স্মৃতিটুকু থাক

||১||

“উফফ, আর পারছি না, এবার একটু বসতে হবে, অনেক হাঁটা হলো” বলতে বলতেই পড়ন্ত দুপুরে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত দুই বান্ধবী, মানে তনিমা দেবী আর তার অভিন্ন হৃদয় সখী মহুয়া দেবী গিয়ে ঢুকলেন কাছাকাছি একটি শপিং মলের ফুড কোর্টে |

তপ্ত গরমের পর এ.সি-র ঠান্ডা ঝলকে খানিকটা শান্ত হয়ে বসলেন দু’জন |

তনিমা দেবী আর মহুয়া দেবী সেই কলেজ থেকে একসাথে | এই সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং-এর যুগেও দুই বন্ধুর সম্পর্ক এখনও অমলিন, কৃত্রিমতা তাকে এখনও ছুঁতে পারেনি |

||২||

“একটা চিকেন বার্গার…”

গভীর খুব পরিচিত একটা গলার স্বরে তনিমা দেবীর মাথায় যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল | ঝট করে তাকালেন ফিরে | মুহূর্তের মধ্যে চোখে যেন অনেককটা সাদা-কালো ক্যানভাস ভিড় করল | সেই চেহারা, সেই চোখ, সেই গভীর কন্ঠস্বর, সেই ব্যাকব্রাশ চুল, সেই কথা বলার স্টাইল…. অমিত দা, তনিমার অমিত দা, যে অমিতদা তনিমার রক্তে আগুন জ্বালাত একসময়, তনিমার লোহিত রক্ত কণিকাগুলো দৌড় লাগাত যে মানুষটার গলার স্বরে |

একদৃষ্টে তাকিয়েছিল তনিমা একসময়ের পরম প্রিয়, একান্ত আপন মানুষটার দিকে, যার সাথে একসময় আজীবন পথ চলার অঙ্গীকার করেছিল এই মন |

-“কেমন আছো তনিমা?”, প্রশ্নটা করেই ফেলল তনিমার অমিতদা |

একগাল হেসে তনিমা বুঝিয়ে দিল যে মন্দ সে নেই | মহুয়াও চেনেন এই মানুষটাকে, অনেকদিন পর সিনিয়র দাদার সাথে কথা বলল মহুয়াও |

বহুদিন পরের এই অল্প কথাবার্তাটাও যেন একঝলক সবুজ ছোঁয়া এনে দিল মানুষগুলোর মনে | সেই কলেজের করিডোর, গ্যালারি, পি.বি স্যার-এর ক্লাস, পড়ন্ত বিকেলে সিঁড়িতে বসে গান…… দিনগুলো আবারও সজীব হয়ে উঠছিল মনে |

কখন যেন মহুয়ার চোখের আড়ালেই অমিতদা একটু নিভৃতে সময় চেয়ে নিয়েছিল তনিমার কাছে | বসল গিয়ে ওরা সেই লেকটার বেঞ্চে, যেখানে বসত আজ থেকে ৩০ বছর আগেও | সবটাই বদলে গেছে, কিন্তু সেগুলো শাশ্বত, তার আজও কোন পরিবর্তন হয়নি |

পাশের গাছের পায়রা দুটো ব্যস্ত ছিল নিজের ভিতরের খুনসুটিতে | তনিমার নিস্তব্ধতা ভেঙে প্রশ্ন করল, “কতদিন পর দেখা হলো বলোতো অমিতদা ?”

সূর্যাস্তের লাল আভার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে অমিত উত্তর দিলেন,” বহু বহু বছর পর… তাও যেন অমলিন আজও….”

-“কলকাতায় কবে ফিরলে?”

-“এই তো মাস পাঁচেক হলো |”

“ছেলেপুলে ক’টি?”, শুধোল তনিমা |

-“ছেলে নেই, তবে পুলে একটি, তোমার?”

-“আমারও এক মেয়ে | গিন্নি কী করেন?”

-“খাঁটি গৃহবধূ | তা তোমার পতিদেব কী করেন?”

-“ইনকামট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট-এ আছেন |”

কিছুক্ষনের বিরতি নিয়ে অমিতই প্রশ্ন করলেন,”আচ্ছা তনু, সত্যি তুই ভালো আছিস?”

আজ এত বছর পর এই মানুষটার মুখে চিরপরিচিত সেই ডাকটা শুনে এক মুহূর্তের জন্য হলেও বুকটা ধক করে উঠেছিল তানিম দেবীর |

-“মন্দ আছি বললে মিথ্যা বলা হবে…”

-“তাহলে ভালই আছিস?”

-“হুম, তুমি?”

-“আমিও সত্যি কথা বলতে ভালই আছি রে বেশ, নিজের সংসার, সন্তান নিয়ে খারাপ নেই তেমন |”

-“অমিতদা, আমরা কি চেষ্টা করলে পারতাম না এক হতে?”

