপের কৌটো বা দাদুর নকল দাঁত | এভাবেই সবার নয়নের মণি চিকু পাঁচ বছরের হয়ে গেল প্রায় |

রাতে খাবার টেবিলে অনীক মানে চিকুর বাবা, আমার শ্বশুর মশাই-এর কাছে একটা কথা পাড়ল, যদিও ইচ্ছেটা আমার ছিল, “বাবা, ভাবছি এই বৈশাখে চিকুর জন্মদিনটা বড় করে করব | তুমি কি বল?”

শ্বশুর মশাই সহাস্যে প্রস্তাবে সম্মত হলেন | আমিও শান্তি পেলাম | এখনও শ্বশুর মশাই-এর কথা ছাড়া এবাড়িতে একটি পাতাও নড়ে না | আমিও শ্বশুর মশাইকে যথেষ্ট ভয় করেই চলি, কিন্তু এই ‘চলি’ শব্দটাই ক’দিনের মধ্যে ‘চলতাম’ হয়ে যাবে আমি নিজেও ভাবিনি | এরকম কোন কান্ড ঘটতে পারে আমি নিজেও জানতাম না |

||২||

আমাদের বাড়ির কিছুটা দূরেই একটা বস্তি আছে | মালতী ওখানেই থাকে, ও গরিব কিন্তু খেটে টাকা রোজগার করে আর ওর এই শক্ত মেরুদন্ডটাই আমায় বাধ্য করে ওর কাজকে সম্মান করতে | ও সেলাই করে দিন গুজরান করে, আমি ওকে দিয়েই আমার প্রয়োজনীয় সব কিছু সেলাই করাই | ওর একটা ছোট্ট ছেলেও আছে, কত আর বড়, চিকুর থেকে বছর খানেকের বড় হবে হয়তো | কি ভাগ্য বেচারার, আমি ওর জন্য যথাসাধ্য করার চেষ্টা করি |

বিয়ের পর থেকেই যন্ত্রের মত শ্বশুর মশাই-এর শর্তাবলী মাথা পেতে পালন করে গেছি | কোনদিন কিছু বলিনি অনীকের মুখের দিকে তাকিয়ে | অনীক বারবার আমায় এটা বলেই থামিয়েছে যে বাবা আর কতদিন বাঁচবেন? যতদিন থাকবেন ওনাকে ভাল রাখার দায়িত্ব তো আমাদেরই | হক কথা! তাই আমিও কিছু বলতাম না, কিন্তু ভাল রাখাটাও যেমন দায়িত্ব তেমন অন্যায়ে প্রতিবাদটাও জরুরি এটা অনুভব করতে আমার বোধ হয় একটু দেরী হয়ে গেছল |

||৩||

রোজকার মতো সকালে আমাদের গেটের সামনে কাগজওয়ালা, দুধওয়ালা আর ফুলওয়ালা সব দিয়ে চলে যায়, আমি সাতটা নাগাদ গিয়ে তুলি | আজও নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি | ওগুলো তুলে আনতে গিয়েই একটা বড়সড় জটলার আওয়াজ পাই | কিছু বুঝতে না পেরে ব্যালকনিতে এসে দেখি সামনে বিশাল ভিড় | আমি তাড়াতাড়ি হাউস-কোর্টটা জড়িয়ে নীচে নেমে পড়ি, গিয়ে দাঁড়াতেই পাশের বাড়ির রেখা বৌদিকে দেখতে পাই, ওকে জিজ্ঞেস করতেই পুরোটা জানতে পারি, আর আশপাশের লোকজনের থেকেও শুনি সবটা | সব শুনে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায় | আমি কোনক্রমে উপরে উঠে দরজা দি, তখনও একটা ঘোরের মধ্যে | ওদিকে ঘড়ির কাঁটা তো থেমে নেই, ঘুরছে, অফিসেও বেরতে হবে | যন্ত্রচালিত-র মতো সব কাজ করতে থাকি | কখন থেকে অনীক আমায় খেয়াল করছে, বুঝতেই পারিনি |

হঠাৎ পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে যখন জিজ্ঞেস করল,”কি হয়েছে আজ আমার বৌটার”, তখন আমার টনক নড়ল | আমি শুধু ওর দিকে একবার তাকালাম, আমার চোখের ভাষা পড়তে অনীকের খুব একটা সময় লাগেনা, ও বুঝলো কিছু তো একটা হয়েছে | অনীক বুঝতে পেরে মাথা নাড়ল,”কি হয়েছে?”

