একফালি প্রেম

||১||

“মুকুটটা একটু ঠিক করে দিন… হ্যাঁ ঠিক আছে |”

কনের সাজ সম্পূর্ণ হলো | রক্ত লাল বেনারসি, রজনীগন্ধার মালা , নথ, ঠিকলিতে অপরূপা রূপসা বসে আছে আবিরের অপেক্ষায় | আজ দীর্ঘ দশ বছর পর অবশেষে বিয়েটা হচ্ছে | ‘অবশেষে’ শব্দটা এই কারণে কারণ প্রেমটা আদৌ বিয়ের পিঁড়ি অবধি পৌঁছাবে কী না সেই নিয়ে সন্দেহ ছিল রীতিমত |

চুপচাপ নিজের ঘরে বসে আছে রূপসা | সকাল থেকে অনেক ধকল গেছে, এখনও অনেক কাজ বাকী, একটু পরেই বিয়ে বসবে, বরযাত্রী আর বর এখনো মাঝ রাস্তায় | চোখটা বুজে ভাবছিল রূপসা, ছবিগুলো যেন অতীতের পাতা থেকে উড়ে আসছিল পরপর, এতটাই স্পষ্ট মনে আছে সবটা |

রূপসা আর আবিরের প্রেম বিগত দশ বছরের, কলেজ জীবন থেকে | রূপসার আজও মনে পড়ে প্রপোজ করার দিনটা | রূপসার আবিরকে বেশ পছন্দই ছিল, যেমন কলেজ জীবনে হয় আর কী, আবিরকে দেখতে মন্দ লাগত না রূপসার, তবে ভাল লাগাই ভালবাসায় গড়াবে, স্বপ্নেও ভাবেনি | আবির বরাবরই একটু লাজুক, মানে মেয়েদের সাথে কথা বলতে খুব বেশি স্বচ্ছন্দ নয় | তাই আবির শুধু রূপসাকে দেখতই, শুধু চোখের দেখায় সম্পর্কটা সীমাবদ্ধ ছিল বেশ কিছুদিন | চোখের দেখা থেকে কথায় গড়িয়ে শুধু বন্ধুত্বের পর্বে সম্পর্কটা আবার বেশ কিছুদিন স্থায়ী হয়েছিল, তারপর হুট করে যেন সব কিছু হয়ে গেছিল, সাইকেলটা বের করে রওনা হচ্ছিল রূপসা বাড়ির উদ্দেশ্যে, ওর হাতে একটা মোটা সোটা খাম ধরিয়ে দিয়ে নিজের সাইকেল নিয়ে ছুট লাগিয়েছিল আবির |

খানিক্ষন হতভম্বের মতন দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে বাড়ি ফিরে প্রথম সেই প্রেমপত্রটা খুলেছিল, লুকিয়ে, সবার অলক্ষ্যে সেদিন একটা লাজুক সাধারণ ছেলে রূপসার মনে ঝড় তুলেছিল নিজগুনে | আড়ম্বর, আতিশয্য এই শব্দগুলো আবিরের সাথে কোনোদিনই যায় না, এক্ষেত্রেও তাই-ই হয়েছিল | খুব সাধারণ একটা চিঠি, কিন্তু পরম যত্নে লেখা, এত সুন্দর যার বাচনভঙ্গি, কথা বলা, তার উপর পরম যত্নে খুব সহজে অথচ সোজাসুজি নিজের মনের পর্দায় পরম যত্নে আঁকা রূপসার ছবিটা তুলে ধরেছিল আবির | রূপসা শুধু মুগধ হয়েছিল বললেও কম বলা হয় | সেই শুরু, তারপর আবিরের সব কিছুর সাথেই যেন একাধিকবার প্রেমে জড়িয়েছিল রূপসা |

আবির খুব ভাল গিটার বাজায়, রিইউনিয়নের সময় প্রথম শুনেছিল আবিরের বাজানো গিটারের সুরগুলো, সুরের মূর্ছনায় আরও একবার প্রেমে কুপোকাত হয়েছিল রূপসা, গিটারের সুরগুলো যেন নিজের শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, রক্তে মিশে গেছিল রূপসার |

||২||

প্রেম নিজের নিয়মে বাড়ছিলই, আবিরের বাড়ির অবস্থা খুব একটা ভাল নয়, তবুও নিজের মত করে মা বাবার পাশে দাঁড়ানোর, নিজে যত দ্রুত সম্ভব কিছু করার চেষ্টা করছিল আবির | রূপসার মা বাবার প্রথম থেকেই আবিরকে তার দারিদ্রের জন্য একদমই পছন্দ ছিল না, সেই সুবাদে রূপসাকে বহু মানসিক অত্যাচারও সহ্য করতে হয়েছে | ওদের কলেজ শেষ হওয়ার পর পরই মাস্টার্স করতে রূপসাকে অনেক দূরে পাঠিয়ে দেয় ওর মা বাবা, রূপসার অনিচ্ছা সত্ত্বেও বহুবার বিয়ের দেখাশোনাও করেছে ওর মা বাবা ….এভাবেই অনেকরকম ভাবে মানসিক চাপও সহ্য করতে হয়েছে রূপসাকে |

**************

আবিরের মা বাবা কিন্তু রূপসাকে প্রথম থেকেই মেনে নিয়েছিল আর সবদিন সেই মানুষ দুটোকে নিজের পাশে পেয়েছে রূপসা |

||৩||

আবিরের থেকে রূপসাকে অনেকবার আলাদা করার চেষ্টা করেও বিফল হয়ে অবশেষে বিয়েতে মত দিল রূপসার মা বাবা, একপ্রকার বাধ্য হয়েই |

