||১||
-“বাবু ব্রেকফাস্টটা শেষ কর না… তুমি কিছু বলোও না বৌমা |”
মিনতি দেবীর কথা শেষ হতে না হতেই অর্ণব টেবিল ছেড়ে ততক্ষনে উঠে পড়েছে, পুরো ভাত ছেলে খায়নি বলেই মা-এর এহেন বাকি নিক্ষেপ | ওনার বৌমা মানে অর্ণবের বৌ অর্পিতা আপাতত অফিসে বেরবার আগের মুহূর্তে চূড়ান্ত ব্যস্ততায়, কোন উত্তর দিল না অর্পিতা |
অর্পিতা আর অর্ণবের বিয়ে হয়েছে এই মাস তিনেক | লেকটাউনের একটা ফ্ল্যাটে অর্ণব, অর্পিতা, মিনতি দেবী আর বিলাসবাবু থাকেন | বিলাস বাবু রিটায়ারমেন্ট নিয়ে আপাতত প্রকৃত নামার্থেই নিদ্রাবিলাসী এবং গ্রন্থবিলাসী জীবনযাপন করছেন, সাংসারিক খুটিনাটি নিয়ে নাকি তিনি একটুও মাথা ঘামাচ্ছেন না এই নিয়ে মিনতি দেবীর সঙ্গে ঝগড়া লেগেই আছে |
||২||
অর্ণব অর্পিতার দাম্পত্য জীবনটা বাইরে থেকে দেখে স্বাভাবিক মনে হলেও তা একদমই নয়, বরং একেবারেই আলাদা | ওদের arranged marriage, অর্ণব অর্পিতাকে বিয়ে করতে চায়নি, কিন্তু বাবার অসুস্থতার সামনে নিজের প্রেমকে বিসর্জন দিয়েছিল, যেমন হয় আর কী, এখানেও তাই | অর্ণবের প্রিয় বান্ধবী বা প্রেমিকা যাই বলা হোক না কেন, সেটা মিঠি, ওরফে মিতালী |
মিঠির বাবা হিন্দু মা খ্রিস্টান ছিলেন, মা বাবার সেপারেশন হয়েছিল যখন তখন মিঠির ১২, তাই খুব কম বয়সেই একাকীত্ব কী বুঝে গেছিল মিঠি | তারপর অর্ণব ওর জীবনে যখন থেকে আসে, তখন থেকে খুব আনন্দে কাটতো দিনগুলো | হাসি, ঠাট্টা, ইয়ার্কি, ফাজলামিগুলো যেন প্রেমের থেকেও বেশি হতো | কিন্তু সুখ তো ক্ষণস্থায়ী, রইল না | বাবা মা-এর inter religion marriage আর divorce-এর অপরাধের ভাগীদার হলো মিঠি, পারেনি অর্ণব মিঠিকে ওর প্রাপ্য সম্মান দিতে, মা বাবা পরিবার সমাজের অজস্র শর্তের পাহাড় ডিঙিয়ে | তাই আজ অর্ণব অর্পিতা একসঙ্গে, অর্ণব-মিঠি নামটা আজ মুছে গেছে | অর্ণবের অফিসের ডেস্কে মিঠির যে ছবিটা জ্বলজ্বল করত সেটা আর নেই |
মিঠি আর অর্ণবের সাথে সেই কলেজ থেকে , কলেজ পেরিয়ে ইউনিভার্সিটি, এখন অফিসেও সেম ডিপার্টমেন্ট | অর্ণবের সাথে এখন যতটা সম্ভব কম কথা বলে মিঠি, কী করবে? একটা চাকরি না পাওয়া অবধি তো ছাড়া যায় না, টাকারও তো দরকার, কেউ তো নেই ওর |
অর্ণব ঢুকলো অফিসে, মিঠি মুখটা নামিয়ে নিল | অফিসে ওদের বন্ধুদের মধ্যেও অসন্তোষের পাহাড়, বন্ধুদের মধ্যে স্বাভাবিক ব্যবহারটাই যেন এখন নেই |
||৩||
অর্পিতা আজ টিফিন না নিয়েই বেরিয়ে পড়ল অফিসে, বেশ লেট হয়ে গেছে আজ | কালরাত্রে ঠিক মতো ঘুমও হয়নি, আবোল তাবোল ভাবনাগুলো মাথায় জট পাকিয়েই আছে, বাড়িতে কানাঘুষোয় মিঠি নামটা কানে এসেছে ওর | অর্ণবের সাথে ওর সম্পর্কটা মোটেই স্বাভাবিক নয়, যে ওর থেকে কিছু জানবে | তবে এটুকু বুঝে গেছে অর্ণব ওকে বিয়েটা নিতান্ত বাধ্য হয়েই করেছে | কী দরকার ছিল এরকম বিয়ের? এভাবে সব লুকিয়ে? অনেক অভিযোগ, অভিমান জমে আছে ওর মনের মধ্যে, কিন্তু জিজ্ঞেস কাকেই বা করবে, কিছু বললেই বা শুনবেটা কে?
