||১||
“ওকে স্যার, আমি প্রসিড করে দিচ্ছি”, বলেই বসের কেবিন থেকে নিজের ডেস্কে যাচ্ছিল কৌশিক, ধাক্কা খেতে খেতে বাইচান্স বেঁচে গেল | ইনি নতুন জয়েন করেছেন, তবে আলাপ হয়নি, কৌশিক শুধু ‘সরি’ বলে নিজের ডেস্কের দিকে এগোল | মেয়েটি তখন বসের ঘরে ঢুকল | কাচের দরজাটা আস্তে আস্তে বন্ধ হচ্ছিল, কিন্তু তার ফাঁকেই কৌশিকের চোখে পড়ল মেয়েটার মুখটা…অসম্ভব শান্ত, ব্যস ঘষা কাছের দরজার আবরণে ঢাকা পরে গেল সে |
||২||
‘মৃণালিনী ঠাকুর’, নামটা শুনেই কিরকম একটা মান্ধাতার আমলের ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে | মেয়েটির চাল চলন পোশাক আশাকও তাই, শুধু চোখদুটো ভিতর অবধি পড়ে নিতে পারে | আজ অফিস ছুটির আগেই নতুন মেম্বার বলে কিছু ফর্মালিটিজ সারছিল কৌশিক, তখনই এটা মনে হলো ওর |
বাড়ি ফিরে খেয়ে দেয়ে রাত্রে যখন শুয়ে পড়ল তখনও ওই কথাটাই বার বার মাথায় আসছিল ওর | কি শান্ত গভীর দুটো চোখ, মুখে স্মিত হাসি, কিন্তু চোখ যেন অন্য কিছু বলে, যেন অদৃশ্য একটা আবরণ তৈরি করে রেখেছে নিজের চারপাশে, যা অভেদ্য | আজ ফর্মালিটিজের সময় কৌশিক দেখল ‘রিলেশনশিপ স্টেটাস-উইডো’ লিখল মেয়েটি | তাহলে কী এই বয়সে এত বড় একটা ধাক্কাই বয়সের তুলনায় বেশি অভিজ্ঞ করে তুলেছে…| অনেক আবোল তাবোল ভাবনার ভিড়ে কখন ঘুমিয়ে পড়ল কৌশিক নিজেও জানে না |
||৩||
(বেশ কিছুদিন পর)
এখন কিছুদিন যাবৎ মৃণালিনী খানিকটা সহজভাবে কথা বলে কৌশিকের সাথে, আর কারও সাথে তেমন ভাবে কথা বলে না ও | কৌশিকই যদিও বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছিল, তারপর ঐ টুকটাক কথা হয়, বেশির ভাগ সময়ই মৃণালিনী চুপই থাকে, ও শোনে, কৌশিকই বলে |
****************
এখন কেমন একটা বদ অভ্যাস হয়েছে কৌশিকের, ঐ মৃণালিনী ঠাকুরকে একবার না দেখলে কেমন যেন অস্বস্তি হয় ওর |
প্রেমে পড়ল কী ও? তাও এমন একটা মেয়ের? ধুর, তাও হয় নাকী, যত সব ভুলভাল |
****************
আজ মৃণালিনী আসেনি, আজই প্রথম এরকম হলো | কৌশিকের কীরকম অদ্ভুত একটা ফিলিং আসছে, ওর কী কিছু হলো? এত কেন ভাবে ও ওর জন্য | একজন বিধবা মেয়েকে মানবে না ওর বাড়িতে ও জানে খুব ভাল করে | তাও, কিছুতেই নিজেকে আটকে রাখতে পারে না, আটকাতে পারে না নিজেকে মৃণালিনীর ভাবনার জাল থেকে | অনেক ক্ষণ উসখুস করতে করতে ফোনটা করেই ফেলল |
-“হ্যালো, কী হলো আজ অফিস এলে না?”
-“হুম, শরীরটা খুব খারাপ আজ তাই পারলাম না আসতে, কেন বলো তো ?”
-“কেন মানে? একবার জানানোর প্রয়োজন বোধ করলে না?”