-“মালতী আজ ভোরে রেপড হয়েছে |”

“হোয়াট?” অনীক হতবাক হয়ে চেঁচিয়ে উঠল |

-“আরে আস্তে, হ্যাঁ, ঠিকই বলছি, তুমি বাইরে বেরবে যখন বাজারে, তুমিও জানতে পারবে |”

-“কিন্তু এসব হলো কী করে?”

-“সে কী করে জানব? বাচ্চাটাই বা কোথায় কে জানে?”

-“তুমি কিন্তু এখন কোনভাবেই ওখানে যাবে না |”

-“মানে? এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল আর আমি ওর পাশে যাব না একবার?”

-“তুমি কী পাগল হয়ে গেছ? আমাদের বাড়ির একটা সম্মান আছে, আর বাবাই বা কী বলবেন? তুমি একদম এসব মাথাতেও আনবে না |”

আমি অবাক হয়ে অনীকের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম |

অনীক বলল,”এভাবে কেন দেখছো?”

আমি বললাম,”বাবা কী বলবেন জানতে চাই না, তুমি কী বলবে সেটা জানতে চাই |”

গলা খাঁকারিতে আমাদের কথাবার্তা তখনকার মতো স্থগিত হলো |

এরকম একটা চটপটা, মশলাদার খবর পাড়ায় ছড়াতে বেশী সময় লাগে না, এক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি | এরকম কোন ঘটনা ঘটলে পাড়া প্রতিবেশী থেকে শুরু করে সবাই মিলে ধর্ষিতা মেয়েটির ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট লেখার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন | আমার বাড়িতেও তাই-ই হচ্ছে |

আমার শ্বশুর শাশুড়ির কথোপকথন অনেকটা এরকম শুনতে পেলাম-

-“এই সব ক্লাসের এরকমই হয় |”

-“তা না তো কী, গতর দেখিয়ে পয়সা রোজগার করে, নে মর এবার |”

-“তোমার বৌমা তো বেশ মেলামেশা করে দেখি, বারণ করে দিয়ো আবার ওর ঘরে গিয়ে যেন উপস্থিত না হয় আদিখ্যেতা দেখাতে |”

-“অত সাহস নেই, তাও আমি বলে দেব |”

আরও কথা বলতে থাকে, আমার আর শোনার ইচ্ছা নেই | নিজের ভিতর যেন জিদটা হঠাৎ করেই বাড়তে থাকে যত বারণ শুনছি তত | ‘যাব তো আমি বটেই, দেখি কে আটকায়?’, নিজেকে এটাই বললাম |

অদ্ভুত এই সমাজ, এতদিন মালতী সম্পর্কে কিছু ভাবা তো দূর, কিছু বলেওনি, করেওনি, আর আজ মালতী কী কাজ করে, ঠিকুজী কুষ্ঠি সব জেনে বসে আছে, আর নিজেকে উচ্চ বংশের বংশধর দাবী করে | আর সেই তথাকথিত উচ্চ বংশের বাড়িতে বসেই নোংরা, সর্বোপরি মিথ্যা কথা নিয়ে আলোচনা করছে, যার সত্যতা যাচাই করবার প্রয়োজনটাই বোধ করেনি |

কিছুক্ষন পর শাশুড়ি মা উঠে এসে বললেন, আজ পারলে একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরো, আজ একবার গুরুদেবের কাছে যাবো, তুমি ফিরলে যেতে পারব |

“হবে না মা”,সটান উত্তর দিয়েই ফেললাম, কিভাবে জানি না, তখন কি শক্তি ভর করল আমার উপর |

শাশুড়ির মুখের উপর “না” বলে দেব ভাবতে পারেননি অবশ্যই | একটু হতচকিত হয়ে আরেকবার বললেন,”হবে না মানে?”

“হবে না মানে ফেরার পথে মালতীর কাছে যাব, অফিস জরুরি মিটিং আছে নয়তো এখনই যেতাম |”, বলেই ওনাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বেরিয়ে গেলাম |

||৪||

সন্ধ্যেবেলা মালতীর ঘরের দরজাটা অবধি পৌঁছে চোখের জলকে আটকাতে পারছিলাম না | ছোট ছেলেটা হয়তো এখনো কিছুই খায়নি, বুঝতেও পারছে না কি হয়েছে | ওর জন্য খাবার কিনে এনেছিলাম, ওকে দিতেই ও আমায় জড়িয়ে ধরল | মালতী আমায় দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ল আমার বুকে | ওকে সান্তনা দেবার ভাষা বা ইচ্ছা কোনটাই আমার নেই | আমাদের সমাজে ধর্ষিতার লজ্জা সরম হওয়া উচিত, সে নোংরা, অপবিত্র ! অথচ ধর্ষক বুক ফুলিয়ে সমাজে ঘুরে বেড়াতে পারে | এখানেও তার ব্যতিক্রম নেই, বস্তি থেকে তাড়িয়ে দেবে বলেছে আজ রাতের মধ্যে ঘর না ছেড়ে দিলে |