কাল অনেক রাত অবধি ঝাপসা চোখে ব্যালকনিতে বসেছিল অর্পিতা, ভাবছিল, কেন মা? খুব কী বোঝা হয়ে গেছিলাম তোমাদের যে এভাবে একটা ভুলভাল সম্পর্কের সাথে বেঁধে দিলে? যে দাম্পত্যে ভালবাসা, বোঝাপড়া নেই, সে বিয়েটা কী আদৌ বিয়ে? বিয়ের পর থেকে অর্ণব কটা কথা বলেছে হাতে গোনা যাবে | কী দরকার ছিল এই ‘বিয়ে’ নামক খেলাটার?
*****************
অর্ণব বারবার মিঠির সাথে কথা বলতে চেয়েছে, পারেনি, মিঠি বারবার এড়িয়ে গেছে | অর্ণব তো ছেলে, চোখের জল ফেলার অনুমতিটাও নেই | বাবার অসুস্থতার সামনে নিজের ভালবাসাকে বলি দিয়ে কাকে বাঁচাল জানে না, কিন্তু নিজের জীবনটা শেষ হয়ে গেল এটা নিঃসন্দেহে জানে | যাকে চেনে না, জানে না, বোঝে না, তার সাথে থাকা আর মনে অন্য কেউ, এই যন্ত্রনা যে ভোগ করেছে একমাত্র সেই জানে | বাবার heart attack, bypass surgery এসব কিছুর পর আবারও অশান্তি শুরু হলে হয়তো বাবাকে আর বাঁচানো যেত না, কিচ্ছু করার ছিল না আর তখন অর্ণবের | এখন বাবা অনেকটাই সুস্থ |
অর্ণব বোঝানোর চেষ্টা করেছে মিঠিকে, বারবার কথা বলার চেষ্টা করেছে, কিন্তু বিফল | এই মিঠিকে যেন চেনেই না অর্ণব, যেন এক অন্য মানুষ |
||৪||
বারবার মিঠিকে ফোন করছে অর্ণব, আজ রোববার, আজ একবার দেখা করতেই হবে | বেশ কয়েকবার ফোন করে বিফল হয়ে ফোনটা রেখে নীচে চলে গেল অর্ণব |
রবিবারটা একটা অনাথ আশ্রমে কাটায় মিঠি, ওখানেই ছিল, ফোনটা সাইলেন্ট করা ছিল তাই শুনতে পায়নি | কিছুক্ষন পর ফোনটা বেরকরে অর্ণবের এতগুলো মিসডকল দেখেও রেখে দিতে যাচ্ছিল মিঠি, তারপর মনে হলো কিছু কী হয়েছে? হঠাৎ এতগুলো ফোন? অনেক দোনামোনা করে অবশেষে ফোনটা করল মিঠি |
*************
আজ একবার বাপেরবাড়ি যাবে ভাবছিল অর্পিতা, এমনিও সারা সপ্তাহ অফিস বাড়ি করতেই কেটে যায় শুধু রবিবারটা যেন একটা দমবন্ধ করা পরিবেশ, তাই বেরিয়ে যাওয়াই ভাল | হঠাৎ রেডি হতে হতে অর্ণবের ফোনটা বেজে উঠল, ফোনের স্ক্রিনে নাম উঠল ‘মিঠি’ | এই নামটাই চুপিচুপি দেওয়ালের আনাচে কানাচে একাধিকবার নানা ভাবে কানে এসেছে অর্পিতার, কিন্তু পুরোপুরি ব্যাপারটা আজও জানে না অর্পিতা, তাই ধোঁয়াশাটা রয়েই গেছে | ফোনটা নিয়ে অর্ণবের কাছে পৌঁছতে গেল অর্পিতা, তখনও ফোনটা বাজছে… মিঠি নামটার উপর চোখ দুজনেরই | অর্ণব হতভম্ব | অর্পিতার দিকে চোখ তুলে ভালভাবে তাকাতে পারল না অর্ণব, কিন্তু অর্ণব তো এটাই চেয়েছিল, অর্পিতাকে সবটুকু জানিয়ে দিতে, যে ও একমাত্র মিঠিকে ভালবাসে | কিন্তু ভাবা আর বলার মধ্যে অনেক ফারাক |
চোখ দুটো অবনতি রইল অর্ণবের | চোখ তুলে তাকালে দেখতে পেত অর্পিতা একদৃষ্টে তাকিয়েছিল অর্ণবের অবনত চোখ দুটোর দিকে | সে দৃষ্টিতে ঘৃণা ছিল না, ছিল অনেকটা অভিমান, অনেকটা কষ্ট, আরেক অজস্র প্রশ্ন,’খুব দরকার ছিল কী আমার সাথে এই বিয়ে বিয়ে খেলাটা করার?’
