||১||
“দ্যাখ বাবু, কাগজ আর দুধটা দিয়ে গেল মনে হয় |”-ছেলের উদ্দেশ্যে হাঁক পাড়লেন আরতি দেবী | আরতি দেবীর ছেলে সন্তক, যার উদ্দেশ্যে এই কথা বলা, ডাকনাম বাবান | অনিমেষবাবু সন্তকের বাবা, সরকারী চাকুরে, থাকেন সপরিবারে শোভাবাজারে | সন্তক মানে বাবানের এখন সেকেন্ড ইয়ার |
রোজ সকালবেলা, তা প্রায় ভোর পাঁচটায় উঠে খানিক যোগব্যায়াম করে বাবান | ওদের বাড়িটা সব পুরোনো কালের উত্তর কলকাতার বাড়ি যেমন হয়, অনেকটা সেই ধাঁচেই, ছাদটা পাশের বাড়ি, সামনের বাড়ির ছাদের সাথে কানেক্টেড, দরজা আছে, সেই দরজা দিয়ে গেলেই পাশের বাড়ির ছাদে পৌঁছানো যায় | তা যাই হোক, আজও যোগব্যায়াম করে নামতে গিয়ে কাগজ আর দুধটা তুলতে বারান্দায় গেছিল বাবান, সামনের বাড়িতে চোখটা পড়তেই চোখটা আটকাল, এই সাতসকালেই মেয়েটা স্নান করে চুল শুকচ্ছিল বারান্দায় | কেমন যেন তাকাতে না চেয়েও খানিক চেয়ে রইল, মায়ের ডাকে খানিক মাথা চুলকে ঘরে গেল বাবান |
||২||
বাবানের আজ টিউশন পড়ে ফিরতে রাত হয়ে গেছে একটু, পাড়ার মোড়ে বসন্ত দার কেবিন আছে, ওখানে চা আর ঘুগনি খাচ্ছিল, বন্ধুদের নিয়ে | খিদেটা বেশ জোরেই পেয়েছে, কিন্তু রাত্রের খাবার খেতে দেরি আছে, তাই ঘুগনি খাবে মনস্থির করে দাঁড়িয়েছিল বাবান | আড্ডাই দিচ্ছিল, হাতে চায়ের ভাঁড়, আবার সকালের মেয়েটাকে দেখতে পেল, সেও কোথাও থেকে পড়ে ফিরছে হয়তো, তারও পিঠে ব্যাগ |
কালো রঙের জামাটা ফর্সা মানুষটার সাথে বেশ মানিয়েছে, এলোমেলো অগোছালো চুলগুলো যখন তার মুখে বারবার পড়ছিলো আর সে বারবার তার চুলগুলো অনেক বিরক্তি নিয়ে সরাচ্ছিল, ভারী মিষ্টি দেখাচ্ছিল |
বাবান ঘুগনিটা নিতে নিতে গৌরবকে জিজ্ঞেস করল,”কে রে পাড়ায় নতুন মেয়েটা? আগে তো দেখিনি |”
গৌরব চামচে করে সুস্বাদু ঘুগনিটা মুখে পুরে বলল,”আরে নতুন ভাড়াটে, ঐ গাঙ্গুলীদের বাড়ির তিনতলায়,….|”
“ও আচ্ছা”, বাবান পুরোটা শুনতে শুনতে হাঁ করে তাকিয়ে মেয়েটির চলে যাওয়া দেখছিল |
**************
(কিছুদিন পর)
নাম না জানা মেয়েটার একটা নাম, হয়তো ডাকনামই হবে, জানতে পেরেছে বাবান, বাবান এমনিতে খুব লাজুক, মেয়েদের সাথে কথা? ওরে বাবা, নৈব নৈবচ ! এরকম ব্যাপার আর কী | তা মেয়েটির মা মেয়েটিকে প্রায়ই চিৎকার করে ডাক দেয়,”টুকুন, খাবি আয় |” তার থেকেই আভাস পেয়েছে বাবান |