পুলিশ অন্তত তার কাজটা ঠিকঠাক করছে, যে জানোয়ার এই কাজ করেছে ধরা পড়েছে এখন পুলিশ হেফাজতে | আমি সব শুনে বললাম,”চল, সব গুছিয়ে নে |”

মালতী ঠিক বুঝতে না পেরে বলল,”দিদি, আমি মরে যাবো বিষ খেয়ে, কিন্তু এই ছেলেটার কি হবে?”

আমি ওর চোখে চোখ রেখে বললাম,”না তুই মরবি, না তোর ছেলে তোকে ছেড়ে থাকবে, তুই তো কোন দোষ করিসনি যে মুখ লুকিয়ে থাকবি | যে এই নোংরা কাজটা করেছে তাকে মুখ লুকিয়ে থাকতে হবে, তোকে নয় | কথা বাড়াস না, অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে | তুই আমার বাড়িতে থাকবি, যতদিন না ঝামেলা মিটছে |”

অফিস থেকে ফিরতে রাত হয়েছে, এটাই যথেষ্ট ছিল আমার ওপর অজস্র বাক্যবর্ষণের জন্য, তার উপর যখন আমার বাড়ির লোক দেখল আমি মালতী আর ওর ছেলেকেও নিয়ে এসছি, তখন হয়তো শুধু আমাকে মারতেই বাকি ছিল |

“তুমি এই নোংরা মেয়েটাকে আমাদের বাড়ি তুলে এনেছো বৌমা? আমি তোমার দুঃসাহস দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি”, আমার শাশুড়িমা বললেন | শ্বশুর মশাই তো আমার মতো অবাধ্য, অসভ্য মেয়ের ‘বেয়াদপি’ দেখে কথা বলার ইচ্ছাই হারিয়েছেন | অনীক শুধু কিছু বলল না তখন |

-“মা কালপ্রিট তো ধরা পড়েছে, এই অবস্থায় ওকে ওখানে একা রাখা সেফ হবে না, আর বাচ্চাটা আমাদের চিকুর থেকে কত বড়? এতটা অমানবিক কি করে হব? আর বস্তিতে ওদের আর থাকতে দেবে না, বের করে দিয়েছে, ও কোথায় যেত?”

-“সে ভাবনা ভাবার গুরু দায়িত্ব তোমায় কে নিতে বলেছিল বৌমা? কই আর কেউ তো নেয়নি সেই দায়, তুমিই কেন? আর এসব পাপ এবাড়িতে ঢুকবে না, কার না কার পাপ | এই নোংরা মেয়ে আর ওর এই পাপ এ’বাড়ির চৌকাঠ পারবে না, তোমার শ্বশুর মশাই-এর কথাকে অমান্য করবে?”

-“বাবা যা বলবেন, তার সব কথা শোনার দায় নিয়ে তো আমি বসে নেই মা, আর পাঁচজন দায়িত্ব নিলে তো মিটেই যেত | কাউকে না কাউকে তো দায়িত্ব নিতেই হতো, সেটা না হয় আমিই নিলাম | আর যাকে পাপ বলছেন, সেও একটা গরিব মায়ের সন্তান | গরিব বলে কী যা খুশি বলে যাবেন? ওরা এবাড়িতেই থাকবে, দেখি কে আমায় আটকায় |”

জানি না তখন কোন শুভ শক্তির জোরে আমি এত বড় একটা কান্ড ঘটাতে পেরেছিলাম, শেষ মেশ ওদের আমার বাড়িতে রাখতে সক্ষম হই, সবার প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও | শুধু অনীক আমার পাশে ছিল,”যা করবে ভেবে চিন্তে কোরো “, ব্যস আর কিছু বলেনি ও |

||৫||

মাস খানেক কেটে গেছে, মালতী আর ওর ছেলে আমার বাড়িতেই থাকে | কেস চলছে, ইতিমধ্যে আমার ছোট্ট চিকুর জন্মদিন এসে পড়েছে | বাড়ি ভর্তি লোক, মাঝে মাঝেই টিপ্পনী শুনছি, কিন্তু তাতে আমার এখন কোন যায়ই আসে না |

