||১||
“খেয়ে নাও, না খেলে চলবে?”-বলেই রুটির গালটা ধরল কুহেলী, রাজীবের কাছে | ডঃ কুহেলী মিত্র, সাইকিয়াট্রিস্ট, সল্টলেকে বাড়ি | রাজীব কুহেলী না খাওয়ালে কিছুতেই খাবে না, রাত্রে বাড়ি ফিরলে যত ক্লান্তই হোক, রাজীবকে একটিবার খাওয়াতেই হবে |
রাজীবকে কুহেলী চেনে বছর তিনেক | কুহেলীর ডাক্তারির সাথে সাথে ফটোগ্রাফির খুব শখ | সেবার গেছিল পুরুলিয়া, সেখানেই…. ভাবতে ভাবতেই রাজীবকে আবার তাড়াতাড়ি খাওয়াতে লাগল, অনেকটা রাত হয়ে গেছে | মান্দা মাসি ওর খাবারটা টেবিলে বেড়ে দিয়েছে, খেয়ে শুতে পারলেই বাঁচে, যা ধকল গেছে |
*************
বছর তিনেক আগে পুরুলিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে এক সুদর্শন ছেলের সাথে দেখা হয়েছিল কুহেলীর | কিন্তু সে মানুষটা আর পাঁচটা মানুষের থেকে একদম আলাদা ছিল | অবিন্যস্ত পোশাক, এলোমেলো চুল, অগোছালো একটা ছেলে, বট গাছের তলায় আপন মনে বাঁশি বাজাতে ব্যস্ত | থমকে দাঁড়িয়েছিল কুহেলী | সবকিছুর ভিড়ে দৃষ্টি আটকেছিল উজ্জ্বল দুটি চোখে | কী অসম্ভব স্বচ্ছ, অথচ গভীর সেই চোখ, যেন মনে হয় মনের ভিতর পর্যন্ত পড়ে ফেলতে পারে | চোখ ফেরাতে পারেনি কুহেলীও, বরং আরও অবাক হয়ে তাকিয়েছিল | মানুষটা আমাদের থেকে আলাদা, পাগলাটে, স্মৃতিভ্রষ্ট হয়েছে, বাড়ি ঐ গ্রামেই, মানসিক ভাবে অসুস্থ, তাই বাড়িতেও জায়গা নেই, বিধবা মা-এর খুঁটির জোর কম, দাদা বৌদির সংসারে মানসিক অসুস্থ ভাই ব্রাত্য | আশেপাশের মানুষগুলোর কাছ থেকে শুনেছিল কুহেলী, ছেলেটার আসল নাম কানাই | গায়ের রং শ্যামলা, মুখটা বড্ড বেশিই সুন্দর, সবথেকে সুন্দর চোখ দুটো | শুষ্ক লাল মাটির পথের ধারে রক্তলাল কৃষ্ণ চূড়া গাছের নীচে দাঁড়িয়ে প্রথম কানাই-এর অতীতটা জেনেছিল কুহেলী | জানার পর সারারাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি, নিজের এসএলআর-এ তোলা কানাই-এর নানা মুহূর্তের ছবিগুলো বারবার দেখেছিল কুহেলী | খুব বেশি সময় নেয়নি ভাবতে, নিজের সাথে কানাইকে নিয়ে এসেছিলো কলকাতায় | অনেক সময়, যত্ন, ভালোবাসার প্রয়োজন মানুষটার তাই সবার অনুমতি নিয়ে কানাইকে সঙ্গে করে নিজের সল্টলেকের বাড়িতে নিয়ে এসেছিল |
||২||
কানাই এখন আগের থেকে অনেক অনেক সুস্থ | কুহেলী কানাইকে রাজীব বলেই ডাকে, কানাই থেকে রাজীব ডাকার এই তিন বছরের পথটা সহজ ছিল না | কিন্তু, কানাইকে যত্নে, ভালবাসায় সুস্থ করতে করতে কখন নিজের অবচেতনে ওকে মনের মধ্যে জায়গা দিয়ে ফেলেছে নিয়েও বোঝেনি কুহেলী | কানাই-এর কথা বলা, কুহেলীর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা, কুহেলীর জন্য অপেক্ষায় জানলায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকা, এসবই কুহেলীকে বারবার রাজীবের কথা মনে করায় | কানাই কুহেলীর জন্য রোজ রাতে বাঁশি বাজায়, ঠিক যেমন রাজীবও করত | রাজীব, কুহেলীর জীবনের প্রথম প্রেম | রাজীব আর কুহেলীর বিয়ের মাত্র তিন মাস আগে একটা কার এক্সিডেন্ট রাজীবকে কেড়ে নিয়েছিল কুহেলীর থেকে |
ঐ ঘটনা থেকে বেরতে অনেকখানি সময় লেগেছিল কুহেলীর | তারপর অনেক বছর পর কানাই-এর সাথে ওর দেখা হয়, ক্রমে কুহেলী আবিষ্কার করে কানাইও অনেকটা রাজীবের মতোই, বা হয়তো নিজের ভালবাসার মানুষটাকেই বারবার অন্য মানুষের মধ্যেও খোঁজার চেষ্টা করেছে কুহেলী | তারপর থেকেই কানাইকে রাজীব বলে ডাকে ও, মনে হয় ওর রাজীব ওর কাছেই আছে |
||৩||