এখন প্রায় রোজই দেখা হয় তার সাথে, সেই একই সময় বাবান ব্যায়াম করে নীচে নামে, ওদের ঘরের উল্টোদিকের বারান্দাতেই মেয়েটা রোজ চুল শুকোয় | একই ঘটনা রোজ, তাও বাবান রোজ দেখে, প্রায় ১০টা মিনিট ওখানে ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে বাবান | মেয়েটা ফিরেও তাকায় না, সে সূর্য প্রণাম করতে, ঠাকুর প্রণাম করতে, ধুপ দেখাতেই ব্যস্ত থাকে | বাবানও কিছু বলে না, ও জানে না ওকে কেন দেখে, কিন্তু দেখতে ভাল লাগে, তাই দ্যাখে | ভিজে লম্বা চুলটা যখন তোয়ালে দিয়ে বারবার ঝাড়ে, এলোমেলো মেঘের মতো খোলা কালো চুলের ভিড়ে যেন আরও সুন্দর লাগে তাকে, মানে টুকুনকে | বাবান খুবই মুখচোরা, মুখে কখনো কোনো কথা বলেনি ও, ওর বিলাসিতার মধ্যে শুধু তাকে একবার বেরবার আগে কয়েকমুহূর্ত দেখা, এটুকুই |
||৩||
আজ সকালে তার দিকে আবারও অবাক চোখে তাকিয়েছিল বাবান | আজ ক্ষনিকের জন্য তার সাথে চোখাচোখিও হয়ে গেল বাবানের, চোখে চোখ পড়তেই চোখটা লজ্জায় নামিয়ে নিল বাবান | কিসের এত লজ্জা নিজেও জানে না,কেন তাকে দেখে তাও জানে না, শুধু প্রথম সকালের নরম আলো যখন তার মুখের উপর পড়ে, চুল শুকানোর সময় অবাধ্য চুলগুলোর মুখের উপর অবাধ বিচরণ যেন আরও সুন্দর করে তোলে তাকে |
**************
রোজ সকালে, বিকালে বা সন্ধ্যেতে ফেরার সময় একবার করে দেখা হতেই থাকে | এখন এমন হয়েছে, একবার তাকে না দেখলে যেন মনটা ভালই লাগে না বাবানের, আস্তে আস্তে কখন যে মেয়েটি বাবানের চোখ, মস্তিস্ক পেরিয়ে মনের জমিও দখল করতে শুরু করেছে বাবান নিজেই বোঝেনি |
**************
বিগত দু’দিন ধরে সামনের বাড়ির জানলা বন্ধ, জানলায় মালকিনের দেখা নেই, কোথায় গেছে কে জানে, অজানা কারণেই মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল বাবানের, জানে সেটা অমূলক, তাও | ছুটির দিন, বাইরে মেঘলা আকাশ, ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে, সঙ্গে ঝিরঝিরে বৃষ্টি, এক কথায় অসাধারণ আবহাওয়া, এমন আবহাওয়ায় খিচুড়ি ডিম ভাজা তো মাস্ট | মা রান্নাঘরে ওটাই বানাচ্ছে, লাজলজ্জার মাথা খেয়ে বাবান মাকে জিজ্ঞেস করেই ফেলল, “আচ্ছা মা, সামনে গাঙ্গুলী কাকাদের বাড়ি যে নতুন ভাড়াটেরা এসছে, আলাপ হলো?”
মা মশলাটা কষতে কষতে উত্তর দিল,”হ্যাঁ ওই বাজার নিয়ে ফিরছিলাম পরশু, ভদ্রমহিলার সাথে কথা হলো, ভারী মিশুকে মানুষ | ওনারা আগে থাকতেন বেনারসে, মহিলা বাঙালি স্বামী অবাঙালি, এক ছেলে এক মেয়ে | ছেলে বাইরে পড়ছে, মেয়ে এবছরই কলেজে ভর্তি হয়েছে, স্বামীর কর্ম সূত্রেই এদিক ওদিক করতে হয় ওনাদের |”….. কিছুক্ষন বিরতি দিয়ে মা বললেন,”কেন বলতো?”