ফোনটা কেটে গেল, ধরতে পারল না অর্ণব, শেষমুহূর্তে একবার তাকাল অর্ণব অর্পিতার দিকে | একটি শব্দও উচ্চারিত হয়নি অর্পিতার মুখ থেকে, অর্পিতা সঙ্গে সঙ্গে চলে গেল | কিছু না বলেও যেন অনেক কিছু বলে দিয়ে গেল |
*************
কিছুক্ষন পর অর্ণব ফোন লাগাল আবার মিঠিকে, চোখটা বন্ধ করলেই বারবার ভেসে উঠছে অর্পিতার চোখ দুটো, যেন অর্ণবের জায়গাটা বুঝিয়ে দিয়ে গেল | কী করছে অর্ণব? একবার মিঠির জন্য পাগল, অন্যদিকে অর্পিতার সামনে লজ্জিত | খুব অসহায় লাগছিল অর্ণবের নিজেকে | ওপাশ থেকে ফোনটা ততক্ষনে ধরল মিঠি |
“হ্যালো”, অনেক কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছিল না অর্ণব |
-“হ্যাঁ বল, এতবার মিসডকল? কী ব্যাপার?”
-“এখন তোমায় এতবার ফোন করছি কেন তার জবাবও চাইছ?”
-“পরিস্থিতিটাও তো আর আগের মতো নেই, তাই না? কী বলবে বল?”
-“প্লিজ আজ একবার দেখা করতে পারবে? প্লিজ, আর না করো না | অনেক কটা কথা বলার আছে অনেকদিন ধরে… |”
অর্ণবের অনেক অনুনয় বিনয় শেষে একপ্রকার বাধ্য হয়েই মিঠি দেখা করল অর্ণবের সাথে | অর্ণবের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত নিজের মনের সাথে লড়াই করে, তাও একবারও জিজ্ঞেস করতে পারল না মিঠি, যে কেমন আছ? কী হয়েছে? কারণ এই প্রশ্নগুলো করে ওপাশের মানুষটাকে লজ্জিত করে লাভটাই বা কী? একই অবস্থা তো মিঠিরও |
***************
আগে মিঠি আর অর্ণব এখানেই দেখা করত, সামনে দিগন্ত বিস্তৃত গঙ্গা, সূর্যাস্ত, সামনের ফাঁকা বেঞ্চটাও যেন ওদেরকে একসাথে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছিল | পাখিগুলো দল বেঁধে বাসায় ফিরছে, গোধূলির কনে দেখা আলো যেন মিঠির লাবণ্য আরো কয়েকগুন বাড়িয়ে দিয়েছে | সেদিকে দেখতে দেখতেই যেন চোখের কোণে নজর গেল অর্ণবের, চোখের কাজল যেন চোখের নিচের কালিটাকে ঢাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে, সাথে মিঠির মুখের মেকি হাসিও সেই চেষ্টায় সামিল | কিন্তু অর্ণবের চোখ এড়ায়নি মিঠির রাত জাগা ক্লান্ত চোখ দুটি |
গঙ্গার ঝোড়ো হওয়াতে যেন একটা নেশা জড়িয়ে, ইচ্ছে করছে সবকিছু ভুলে হারিয়ে যেতে, আবার যদি নতুন করে শুরু করা যেত, যদি যা ঘটেছে তা একটা দূর স্বপ্ন হতো…. | হঠাৎ মিঠির গলার আওয়াজে নিজেকে সামলে নিল অর্ণব |
“বলো, কী বলবে?”, মিঠিই প্রশ্ন করল অর্ণবকে,”হঠাৎ এভাবে দেখা করার কী দরকার পড়ল?”
