||১||
শোবার ঘরের কাঠের আলমারিটা গোছাতে ব্যস্ত ছিলেন শোভাদেবী | কোনো অনুষ্ঠানের আগে সবকিছু পরিষ্কার করা হয় তো, সেই জন্যই এখন এসব নিয়ে খুব ব্যস্ত, ঘর দোর পুরো পরিষ্কার করা, রান্না বান্না, সংসারের এত কাজ, সব কিছু সামলে আবার ছোট্ট নাতি পিকলুকে সামলানো, কম ঝক্কি | আরেকজনও আছেন, তাকে বড় বাচ্চাই বলা চলে | অনিমেষবাবু, যার স্ত্রীকে ছাড়া আজ বিয়ের এত বছর পরও এক মুহূর্তও চলে না | বড় ছেলে, বৌমা, নাতিকে নিয়ে অনিমেষবাবু আর শোভা দেবীর সংসার শ্যামবাজারে, নিজেদের পূর্বপুরুষদের বনেদী বাড়িখানাতেই সুখে-দুঃখে ভালোই আছেন | এখনকার ছোট ছোট নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির তুলনায় আজও বারো-চোদ্দ জনের এই যৌথ পরিবার, বনেদী বাড়ি, অনেকের কাছেই ঈর্ষণীয় |
শোভা দেবী নিজেও যখন এই বাড়ির বৌ হয়ে প্রথম পা রাখেন, ওনার শাশুড়িমা একটা কথাই বলেছিলেন, এই সংসার যেন না ভাঙে | শাশুড়িকে দেওয়া সেই কথা আজও আপ্রাণ রাখার চেষ্টা করে চলেছেন উনি | ছোট ছেলে পড়তে গেছে বাইরে, একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে বাইরে | নিজের বড় বৌমাকেও এই একই শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন শোভা দেবী | সবার মিলিত চেষ্টায় তাই আজও রায়বাড়ি জমজমাঠ, অনিমেষবাবুর ভাই প্রণবেশবাবু, তার পরিবার, সন্তান সন্ততি নিয়ে সবসময় জমে থাকে এই রায়বাড়ি |
||২||
অনিমেষবাবু আর শোভাদেবীর মধ্যেকার স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা আর পাঁচটা বয়স্ক স্বামী স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্কের থেকে অনেক আলাদা | বিয়ের পর থেকেই বাপের বাড়ি যাওয়া অনেকটা কমে গেছিল শোভাদেবীর, নিজেই নাকী বেশি যেতে চাইতেন না, সবাই সে নিয়ে হাসাহাসিও করত খুব, বরকে ছেড়ে নাকী থাকতে পারে না, তাই বাপের বাড়ির কথা মনেই পড়ে না | উল্টোদিকটাও সত্যি, বিয়ের পর থেকেই অনিমেষবাবু স্ত্রীকে ছেড়ে ক’দিন থেকেছেন হাতে গোনা যাবে |
***************
শোভা দেবী যখন প্রথম এবাড়ির বউ হয়ে এলেন, বয়স মাত্র ১৬, অনিমেষবাবু তখন ২৬, তখনকার দিনে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে এতটাই বয়সের ফারাক খুব স্বাভাবিক ছিল | থামওয়ালা বাড়ির দাবার ছকের লম্বা দালান পেরিয়ে আলতা পরা ছোট্ট মেয়েটা একমাথা সিঁদুর নিয়ে যখন স্বামীর সাথে প্রথম এবাড়িতে প্রবেশ করেছিল, তখন সে নেহাতই নাবালিকা, ভীত, সন্ত্রস্ত, আগামী নতুন জীবন নিয়ে | শাশুড়িমা সেদিন সন্তানের মতোই আপন করে নিয়েছিলেন |
***************
আলমারিটা গোছাতে গোছাতেই একটা মোটা খামের উপর হাত পড়ল শোভা দেবীর | সেই চিঠিগুলো, যেগুলো আজ এত বছর ধরে উনি সযত্নে লুকিয়ে এসেছেন সবার চোখের থেকে | খামটা খুলতেই পুরোনো কাগজের গন্ধটা নাকে এল, একটা চিঠি বের করলেন, অনেকগুলো চিঠির মধ্যে থেকে | পরম যত্নে লোকানো তাঁর পাঠানো প্রেমপত্র, যার হদিশ জানে না কেউ | এত সুন্দর হাতের লেখা, এত সুন্দর বলার ধরনেই প্রেমে পড়ে গেছিল তখন ষোড়শী কন্যা | যার লেখা এত সুন্দর, যার শব্দ মনে ঝড় তোলে, কত সুন্দর মানুষ হবে সে, নিজের অজান্তেই তাঁর প্রেমে পড়েছিল ষোড়শী শোভা | তখনকার সময়ে বাড়ির সবার চোখ রাঙানির আড়ালে ঐ বেনামী প্রেমিকের প্রেমের কাছে নতি স্বীকারের স্বীকারোক্তি স্বরূপ এক দুটি চিঠি শোভাও ফেলেছিল বইকি | প্রেমিক কখনোই প্রেমপত্রে নিজের নাম লেখেনি, নিজের শব্দ আর ভাষা দিয়েই ছোট্ট শোভার মনে গেড়ে বসেছিল পাকাপাকি ভাবে |