চিকুর পাঁচ বছরের জন্মদিন, মালতীর ছেলেটাও ওর বয়সীই, ওর জন্যও নতুন জামা, জুতো কিনে দিলাম | ছোট্ট শিশুর মন কী গরিব বড়লোকের ভেদাভেদ মেনে স্বপ্ন দেখতে পারে? ওদের স্বপ্ন তো মুক্ত |

চিকুর দাদু দিদা, ঠাকুমা, ঠাকুরদা সব ওকে নানা সোনা রুপোর উপহার দিয়েছে | দুপুরে ভাত খাওয়ানোর সময় পরাবো ভেবে আমার ঘরের ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখলাম | সকাল থেকে লোকজনের আনাগোনা তাই সদর দরজাও খোলা, কখন কে আসে | দুপুরে ভাত খেতে বসানোর সময় রুপোর থালা বাসনে সব সরঞ্জাম সাজিয়ে চিকুর পাওয়া হার, আঙটিগুলো আনতে ঘরে গিয়ে দেখি, ড্রেসিং টেবিলের উপর কিছু নেই, পুরো খালি | তন্ন তন্ন করে পুরো ঘর খুঁজলাম, অনীককে ডাকলাম, অনীকও দেখল, কোথাও পাওয়া গেল না | আমার তো মাথায় হাত, এবার কী হবে |

এমন সময় আমার পিসি শাশুড়ি বলে উঠলেন, “এরকম তো হওয়ারই ছিল, নোংরা ছোটলোকদের বাড়ি ঢোকালে এসব তো হবেই |”

আমি শুনে বলে উঠলাম,”মুখ সামলে কথা বলুন পিসিমা, কাকে কি বলছেন? আর কিসের ভিত্তিতে এসব বললেন?”

-“ঠিকই বলছি গো, চোখ খুলে দেখ ওই বাচ্চাটা আর নেই বাড়িতে | নির্ঘাত আগে ছেলেটাকে পাঠিয়ে দিয়েছে, এবার নিজেও পালাবে |”

সত্যিই তো মালতীর ছেলেটা তো নেই, মালতীর উপর চেঁচামেচি করতেই মালতী আমার কাছে ছুটে আসে, বলে,”এরকম কাজ আমার গোপাল করেনি গো দিদি |”

আমি ওকে শান্ত করে বললাম,”কাঁদিস না, আমি জানি ও করেনি এসব |”

কিন্তু বাচ্চাটাই বা গেল কোথায়? নানা লোকের নানা মন্তব্য এসেই চলেছে প্রতিনিয়ত | কেন ঐ পাপকে বাড়িতে ঢুকিয়েছি? খারাপ চরিত্রের মহিলার সাথে সাথে চোরের তকমাটাও জুড়ে দিলো অনেকে |

বেশ কিছুক্ষন খোঁজাখুঁজির পর বাধ্য হয়ে পুলিশে খবর দেব ভাবতে ভাবতেই দরজায় দেখি পুলিশ হাজির | আমাদের লোকাল থানার ইন্সপেক্টর দত্ত, আমাদের পরিচিত | সাথে ছোট্ট গোপাল, তার হাতে চিকুর গয়নার লাল ব্যাগ | দেখেই আমার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল | তাহলে কী বাকী লোকের কথাই সত্যি হলো? না না, এ হতে পারে না |

ইন্সপেক্টর দত্ত বললেন, “এই পুঁচকের সাহসের জন্যই আজ এই গয়নাগুলো পাচ্ছেন |”

সবার উৎসুক দৃষ্টির জবাব দিতে দত্ত বললেন,”একটা ছিঁচকে চোর আপনাদের সদর দরজা খোলা পেয়ে ঢুকে এই গয়নার ব্যাগ হাতিয়ে পালাচ্ছিল, এই পুঁচকেই লক্ষ্য করে ধাওয়া করে | এইটুকু হলেও একবারও হাঁপিয়ে দাঁড়ায়নি | চিৎকার করে লোকজন জড়ো করে ফেলেছিল | চোর আর পালানোর পথ না পেয়ে মরিয়া হয়ে বেচারার ওপর ক্ষুর চালাতে যায়, তখনই পাবলিক পিছন থেকে ধরে ফেলে | ওর হাতটা ক্ষুর লেগে ডিপ হয়ে কেটে গেছে, আমরা ফার্স্ট এড করে দিয়েছি | চোর ধরা পড়েছে | ওয়েল ডান মাই বয় |” কথা শেষ করেই ইন্সপেক্টর দত্ত ছোট্ট গোপালের পিঠ চাপড়ে দিলেন |

গোপাল ছুট্টে এসে মালতীকে জড়িয়ে ধরল | মালতী তখন অঝোর ধারায় কাঁদছে | আমি গোপালকে কাছে টেনে ওর গালে চুমু দিয়ে বললাম,”তোর ভয় করেনি?”