অর্ণবের দীর্ঘশ্বাসটা যেন গঙ্গার ঝোড়ো হওয়ার মধ্যও বড় বেশি করে কানে বিঁধল, বলল,”আগে তো কারণ ছাড়াই দেখা করতাম | জানি বলবে, আগের আর এখনকার পরিস্থিতি এক না, জানি, আর একবার কী শুরু করা যায় না?”
অর্ণবের এরকম অবান্তর কথা শুনে মিঠি মুখের অভিব্যক্তি দিয়েই বুঝিয়ে দিল যে এরকম অযৌক্তিক কথাবার্তা বলা বন্ধ করলেই ভাল হয় | বলল, “ভুলভাল কথা বলতেই ডেকেছ তাহলে? তুমি যেটা বলছ সেটা করলে তো আমার বাবা আর তোমার মধ্যে কোন তফাৎই থাকবে না | আমার বাবাও আমার মা-র হাত ছেড়েছিল, তুমিও অর্পিতার সাথে একই অন্যায় করবে, তফাৎটা কী?”
অর্ণব কী বলবে খুঁজে পাচ্ছিল না | ওর ভাবনা থামিয়ে মিঠি আবার বলল,”অনেক দেরী হয়ে গেছে, এভাবে দু নৌকায় পা দিয়ে তো চলা যাবে না আজীবন | অর্পিতা মেয়েটা তো কোন দোষ করেনি, তাহলে একবার ওকে বিয়ে করে, আবার ডিভোর্স করে এত সমস্যার মধ্যে কেন ফেলতে চাইছ? ও তো এত জটিলতার বিন্দু-বিসর্গও জানে না |”
অর্ণব অবাক হয়ে দেখল, যে মিঠি অর্পিতাকে চেনেই না, আজ ওর জন্য কথা বলছে | অর্ণব বলল, “ওকে তো চেনোই না, দেখিনি, তাহলে ওর জন্য আজ আমায় না বলছ?”
মিঠি হেসে বলল,”অর্পিতার জায়গায় অন্য যে কোন মেয়ে থাকলেই আমি এটাই বলতাম | এই পরিস্থিতিতে আমরা কেউই ভাল নেই, না তুমি, না অর্পিতা, আর আমার কথা….”, শেষ করতে পারল না কথাটা মিঠি | চোখের জলটা যত দ্রুত সম্ভব মুছে নিয়ে বলল, তার থেকে একজন অন্তত করুক sacrifice, বাকি দু’জন অন্তত ভাল থাকুক | ভাল আর খারাপের মধ্যে বাছা খুব সহজ নয় অর্ণব, দুটো ঠিক বা দুটো ভুলের মধ্যে কোনটা বেশি ঠিক বা ভুল সেটার সঠিক সিদ্ধান্তই তো আমাদের জীবন নির্ধারণ করে | তাই বলব, আর যা সম্ভব না, তার পিছনে না দৌড়ে যে আছে তাকে অন্তত ভাল রেখো, নিজেও ভাল থেকো | অনেকটা দেরী হয়ে গেছে |” এটুকু বলেই উঠে পড়ল মিঠি | ও জানে আর বেশিক্ষন থাকলে ওর গলার কাছে দলা পাকানো কান্নাটা আড়াল করে রাখতে পারবে না |