চোখ বুজে আবিরের হাসি, আবিরের হাতের প্রথম ছোঁয়া, এসব কিছু ভাবতে ভাবতেই আলতো হাসিটা নিজের অজান্তেই উঁকি মারছিল রূপসার ঠোঁটের কোণে | অবশেষে ওরা সারাজীবনের জন্য একে অপরের হাত ধরতে চলেছে, বাইরে সানাইয়ের আওয়াজ, আলোর রোশনাই, মানুষজনের ভিড়, আনাগোনা, সবকিছুই ওকে কেন্দ্র করে | নিজের বেনারসির কুচিটা ঠিক করতে করতে ফোনটা চেক করল রূপসা | আবির বলেছিল, বিয়ের সাজে প্রথম আমিই যেন তোমায় দেখি, ফটোটা এখনও ডেলিভার্ডই হয়নি |

বাইরে বিয়ের অনুষ্ঠানের তোড়জোড় চলছে, তাই রূপসা ভিতরে ঘরে বসে, এখন আপাতত একা, বাইরে কিসের কোলাহল শুনছে, প্রথমে আমল না দিলেও পরে কোলাহলটা বেশিই কানে লাগতে লাগল | নিজের বেনারসি, ভেল সামলে যেই বেরতে যাবে অমনি মেজদিভাই ওর ঘরের কাছে এসে দোর আটকালো,”তোর একটু পরেই বিয়ে, তুই একদম বেরোবি না এসবের মধ্যে |”

-“কিন্তু কী হয়েছে সেটা তো বলো?”,বলতে বলতেই কানে এলো আবিরের নামটা | খুব সন্তর্পনে সবাই যেন আবিরের ব্যাপারে কথাগুলো আড়াল করার চেষ্টা করছিল রূপসার থেকে |

….আবিরের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে রাস্তায়….অবস্থা ভাল নয়….চারপাশটা কেমন অন্ধকার লাগছিল রূপসার…পায়ের তলার মাটিটুকু নেই আর যেন….

||৪||

স্বপ্নটা দেখে আরও একবার চিৎকার করে উঠল রূপসা ব্যানার্জী, ‘মন’ মানসিক হাসপাতালের ৭ নম্বর বেডের পেশেন্ট |

রূপসা আর আবিরের মা বাবা এখন অসহায় দর্শক ছাড়া কিছুই নয় | ওর চোখের আপাত শান্ত কিন্তু কী গভীর চাহনি, দেখলে বুক কেঁপে ওঠে, মাত্র ৩০ বছর বয়সের তরতাজা একটা প্রাণ… নার্সিং হোমের বেডে শুয়ে…অন্তহীন এক অপেক্ষায়, হয়তো আবির ফিরে আসবে…বিয়ের অসম্পূর্ন স্বপ্নটা সত্যি হওয়ার কী নিদারুণ অথচ অসম্ভব এক আকাঙ্খা, বিয়ের রাতেই নিজের আবিরকে হারিয়ে রূপসা আজও পারেনি জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে |

বারবার ঐ একটাই স্বপ্ন তাড়া করে বেড়ায় রূপসাকে, স্মৃতি শক্তি হারিয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে, কিন্তু এটা একবারের জন্যও ভুলতে পারে না ও | সবকিছু তছনছ করে দিয়ে আবির চলে গেছিল সেদিন রূপসাকে ছেড়ে, চিরকালের জন্য |

রূপসা আর কোনদিন ভাল হবে কী না জানা নেই কিন্তু ওর চারপাশে এখনো ও সবসময় ওর আবিরকে অনুভব করে, ঘটনার ২ বছর পরও |

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

মুক্তি

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেল, আকাশ তখন থেকে ঠায় বসেই রয়েছে ঘাটে। এখন বাঁধানো ঘাট থেকে করিডোর হয়ে বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরে পুজো দেওয়া অনেকটা সহজ

Read More »

বন্ধু হবি চল

বাক্সপেটরা নিয়ে স্টেশনেই বসে ছিল নয়না, বৃষ্টি পড়েই চলেছে, মুষলধারায়। বাবা বলল আরেকটু অপেক্ষা করতে, এত বৃষ্টিতে তো ছাতাও হার মানবে, আর বেরিয়ে রাস্তাও অজানা

Read More »

টিফিনবাক্স

প্রতিবারের মতন এই বছর ও সমস্ত সরঞ্জাম গুছিয়ে বেরোনোর জন্য ব্যস্ত অমিত, অন্তত সন্ধ্যার মধ্যে বেরোতে না পারলে খুব মুশকিল। পুজোর দিকটা কতদূর কি হলো

Read More »

ক্লিক

।।১।। -“মালিনী, কালকের মিটিংটা কখন ফিক্স করেছ? -“ম্যাম, সকাল ১১টা।” -“ওকে, কনফার্মেশন পেয়ে গেছ?” -“ইয়েস ম্যাম।” -“ওকে গুড। আর।।। এক মিনিট।।।” টেবিল থেকে ফোনটা তুলে

Read More »

শিক্ষা

।।১।। দাপুটে, বদরাগী, মেজাজি এই সব কটা বিশেষণই বেশ ভালো যায় মিসেস বোসের সাথে। রেণুকা বোস আর অমরনাথ বোস সানফ্লাওয়ার এপার্টমেন্টে ১২০০ স্কোয়ারফিটের ফ্ল্যাট 2c

Read More »

বিদায়

।। ১।। রীতিমত জোর করেই নন্দিনীকে পাহাড়ে নিয়ে এলো সঙ্গীতারা। আসার ইচ্ছে তো ছিল না ওর একদমই, শরীর সাথ দিলেও মনটা কোনোভাবেই সাথ দিচ্ছে না।

Read More »

Share with