-“মানেটা কী? আমি আসতে তার নিশ্চই কোন সঙ্গত কারণ আছে, তার জন্য তোমায় জানাবো কেন? আমি পরে কথা বলছি “, বলে ফোনটা তখন কেটে দিল মৃণালিনী |
এত শান্ত মেয়েটার থেকে এরকম কোন উত্তর কৌশিক একদমই আশা করেনি | বড্ড অপমানিত, ছোট লাগছিল ওর নিজেকে, কেন এত ভাবছে ও বার বার মৃণালিনীকে নিয়ে? মৃণালিনীর দিক থেকে তো কিছুই নেই, তাহলে কৌশিকই কেন বার বার….| আর কিছু ভাবতে ইচ্ছা করছিলো না ওর, কাজে মন বসাতে চেষ্টা করল কৌশিক |
||৪||
রাত্রে এলোমেলো চিন্তার ভিড়ে মিশে ছিল কৌশিকের মনটা, হঠাৎ মৃণালিনীর একটা এসএমএস এলো | ও যা মেয়ে এত রাত্রে এসএমএস দেখেই অবাক হয়ে গেল কৌশিক, বেশি না, দু-চার লাইন তাতে লেখা-“আমার ব্যাপারে যত কম ভাববে, ততই তোমার পক্ষে মঙ্গল | আমি সবটাই বুঝি, আমায় নিয়ে বেশি না ভাবাই ভালো তোমার জন্য |”
এসএমএস টা দেখেই ধড়াস করে উঠে বসলো কৌশিক | সবই বুঝি মানে? ও কী বুঝে গেছে যে কৌশিকের মনে ওর জন্য একটা জায়গা তৈরি হয়েছে? কই কৌশিক নিজে তো কিছু বলেনি, তাহলে? ওর ব্যবহার, ওর চোখ, কথা না বলেও সবটা বুঝিয়ে দিয়েছে মৃণালিনীকে | মৃণালিনী কী তাহলে চায় না কৌশিককে? কিন্তু কেন? হ্যাঁ, কৌশিকের বাড়িতে অশান্তি হবে, ঝামেলা হবে, কিন্তু মৃণালিনী পাশে থাকলে ও ঠিক পারবে লড়তে | ভীষণ অশান্ত লাগছিল কৌশিকের নিজেকে, ওকে কথা বলতেই হবে |
||৫||
অফিসে কৌশিকের ডেস্কের উল্টো দিকেই মৃণালিনীর ডেস্ক | যেভাবেই হোক কৌশিক আজ ওর সাথে কথা বলবে, সবটা পরিষ্কার হওয়া খুব দরকার, এভাবে আর চলছে না |
টিফিন আওয়ার্স-এ মৃণালিনীর সাথে ক্যান্টিনে বসল কৌশিক |
“তুমি আমায় হঠাৎ করেই এড়িয়ে যাচ্ছ কেন মৃণালিনী? হঠাৎই কী হলো?”, কৌশিক সরাসরি প্রশ্নটা করল মৃণালিনীকে |
“আমি তোমায় এভয়েড করতে যাব কেন হঠাৎ? ওটা তোমার ভুল ধারণা | এসব কথা না বলে চুপ চাপ খাও |”, বলেই খাওয়ায় মন দিল মৃণালিনী |
মৃণালিনীর স্বচ্ছ চোখগুলো আজ যেন কত কিছু লোকাতে চাইছে, আপাত দৃষ্টির আড়ালে যেন চরম অশান্ত এক ঝড়, যাকে আস্টেপৃষ্টে মুখের নকল হাসির আবরণে ঢেকে দিতে চাইছে ও | চঞ্চল হাতের নড়াচড়ায় স্পষ্ট কিছু তো হয়েছে |
“কী হয়েছে বলো না আমায় |”, কৌশিকের চোখ বারবার মৃণালিনীকে বুঝিয়েই দিয়েছে মৃণালিনী ওর জন্য কী বা কতটা | সেটা মৃণালিনীও এখন বোঝে |
-“দেখ তুমি যা ভাবছ তোমায় আর আমায় নিয়ে তা হওয়ার নয়, তাই তুমি প্লিজ আমার থেকে দূরেই থাকো, প্লিজ |”
-“তুমি কী অন্য কাউকে…|”
-“সবসময় কী সব মেয়ের জীবনে একজন পুরুষকে থাকতেই হবে? এটা কী নিয়ম কোনো? একা থাকতে চাইতে পারে না কোন মেয়ে? আমার জীবনে কেউ নেই, কেউ থাকতেও পারে না, তাই প্লিজ এসব বন্ধ কর | এত কেয়ারিং ফোন, এসএমএস, ভালো লাগছে না আর এসব |” কথাগুলো ঝড়ের বেগে বলেই উঠে চলে গেল মৃণালিনী |