অর্ণবকে আর বেশি কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল মিঠি, একটা ক্যাব নিয়ে বেরিয়ে গেল ঝটপট | বাইরে তখন বৃষ্টি নেমেছে, সঙ্গে মিঠির চোখেও, অনেক কষ্টে সে এতক্ষন নিজেকে আটকে রেখেছিল | যেভাবেই হোক ওকে ট্রান্সফার নিয়ে এখন থেকে চলে যেতেই হবে, ও এখানে থাকলে এই পরিস্থিতি কোনদিন বদলাবে না | আজ অর্ণব অর্পিতাও যদি ডিভোর্সের দিকে এগোয় সেই তো এক-ই কান্ড হবে, আর এখন এসব ভেবে লাভটাই বা কী? মিঠির কী অপরাধ মিঠি আজও জানে না, কিন্তু অর্ণবের মা বাবা তো মিঠিকে মানেনি, মানবেও না, শুধু পরিস্থিতি জটিল হওয়ার আগেই ওর এখান থেকে চলে যাওয়াই শ্রেয় | কিন্তু মন কী মানে? ডুকরে কেঁদে উঠল মিঠি, আর কত নিজেকে শক্ত দেখানোর ভান করবে লোকের কাছে |
**************
বাইরের মুষলধারার বৃষ্টি নেমেছে, ভাগ্যিস নেমেছিল তাই অর্ণবের চোখের বৃষ্টিটা আলাদা করে আর বোঝা যাচ্ছে না | আর পারছে না ও, এর থেকে ভাল নিজেরই শেষ হয়ে যাওয়া | যবে থেকে ভালবাসা কী বুঝতে শিখেছে, মিঠি ছাড়া আর কারো কথা ভাবতেই পারেনি | বাবার বাইপাস সার্জারীর সময় বাবাকে হারানোর ভয়টা বড্ড বেশি হয়ে গেছিল মিঠিকে হারানোর থেকেও, তাই আর কিচ্ছু বলতে পারেনি ও | মিঠিকে নিয়ে অনেক অশান্তির পরই বাবা এভাবে অসুস্থ হয়ে পরে, তখন আর কোন মুখে বলত? বাবার পছন্দের মেয়ে অর্পিতাকে বাধ্য হয়েই তাই…|
একেবারে কাক ভেজা হয়ে গেছে অর্ণব, এই বৃষ্টিটাই যদি সমস্ত যন্ত্রনা ধুয়ে নিয়ে যেতে পার্ট, কত ভাল হতো | নেশায় চুর অর্ণব মিঠিকে ফিরে পাবার কাতর আকুতি জানালেও ওপাশ থেকে আর কোন উত্তর পেল না, মিঠি যখন একবার বলেছে না, তখন না |
**************
অঝোর ধারার বৃষ্টিতে আটকে পড়েছে অর্পিতা, বাপের বাড়ি থেকে ফিরছিল, কাল আবার অফিস, অফিসটা শ্বশুরবাড়ি থেকেই কাছে | সঙ্গে ছাতাও নেই, এর মধ্যে বেশ ক’বার বাবা-মা মানে শ্বশুরমশাই শাশুড়িমা ফোন করে ফেলেছেন, মানুষ দুটো খুব ভালবাসে অর্পিতাকে | একজন ছাড়া সবাই খেয়াল রাখে মনে হয়, সে তো জানেও না অর্পিতা কোথায় গেছে, কখন ফিরবে | এই বৃষ্টিতে ক্যাব পাওয়া মুশকিল তাও ট্রাই করল অর্পিতা, currently unavailable দেখাচ্ছে, অপেক্ষা করা ছাড়া উপায়ও নেই |
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই অন্যমনস্ক অর্পিতা ভাবছিল, অর্ণব নিশ্চয় ওর মিঠির সাথেই দেখা করতে গেছে, ওর অর্পিতার কথা মনেই নেই, আর মনে থাকবেই বা কেন? কে হয় অর্পিতা ওর? অথচ প্রথম বিয়ের কথাবার্তার সময় অর্পিতা একবার অর্ণবের ছবি দেখেই খুব ভাল লেগে গেছিল, তখন কী জানত এরকম কিছু… | মিঠি কত লাকী, ও ওর কাছে না থেকেও ওর মনে, আর অর্পিতা ওর সাথে এক ঘরে থেকেও ওর মনের কোথাও নেই… কেন? ওর সাথেই এরকম কেন হলো? ও তো জ্ঞানত কারো কোন ক্ষতি করেনি, তাহলে আজ ওর সাথেই এরকম কেন হচ্ছে?…. ভাবতে ভাবতে কখন চোখ দিয়ে নোনতা জলের ধারা নেমেছে খেয়াল নেই ওর |