শোভা দেবীর এখনও মনে পড়ে সেই দিনটার কথা, পাত্রপক্ষ যেদিন পাকা কথা বলে গেছিল, মানে অনিমেষবাবুর বাবা কাকারা | সারারাত মনের ভিতর যুদ্ধ চলেছিল সেদিন, কাঁদা ছাড়া আর যে কোন উপায় ছিল না | কে শুনবে তখন মেয়েমানুষের প্রেমের কথা? ও যে ঘোর পাপ | কাউকে কিচ্ছু বলতে পারেনি সেদিনের ছোট মেয়েটা, বাবার পছন্দ করা পাত্রের সাথে বিয়ে করে নিতে বাধ্য হয়েছিল সেদিন, এছাড়া আর উপায়ই বা কী | মনের ভিতর কৈশোরের প্রথম প্রেম চাপা পড়েছিল সেদিন |
…..কিন্তু, চিঠির বেনামী প্রেমিক যেদিন প্রথম সামনে এল, ফুলশয্যার রাত্রে, সেদিনকার থেকে বেশি আনন্দ মনে হয় সারা জীবনে কোনোদিন পাননি উনি | শোভা দেবী আর অনিমেষবাবুর অজানা-অচেনা, ভিন্ন এই প্রেম কাহিনী ঘরের ইট কাঠ পাথর ছাড়া কেউ জানে না, কেউ না, আর জানে চিরনতুন এই দুটি মানুষ, যারা হাসতে হাসতে নিজেদের জীবন একে অপরের নামে করে দিয়েছেন, আর আজও সেই বন্ধন অটুট |
||৩||
অনিমেষবাবু আর লিখতে পারেন না, বয়স হয়েছে তো, হাতটা কাঁপে, কলমটা আর চলে না | কিন্তু ঘর গোছাতে গোছাতে স্ত্রী-এর সযত্নে লুকিয়ে রাখা পুরোনো প্রেমের চিঠিগুলো নিয়ে বসে থাকাটা তাঁর নজর এড়ায়নি |
***************
আজই অনুষ্ঠান, অনিমেষবাবু আর শোভা দেবীর পঞ্চাশতম বিবাহ বার্ষিকী | এই দিনেই ষোড়শী রূপবতী, কেশবতী তার আলতা পরা ছোট ছোট পায়ে একমাথা সিঁদুর নিয়ে সেই পাগল প্রেমিকের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল | সেই প্রেমিক, যে ঠাকুরবাড়ির কনিষ্ঠা কন্যাকে দূর্গা মণ্ডপে একবার দেখেই প্রেমে পড়েছিল | সেই প্রেম সময়ের সাথে এতটাই গভীর হয়, নিজের বাবা কাকাদের বলে অবশেষে সম্বন্ধ যায় মেয়ের বাড়ি | কিন্তু এই বেনামী চিঠির অদল বদল-এর সাথে মনের অদল বদল-এর কারসাজি আর কেউ কোনোদিন জানতে পারেনি |
***************
সারাদিনের অনুষ্ঠান শেষ হলো | একমাত্র নাতনী, মানে অনিমেষবাবুর মেয়ের মেয়ের থেকে ঠিক টুক করে ব্যাপারটা শিখে নিয়েছেন অনিমেষবাবু | স্ত্রী শুতে যাবার জন্য বিছানা গোছাতেই হাতটা ধরলেন |
“কী হলো?” শোভা দেবী অবাক চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন |
-“এটা নাও, শুনে দেখ একবার, এটা আজ আমার তরফ থেকে |”
-“ওমা, এ আবার কী, এইটুকু পুঁচকে | শাড়ি দিলে তো গো |”
-“দ্যাখোই না, এটাকে পেন ড্রাইভ বলে, কাল নাতনী দেখিয়ে দেবে খন |”
***************
নাতনীর ল্যাপটপে পরদিন অবশেষে চালানো হলো কয়েক মিনিটের ভিডিও ক্লিপিংসটা | অনিমেষবাবু আর শোভাদেবীর এত দিনের নানা মুহূর্তের ছবি কোলাজের মতো করে, সঙ্গে, সেই একই রকম, শব্দ ভাষার খেলা | বয়সের ভারে নুইয়ে পড়লেও মনটা এখনো প্রেমিক, যে নিজের প্রেমিকাকে বারে বারে প্রেম নিবেদন করেই যায় | এখন তো হাত কাঁপে, লেখা সম্ভব নয়, কিন্তু মনটা তো চির নতুন-ই, সবদিন, ভাষা শব্দগুলো তো আর হারায়নি |
***************
লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠেছিল শোভাদেবীর মুখখানা | এই মুখটা দেখার জন্যই আমি সব করতে পারি, মনে মনে বলল পাগল প্রেমিক |