খানিক থতমত খেয়ে বাবান উত্তর দিল,”না মানে, এমনি জিজ্ঞাসা করছিলাম আর কী, কী নাম ওনাদের… মানে…”|
বাবান কথা শেষ করার আগেই মা খানিক সন্দিগ্দ্ধ দৃষ্টিতে বাবানের দিকে তাকাল… বাবানের তোতলামো দেখে মুখের হাসি চেপে উত্তর দিল,”নাম ধাম অত জানি না, তবে পদবী শর্মা |”, বলে মা কাজে মন দিল | বাবান কথা না বাড়িয়ে চলে গেল |
বাইরে তখন মুষলধারায় বৃষ্টি নেমেছে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে বন্ধ জানালাটার দিকে তাকিয়েছিল বাবান, বাইরে অঝোরধারায় বৃষ্টিতে তখন সামনেটা ঘোলাটে, অস্বচ্ছ | আবছা দৃষ্টিতে অন্যমনস্ক বাবান ভাবছিল কীভাবে জানা যায় নামটা? বন্ধুদেরকে জিজ্ঞেস করলে বন্ধুরা এখুনি মজা ওড়াবে, থাক | বাইরের টবের গাছগুলো জলের ধাক্কায় কাঁপছে, বেশ ঠান্ডাও পড়েছে, বাবান আবোলতাবোল চিন্তায় দাঁড়ি টেনে ঘরে চলে গেল |
*************
দুইদিন মতো উনি ছিলেন না, এই দুদিনই বাবানের ছুটি ছিল, ও তেমন খুব একটা যায়নি কোথাও, বন্ধুদের থেকে জেনেছে মেয়েটার কলেজ | ফেসবুকে সার্চ মেরে খুঁজে পেল তাকে, নাম কৃতীকা শর্মা, কৃতীকা…কৃতী… আনমনেই বিড়বিড় করছিল নামটা | অনেক ভেবে শেষমেশ ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েই দিল |
||৪||
আজকের সকাল আর পাঁচটা সকালের মত হলেও বাবানের কাছে এর গুরুত্ব আলাদা | নরম আলো জানলার আর্শি বেয়ে চুঁইয়ে পড়তে না পড়তেই ঘুম ভেঙে যায় বাবানের | আবার সেই বারান্দা, সেই জানলা, সেই সকাল, সেই টুকুন মানে কৃতীকার, বলা ভাল বাবানের কৃতীর চুল শুকানো, সেই বাবানের দেখা… কিন্তু এসবের মধ্যেও আলাদা এটাই, আজ যেন কৃতীও আড়চোখে বারবার দেখছিল বাবানকে | চোখে চোখ পড়তে বাবান আর আজ চোখ সরায়নি, বরং মুগধ হয়ে দেখছিল, পরম যত্নে, নিজের মনের কোণে অজান্তেই গড়ে ওঠা সেই প্রেমের মানুষটাকে |
খুব ভাল লাগে কৃতীকে এখন বাবানের, জানে না তার ব্যাপারে কিছুই, তাও, নিজের অনুভূতিগুলোর এই বেড়ে ওঠাটাকে আটকাতে পারেনি ও | কৃতীও খানিক চোখ নামিয়েই আরও একবার ফিরে তাকাল বাবানের চোখের দিকে | … কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা…কতটা সময় জানা নেই, কিন্তু ঐ সময়েই যেন কিছু না বলেও অনেককিছু বলা হয়ে যাচ্ছে দু’জনের, যেন সব কথা মুখে বলার প্রয়োজনই নেই |
কতক্ষন সময় কেটেছে জানে না, হঠাৎ কৃতীর মায়ের ডাকে টনক নড়ল দু’জনের, তাড়াতাড়ি কৃতী দৌড়ে গেল নীচে, যাওয়ার সময় রিনিরিনি শব্দ তুলে গেল, এটা তো আগে শোনেনি বাবান, কীসের শব্দ ওটা? নূপুর? বাহ ! আনমনে হাসতে হাসতেই ঘরে ঢুকল বাবান | ফোনটা নিয়ে বসতেই ফেসবুকে দেখল,”অ্যাকসেপ্টেড রিকোয়েস্ট “…এটা দেখার পরই আনন্দে, উচ্ছাসে মনের ভিতর উথাল পাথাল হচ্ছিল বাবানের | তার মানে কৃতীও চায়…কৃতীও কি?…নাহ, এবার কথা বলতেই হবে, যে করেই হোক…এবার কথা বলবে, এখনই মেসেজ করবে? না, না, এখন ব্যস্ত, কলেজ গিয়ে করবো খন…| ফোনটা রেখে চলে গেল বাবান |