||৫||
নেশায় চুর অর্ণব ভিজে যখন বাড়ি ফিরে তখন রাট ৯টা | অর্পিতা তখনও বাড়ি ফিরতে পারেনি, তাই অর্ণবের মা বাবা ঘর বার করছেন, ছেলে যে একটু গাড়িটা নিয়ে আনতে যাবে সে অবস্থায় তার নেই |
প্রায় পৌনে দশটা নাগাদ অর্পিতা বাড়ি ফিরল অনেক কষ্টে | সাবিত্রী দেবী মানে অর্ণবের মা সবটাই জানেন, বোঝেন, তিনটে জীবন এভাবে শেষ হচ্ছে | উনি কোনদিনই চাননি ওনার ছেলেকে এ’অবস্থায় দেখতে, কিন্তু পরাশর বাবু কোনদিনই স্ত্রীর কথাকে গুরুত্ব দেননি | অর্পিতা যখন ঘরে ঢুকল অর্ণব তখন বেহুঁশ | সাবিত্রী দেবী আজ লজ্জিত অর্পিতার সামনে, অবস্থাটা সামলাতে অর্পিতাকে ,”ও তো খাবে না, তুমি চলে এসো মা, কাল তো তোমার অফিস, খেয়ে শুতে হবে” বলে চলে গেলেন |
ফ্রেশ হতে ঢুকতে গিয়েই কানে এল সেই ‘মিঠি’, অর্ণব বেহুঁশ হয়েও সেই নামটাই নিচ্ছে | আরও একবার রক্তাক্ত হলো অর্পিতার মনটা, এভাবে চলতে পারে না, ও চলে যাবে এখন থেকে , তাতে জড়ো ওরা ভাল থাকে তাই | তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে ঢুকে গেল অর্পিতা |
||৬||
(কিছুদিন পর)
-“আমি বললাম তো না, কেন বারবার একই কথা বলছি অর্ণব? আমাদের মধ্যে আর কিছু বেঁচে নেই, আর কিছু হতেও পারে না | অনেক দেরি হয়ে গেছে, এখন তোমার সাথে যে আরেকটা মেয়ের জীবনও জড়িত, সেটা কেন ভুলে যাচ্ছ তুমি? প্লিজ আমার বাবার মত তুমিও অর্পিতার মতো একটা মেয়ের সাথে এত বড় অন্যায়টা করো না, পারলে আমার এই কথাটা রেখো, আর প্লিজ ফোন করা বন্ধ করো | রাখো |”
রেখে দিল ফোনটা মিঠি, বারবার অর্ণবকে ফিরিয়ে দিতে দিতে ও-ও বড্ড ক্লান্ত, আর কতদিন নিজের ভালোবাসাকে আড়াল করে শক্ত থাকার ভানটা চালাবে ও?
বসকে ট্রান্সফারের ব্যাপারে বলে বেরিয়ে নিজের চেয়ারে বসল মিঠি |
(ঘন্টা খানেক পর)
চোখ দুটো একটু বন্ধ করেছে ওমনি ফোনটা আবার বেজে উঠল | এই তো ঘন্টা খানেক আগে ফোন করল অর্ণব, আবার নিশ্চয়… বলতে বলতেই দেখল অর্ণবের ফোন | বিরক্ত হয়ে ধরল ফোনটা,”হ্যালো, কী ব্যাপারটা কী হ্যাঁ?