পুরুলিয়ার গ্রামের কানাই-এর দু’-তিন ঘর পরেই থাকত মেয়েটা, নামটা খুব সম্ভবত শিমুল | শিমুলকে কানাই পাগলের মত ভালবাসত বললেও কম বলা হবে হয়ত | শিমুলকে একটা দিনও না দেখে থাকতে পারত না ও | তরতর করে ওদের প্রেম এগোচ্ছিল, সবার অলক্ষ্যে | লোকচক্ষুর অন্তরালে, কৃষ্ণ চূড়ার রক্তলাল আবিরকে সাক্ষী রেখে বারবার শিমুলকে পরম ভালবাসায় আপন করে নিয়েছিল কানাই | শিমুলের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নিজের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে মুড়ে দিয়েছিল ওর কানাই | ওদের প্রেমের কথা কেউ জানত না, জানত শুধু শিমুলের বোন, পারুল, ওর থেকেই জেনেছিল কুহেলী |
কানাই আর শিমুলের মিলনটা আর হয়নি | কানাই-এরই চোখের সামনে শিমুলকে মস্তান দাদাগুলো তুলে নিয়ে গেছিল, ধর্ষণ করে খুন করে ফেলে রেখে গেছিল | এতবড় একটা ঘটনা কিন্তু কেউ তাদের বিরুদ্ধে একটা কথাও আজ অবধি উচ্চারণ করতে পারেনি | কানাই চেষ্টা করেছিল মানুষগুলোকে এক করে প্রতিবাদ করার কিন্তু পেয়েছিল শুধু মস্তানদের হাতের পিটুনি | এই সব কিছু থেকে কানাই আর পারেনি ওভারকাম করতে | স্মৃতিশক্তি, মানসিক স্থিতি, সবটুকুই হারিয়ে ফেলেছিল | স্মৃতিশক্তি ফেরা আর কখনো হয়তো সম্ভবও না | কিন্তু আজ কুহেলীর যত্নে, ভালবাসায় কানাই বা রাজীব যেই হোক না কেন, ভাল আছে, ভালবাসায় আছে | কুহেলীর ভালবাসায় কোন খাদ নেই, আর সেটা আজ কানাই ভালভাবেই বুঝে গেছে | তাই কুহেলীকে দেখেই ওর দিনের শুরু আর দিনের শেষ |
||৪||
শরীরের ক’দিন ধরেই জুৎ পাচ্ছে না কুহেলী, জ্বরও কদিন ধরে | আজ রিপোর্টগুলো আন্তে হবে ফেরার পথে | নিজের চেম্বার থেকে বেরনোর আগে চোখ মুখে জল দিতে গিয়ে ওয়াশরুমের আয়নাটায় নিজের দিকেই অনেকক্ষণ তাকিয়েছিল কুহেলী, আজ কুহেলীর মুখের হাসি কুহেলীর চোখ অবধি পৌঁছায় | রাজীব-এর ভালবাসা আবার একটু একটু করে সঞ্জীবনী শক্তির মতো ছড়িয়ে পড়ছে কুহেলীর সারা শরীরে | কী করছে ও এখন? নিশ্চয় কুহেলীর জন্য না খেয়ে জানলায় হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে | আজ সকালে খাওয়ানোর সময় রাজীবকে, কী ছিল উজ্জ্বল সেই চোখদুটোয়? সেই পাগল প্রেমিকটা, যে কুহেলীকে ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না, শক্ত পুরুষালি হাতে জড়িয়ে ধরেছিল, জানে না সেই বাঁধনে কী ছিল, শুধু এই বাঁধন যেন কখনো আলগা না হয় সেই প্রার্থনাই তো কুহেলীও করেছে, মিথ্যা বলে লাভ কী?
*************
আজ কুহেলী ফিরতে বড্ড রাত করছে, খুব অস্থির লাগছে রাজীবের | এত রাত তো করে না, ও তো জানে, ও না এসে খাওয়ালে রাজীব খাবে না কিছু | তাহলে? বুক শেলফে রাখা কুহেলীর উদ্ভাসিত হাসি মুখের ফটোটার দিকে অভিমানী দৃষ্টিতে তাকাল রাজীব,”আজ এস খালি, আর তোমায় কোথাও দেব না যেতে”, নিজের শিশুসুলভ ভঙ্গিতেই কুহেলীর ফটোটা নিয়ে বুকে আঁকড়ে বসে রইল রাজীব, মান্দা মাসি একটা কণাও খাওয়াতে পারল না | একদৃষ্টে তাকিয়ে রাস্তাটার দিকে, যেন কুহেলীকে ও-ই সবার আগে দেখবে, আর কারো দেখার অনুমতিও নেই যেন |
||৫||
(বেশ কিছুদিন পর)
…ঠিক যেমনি ভাবে রাজীব ঐ কুহেলীকে ছেড়ে চলে গেছিল, শিমুল তার কানাইকে, ঠিক আবারও ভাগ্যের কী নিদারুণ পরিহাস | সত্যিকারের প্রেমকে কী বারবার এভাবেই পরীক্ষা দিতে হয়? নাহলে বারবার কেন? কুহেলীর ঠিক এই সময়ই দ্য লাস্ট স্টেজ অফ লিউকোমিয়া ধরা পড়ল ! কেন? এই মারণ রোগের করাল ছায়ার আভাস যে একবারও পায়নি ও, ও তো আবার একটু ‘বাঁচতে’ শুরু করেছিল |
***************
এই মারণ রোগ থেকে আর ফিরে আসতে পারেনি কুহেলী, পারেনি ওর রাজীবের কাছে ফিরতে, আর কানাই?….