||৫||
বাবান বাড়ি ফিরে অবশেষে একটা “হাই” লিখে মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই রিপ্লাই এলো,”হাই”| বাবানের পেটে তখন হাজারটা প্রজাপতি উড়ছে যেন, ঠিক তখনই বাবানের মা খেতে ডাকল | ধ্যুর, এরকম টাইমে কেউ খেতে ডাকে? অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোনটা চার্জ-এ দিয়ে খেতে চলে গেল, ফোন নিয়ে গেলে মা খুব চেঁচামেচি করে | খেয়ে এসে ফেসবুক খুলতেই দেখল একটা মেসেজ এসছে কৃতীর, বাবান কী পড়ছে জানতে চেয়েছে | সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই দিল বাবান, কিন্তু ম্যাডাম ততক্ষনে অফলাইন, বাইরে জানলার দিকে তাকিয়ে দেখল জানলার ওপর অন্ধকার | এর মধ্যেই শুয়ে পড়ল?…আর পড়তে ইচ্ছে করছিল না, কাল সকালেই পড়তে যেতে হবে… কাল সকালেও দেখা হবে না… আকাশের মিটিমিটি তারা সাক্ষী রইল দুই মিষ্টি, নতুন প্রেমের…|
||৬||
আজ সকালেই বেরিয়ে পড়েছে বাবান, টিউশন, তারপর কলেজ, আবার একটা টিউশন | এত ব্যস্ততার মধ্যেও বারবার চেক করছিলো ফোনটা বাবান, নাহ, কোন রিপ্লাই নেই | সারাদিনের ব্যস্ততার পর ট্রামে করে বাড়ি ফিরছিল বাবান, পাশেই একটা ফুচকার স্টলে একটা মেয়েকে দেখল বাবান, ঠিক কৃতীকার মতোই না? ধ্যুর, নানা, মাথা খারাপ হয়ে গেছে ওর, নিজের উপর নিজেই হাসলো বাবান | বাড়ির কাছে আসতেই ট্রাম থেকে নেমে পড়ে, নেমে খানিকটা হাঁটতে হয় ওদের পাড়া অবধি ঢুকতে | হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার স্ট্রিট লাইটের আলো, বাতাসের ঠান্ডা ঝলকের মধ্যেও প্রেমের মাতাল করা ঘ্রান, সবকিছুই বড্ড ভাল লাগছিল বাবানের |
বাড়ির কাছে আসতেই তাল কাটলো, বাড়ির কাছে এত ভিড় কেন? কারো কী কিছু হলো? ভাবতেই মনটা ছ্যাঁৎ করে উঠল, মা বাবা ঠিক আছে তো? দৌড়ে গেল বাবান |
**************
….কৃতী আর নেই, একটা এক্সকারশনে যাচ্ছিল কলেজ থেকে, হাইওয়েতে ওদের বাসটার অ্যাক্সিডেন্ট হয়, স্পট ডেড | বড় লরিটার ধাক্কা সামলে আর বাড়ি ফেরা হলো না ওর |
কাউকে কিছু বলতে পারেনি বাবান, কিচ্ছু না | অন্ধকার ঘরে, সবার চোখের আড়ালে কেঁদেছে শুধু, যখন স্বপ্নটা ভাসা ভাসা থেকে জমাট বাঁধতে শুরুই করেছিল, তখনই এটা হতে হলো? ওর যে ওকে অনেক কিছু বলার ছিল…কৃতীরও যে কিছুই বলা হলো না | কখন যে পাশের বাড়ির মেয়েটা থেকে ওর হৃদয়ের অধিকারিণী হয়ে গেল, এত আপন হয়ে উঠল, নিজেই বোঝেনি |
**************
সেই বারান্দাটা, জানলাটা, একা দাঁড়িয়ে থাকে এখন, এখন আর কেউ অপেক্ষা করে না কাউকে দেখার | বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে কৃতীকার মা বাবা, বারান্দার টবগুলো, জানলার কাঁচগুলো আজ একাকী…. একাকী আরও একজন… মনের ভিতর সমস্ত অনুভূতিগুলোকে কবর দিয়ে এক অন্তহীন অপেক্ষায় |