কিছুক্ষন চুপ থাকল দুপক্ষই , পাখিগুলো মাথার উপর দিয়ে ঘরে ফিরছে, ঈশান কোণে   আলো-আঁধারি খেলা শুরু হয়ে গেছে ততক্ষনে |

-“কি জানি, পারতাম হয়তো | সবাই তো পাশে ছিল, তাও তো পারলাম না | তুই আমায় ছেড়ে চলে যাবার পর আমি অনেক বদলেছি, পিউ-ই আমায় বদলেছে, তারপর তিতলি এল আমার জীবনে একটা ছোট্ট পরি হয়ে | আমি ভালোই আছি রে, সুখেই আছি | আমার বিশ্বাস তুইও অনেক বদলে গেছিস | আমাদের মধ্যেকার অশান্তি, দূরত্ব, অবিশ্বাস, সময়ের অভাব, এই সবকিছু আমাদের মধ্যেকার ব্যবধানের জন্য দায়ী ছিল | মনে পড়ে, যেদিন প্রথম আমাদের ঝগড়া হয়েছিল, তুই কত কেঁদেছিলি, ঝগড়া শেষে বলেছিলি আমায় ছাড়া বাঁচা তোর পক্ষে সম্ভব না | কিন্তু দ্যাখ, আমরা তো দুজনই দুজনকে ছেড়ে বেঁচেই আছি, ভালই আছি | কারও জন্য কিছু থেমে থাকে না রে, এটাই বাস্তব, দ্যাখ না, কিছু তো থেমে রইল না | কিন্তু বিশ্বাস কর তোর ওপর আমার কোন রাগ নেই, তোর সাথে দেখা হয়ে, কথা বলে ভালই লাগল |”

-“আমরা তো কথা দিয়েছিলাম দুজন দুজনকে আমাদের মধ্যেকার ভালো সময়গুলোকে স্মৃতি করে যত্নেই রাখব, খারাপ সময়গুলো সেটাকে যেন ছুঁতে না পারে, তাই না? তিক্ততা ভালবাসার স্মৃতিগুলোকে যেন ছুঁতে না পারে, তাই তো কথা ছিল | …….. আচ্ছা, সত্যিকারের ভালবাসা কী কখনো মরে?”

-“এর উত্তর আমার কাছে সত্যিই নেই, তবে ভালবাসা আমার মিথ্যে ছিল না বলতে পারি ঐটুকু | কষ্টও পেয়েছি অনেক, কিন্তু এখন আমি অনেক এগিয়ে গেছি, ভালও আছি, তার মানে এটা নয় তোর সাথে যেটা ছিল সেটা নাটক | তোর দেওয়া নীল পাঞ্জাবিটা আজও আলমারির তাকে রাখা আছে |”

……আবছা চোখের জলটা সামলাতে সামলাতে মনে মনে ভাবলেন তনিমা, ‘আমিও তো তোমার দেওয়া সেই কাঁচা হলুদ রঙা শাড়িটা আজও হারাতে দি-নি | আলমারির অজস্র দামী শাড়ির মধ্যে থেকেও, রক্তলাল চিকেনের কাজ করা ওড়নাটা আজও আছে, অমলিন |’

তনিমার ভাবনা থামিয়ে অমিত আবার বললেন,”তুইও একই ভাবে বাঁচিয়ে রেখেছিস চিহ্নগুলোকে…..?”

অমিতদার দিকে সেই একইভাবে তাকালেন তনিমা, যেমন তাকাতেন আগে, যেমনটা তাকাতে চেয়েছিলেন, আজীবন |

আচমকা ফোনের রিংটোনের আওয়াজ অতীত থেকে ফিরিয়ে আনল ওদের

-“এবার ফিরতে হবে বাড়ি, ডাক পড়েছে যে |”

-“ভাল থাকিস |”

আবার দুজন দুজনের পথে, যে পথ আজ আলাদা, কিন্তু কোন একদিন দুজনের পথ মিলেছিল একই খাতে, কিন্তু আর এক হওয়া হয়নি দুজনের |

চায়ের দোকানে তখন উনুন ধরানোর ধোঁয়া, আবছা সেই ধোঁয়া আড়াল করলো ভাগ্যিস অমিতের চোখের জলটা, পথের ধারের কোন এক অজানা বাঁশিওয়ালার বাঁশির আওয়াজে নিজের যন্ত্রনাটা সামলে নিল তনিমাও, মুখে হাসি ফুটিয়ে চললো দুটো মানুষ, দুইদিকে, পড়ল যেন দীর্ঘশ্বাস – নিঃশব্দে, বলল তারা, “স্মৃতিটুকু থাক”…….

 

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

তোমায় আমায় মিলে

।।১।। “উফফ! পা-টায় যা অসহ্য যন্ত্রনা করছে। সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে। আর পারা যায়?” হাতের , কানের গয়নাগুলো খুলতে খুলতে বলছিল কুহেলী। রাজীব ততক্ষণে মোবাইল

Read More »

নিভৃত যতনে

।। ১।।   কোর্টের বাইরে তখন খাঁ খাঁ করছে রোদ, ঘড়ির দিকে তাকাল একবার রিয়াঙ্কা, কোথা দিয়ে এতটা সময় চলে গেল বুঝতেই পারেনি। একবার বাবার দিকে

Read More »

সন্ধ্যে নামার আগে

।।১।। “প্লিজ তোমার ভাঙা রেকর্ডটা একটু বন্ধ কর তো, সবসময় ভালো লাগে না। একেই অফিসে এত কাজের প্রেশার, বাড়ীতে একটু শান্তিতে বসব, তাও দেবে না।”

Read More »

যদি

।।১।। “আর দেরী করলে কিন্তু, সত্যিই পৌঁছতে পারবে না, অলরেডি সাড়ে চারটে বেজে গেছে” মা-এর উদ্দেশ্যে চেঁচাল মৌমিতা, অয়নের দিকে একবার আড়চোখে তাকাল। অয়নও একটা

Read More »

তুমি রবে নীরবে

।।১।। “বাবু, তোকে আর কতবার বলতে হবে, রোজ একবার করে অন্তত প্র্যাকটিসটা করবি question bank টা। আজও তো করলি না।” পেটির মাছের পিসটা একমাত্র ছেলের

Read More »

একে একে এক

।।১।। চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমার আড়ালে ঘন কালো কাজলে মোড়া বড় চোখদুটো সামনের দেবদারু গাছটার দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্কভাবে কি যেন একটা খুঁজছিল, হাতের পেপার ওয়েটটা

Read More »

Share with