গোপাল উত্তর দিল মাথা দুলিয়ে,”না, না, ভয় কেন পাবে? ভাই-এর জিনিস নিয়ে চোরটা পালাচ্ছিল আর আমি দৌড়ব না, বল?”

চোখে আমার আনন্দাশ্রু, ওকে জড়িয়ে অনেক আদর করলাম, “আমি মানুষ চিনতে  ভুল করিনি, তুই আবার প্রমান করে দিলি গোপাল |” উঠে দাঁড়িয়ে ওখানে সমবেত সমস্ত আমার ‘শ্রদ্ধেয় গুরুজন’দের গর্ব নিয়েই বললাম, “গরিব হতে পারে এরা, নেমকহারাম নয়, আর না তো নোংরা | এরা সৎ অন্তত, আর বিকৃত মানসিকতার ফল ধর্ষণ, তাতে দায় মালতীর ছিল না | আর গতর দেখিয়ে কাজ করে, তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিলাম সেটা সত্যি, যদিও জানি সেটাও মিথ্যে, তাও কী সেটা দিয়ে ধর্ষণকে জাস্টিফাই করা যায় মা? আপনি তো নিজেও একজন মেয়ে, মা, কীভাবে বললেন? ধর্ষিতাকে নোংরা খারাপ বলার আগে ধর্ষণকে কি বলবেন সেটা ভাবুন আপনারা সবাই | এই সমাজ মনোবল বাড়ানোর বদলে দায়িত্ব নিয়ে সেটাকে আরও ভেঙে দেয়, দগদগে ক্ষতটা বারবার অতীত থেকে তুলে আনে | এই যদি সমাজের শিক্ষিত মানুষের চেহারা হয়, তাহলে এর থেকে আর কীই বা আশা করা যায়, তাই না?”

আজ অনেকগুলো শিক্ষিত ভদ্র মানুষের মুখ বন্ধ হলো, জানি না এর পর কিছু বলার আগে হয়তো দু’বার ভাববে, কি জানি, দেখা যাক, কবে পাল্টায় সমাজটা |

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

মুক্তি

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেল, আকাশ তখন থেকে ঠায় বসেই রয়েছে ঘাটে। এখন বাঁধানো ঘাট থেকে করিডোর হয়ে বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরে পুজো দেওয়া অনেকটা সহজ

Read More »

বন্ধু হবি চল

বাক্সপেটরা নিয়ে স্টেশনেই বসে ছিল নয়না, বৃষ্টি পড়েই চলেছে, মুষলধারায়। বাবা বলল আরেকটু অপেক্ষা করতে, এত বৃষ্টিতে তো ছাতাও হার মানবে, আর বেরিয়ে রাস্তাও অজানা

Read More »

টিফিনবাক্স

প্রতিবারের মতন এই বছর ও সমস্ত সরঞ্জাম গুছিয়ে বেরোনোর জন্য ব্যস্ত অমিত, অন্তত সন্ধ্যার মধ্যে বেরোতে না পারলে খুব মুশকিল। পুজোর দিকটা কতদূর কি হলো

Read More »

ক্লিক

।।১।। -“মালিনী, কালকের মিটিংটা কখন ফিক্স করেছ? -“ম্যাম, সকাল ১১টা।” -“ওকে, কনফার্মেশন পেয়ে গেছ?” -“ইয়েস ম্যাম।” -“ওকে গুড। আর।।। এক মিনিট।।।” টেবিল থেকে ফোনটা তুলে

Read More »

শিক্ষা

।।১।। দাপুটে, বদরাগী, মেজাজি এই সব কটা বিশেষণই বেশ ভালো যায় মিসেস বোসের সাথে। রেণুকা বোস আর অমরনাথ বোস সানফ্লাওয়ার এপার্টমেন্টে ১২০০ স্কোয়ারফিটের ফ্ল্যাট 2c

Read More »

বিদায়

।। ১।। রীতিমত জোর করেই নন্দিনীকে পাহাড়ে নিয়ে এলো সঙ্গীতারা। আসার ইচ্ছে তো ছিল না ওর একদমই, শরীর সাথ দিলেও মনটা কোনোভাবেই সাথ দিচ্ছে না।

Read More »

Share with