-“হ্যাঁ, হ্যালো, এখানে একটা accident হয়েছে, আপনার নাম্বারটাই লাস্ট ডায়ালড ছিল |”
এক মুহূর্তের জন্য চারপাশটা অন্ধকার হয়ে গেল মিঠির, দুটো কান যেন ভোঁ ভোঁ করতে লাগল, পায়ের তলা থেকে মাটিটা যেন সরে গেল মিঠির |
***************
নার্সিং হোমে যতটা দ্রুত পৌঁছানো যায় পৌঁছাল মিঠি | ড্রাঙ্ক অবস্থায় গাড়ি চালানোর জন্যই accident, সন্দেহ করছে পুলিশ | ফর্মালিটি শেষ করেই অর্ণবের বাড়িতে ফোন করল মিঠি, চোখ তখন জলে ঝাপসা |
***************
অর্ণবের আকসিডেন্টের খবরটা বাজের মত পড়ল | অর্পিতার সাথে অর্ণবের এই ক’মাসে কোন সম্পর্ক হয়তো তৈরি হয়নি, তবুও অর্ণবের কথাটা শুনে অর্পিতার চোখে যেন সব হারানোর তীব্র একটা ভয় | অথচ অর্ণব কোনদিন অর্পিতাকে ভালভাবে দেখেছে কী না সন্দেহ |
মা বাবাকে নিয়ে অর্পিতা নার্সিং হোমে পৌঁছাল, প্রতিটা মুহূর্ত যেন এক একটা যুগের সমান |
অর্পিতা এই প্রথম মিঠিকে দেখল, এভাবে কোনদিন দেখা হবে ভাবতে পারেনি | কিছু বলতে পারেনি অর্পিতা, চুপ ছিল মিঠিও, কিন্তু তাও যেন না বলে অনেক কথা হয়ে গেছিল দুটো মানুষের মধ্যে, অর্পিতার চোখে অপার কৃতজ্ঞতা, মিঠির চোখে স্বার্থ ত্যাগের ইঙ্গিত |
(কিছুদিন পর)
অপারেশন successful , অর্ণব এখন খানিকটা সুস্থ হয়েছে | এই ক’দিনে মিঠিকে একবারও দেখিনি অর্ণব, বারবার ওর চোখ খুঁজেছে মিঠিকে, কিন্তু দেখেছে অর্পিতাকে, দিন রাট এক করে সেবা করেছে অর্ণবের, ওর চোখে অর্ণবকে হারিয়ে ফেলার একটা তীব্র ভয় স্পষ্ট |
মিঠির কথা কাকেই বা জিজ্ঞেস করবে অর্ণব? শেষবার জ্ঞান হারানোর আগে আর জ্ঞান ফিরে অর্ণবের প্রথম শব্দ ছিল ‘মিঠি’| কিন্তু বারবার অর্ণবের চোখের সামনে উপস্থিত হয়েছে মিঠি নয় অর্পিতা | এই অবস্থায় মিঠি ওকে ফেলে পারল চলে যেতে? এ কিছুতেই হতে পারে না |
**************
accident-এর প্রথম দিন থেকে রোজ উদ্ভ্রান্তের মত ছুটে এসেছে, অর্ণবের কেবিনটার বাইরে বসে থেকেছে মিঠি, দরজার কাচের ফাঁক দিয়েই নিজের অর্ণবকে দেখে শান্ত করেছে নিজেকে | কিন্তু আর একবারও অর্ণবের সামনে আসেনি, পাছে আবার দুর্বল হয়ে পড়ে, যদি ছেড়ে যেতে না পারে, চোখের কোণের টলটলে জলটা টুপ করে গাল বেয়ে পড়ল মিঠির | কাচের ফাঁক গলে অর্ণবের ইতিউতি মিঠিকে খোঁজা দেখে, হঠাৎ অর্পিতা পিছন থেকে বলল,”এত যখন ভালবাস তখন কিসের এত বাধা? ভেঙে দিতে পারনা সব বাধা?”
চমকে গেল মিঠি, অর্পিতাকে এভাবে এখানে expect করেনি, “এখন আর সেটা সম্ভব না, তোমরা ভাল থেকো |”, আর বেশি কিছু বলতে পারেনি মিঠি, বলার প্রয়োজনও নেই |
অর্ণবের মা বাবা দেরীতে হলেও মিঠিকে বুঝেছে, চিনেছে, হেরে গিয়েও যেন জিতে গেল মিঠি | আরও একবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, ধর্ম, বর্ণ, জন্ম এগুলো কখনো একটা মানুষের একমাত্র পরিচয় হতে পারে না | এগুলো কখনো একটা মানুষকে বিচার করার প্যারামিটার হতেই পারে না, তার কাজই তার পরিচয় দেয় | অর্ণবের মা বাবা ক্ষমা চাইতে পারেননি বটে, কিন্তু মিঠির হাত দুটো ধরে তাদের নতমস্তক সবটুকু দিয়ে গেছিল |
*************
“আমি জানি, তুমি এখানেই আছো, আমার কাছেই, শুধু আমার সামনে এলে না, তাই তো, আমি তোমায় ভালবেসে তোমার কথাই রাখব মিঠি, অর্পিতাকে আমি ভাল রাখার চেষ্টা করব |”, দীর্ঘশ্বাস ফেলে হসপিটালের বেডে শুয়ে মনে মনে বলল অর্ণব | ট্রান্সফার নিয়ে মিঠির ট্রেন তখন দ্রুতগতিতে ছুটে চলেছে,”কথা ছিল হেঁটে যাব ছায়াপথ… আজও আছে গোপন…ফেরারী মন…|”