কৌশিক কিছুক্ষন হতভম্বের মতোই বসে রইল টেবিলে | এ-ই কী সেই শান্ত অদ্ভুত মেয়েটা, যে আজ এতগুলো কথা বলল? মৃণালিনীকে যত চিনছে তত যেন ওর এক একটা রূপ দেখছে, যেন এক একটা পর্যায়ে নাটকের এক একটা মোড় দেখাচ্ছে মৃণালিনী | হয়তো বা সে আসলে কেমন কৌশিক এখনো জানেই না, মৃণালিনী ঠিক যতটুকু জানাতে চেয়েছে নিজেকে কৌশিক ততটুকুই চিনেছে, তাই আজ এরকম ধাঁধা লাগছে হয়তো |
****************
সেদিন আর কোন কথাই হয়নি ওর মৃণালিনীর সাথে | কৌশিকেরও একটা আত্মসম্মান আছে, বারবার এভাবে… যাক গে যা | অফিসের পর আর কোন কথা না বলে কৌশিক বেরিয়ে গেল | বাস স্টপে একবার দেখল মৃণালিনীকে, আবারও শান্ত গভীর দুটো চোখ, কোন প্রসাধনের আতিশয্য নেই, তাও নিজস্বতায় বড্ড সুন্দর মুখখানি, নির্মল | চুপ চাপ একা দাঁড়িয়ে বাসের অপেক্ষায় | অন্যদিন ওরা একসাথেই ফেরে, আজ কৌশিক একটা ক্যাব নিয়ে নিল | খালি ক্যাবে ওঠার পর ব্যাক গ্লাসে দেখল মৃণালিনী কৌশিকের চলে যাওয়াটাই দেখছে | কৌশিক জোর করেই আর ফিরে তাকায়নি |
বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে নিজেকে বন্দি করে রেখেছিল কৌশিক, কটা বাজে কিছুই খেয়াল নেই, নিজের অজান্তেই চোখের কোণে জলও যেন নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে | কতক্ষন এভাবে কাটলো মনে নেই | হঠাৎ মুঠোফোনটা বাজল, স্ক্রিনে উঠল-“মন” | মৃণালিনীকে দেওয়া একান্ত গোপন একটি নাম, যা শুধু এই ফোনটা আর কৌশিকই জানে | সে আবার কেন ফোন করছে? ফোনটা ধরল কৌশিক |
-“হ্যালো |”
কিছুক্ষন চুপ থেকে কৌশিক বলল,”বলো |”
-“কাল তো রবিবার, একবার দেখা করতে পারবে? আমার কিছু বলার আছে |”
কিছুক্ষনের নিস্তব্ধতা, কৌশিকের জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিলো,’আবার কেন?’, পারল না, হয়তো চাইল না…|
||৬||
আজ কৌশিক আর মৃণালিনী মুখোমুখি একটা কফি শপে | খুব বেশি ফেমাস নয় কফি শপটা, নতুন খুলেছে তাই বিশাল কোন ভিড় নেই, তবে কফিশপটার পরিবেশটা মন মাতানো | শ্রাবন মাস, বাইরে বৃষ্টি নেমেছে বেশ জোরেই, কাচের জানলায় বারি কণা চুঁইয়ে পড়ছে, বাইরের বাহারে গাছের পাতাগুলো ঝোড়ো হাওয়ায় আর বৃষ্টিতে প্রবল ভাবে কাঁপছে, সাথে মেঘের গর্জন | কফিশপের আশপাশটা গাছ গাছালিতে বেশ সবুজ | বাইরের অঝোর ধারায় বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বসেছিল মৃণালিনী | কৌশিককে নিজের মনে জায়গা দিতে শুরু করেছে ও, একথা অস্বীকার করলে নিজেকেই মিথ্যা বলা হবে | হ্যাঁ, কৌশিককে হয়তো…., বাকিটা ভাবতে গিয়েও জোর করে ভাবনাটা মন থেকে সরিয়ে দিল | ও জানে কৌশিক ওকে ভুল বুঝছে, সে জন্যই আজ ওর সবটা বলতে এখানে ছুটে আসা |
অগোছালো ভাবে বাঁধা চুল, কানে হালকা ঝুমকো, চোখে যৎসামান্য কাজলেও অসামান্য লাগছিল মৃণালিনীকে, কপালে একটা কালো টিপ্ পরে সব সময় মৃণাল, টিপটা ঠিক করতে করতেই দেখল কৌশিক কাছের দরজা ঠেলে ঢুকছে, বাইরের ঝড় বৃষ্টিতে বেশ খানিকটা ভিজে গেছে | একটা যেমন অরেঞ্জ শার্ট পরে এসছে আজ কৌশিক, খুব অল্পক্ষনের জন্য হলেও মুগধ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল ও কৌশিকের দিকে | হঠাৎই বিদ্যুতের ঝলকানিতে চোখের সামনে অতিতের পাতাগুলো যেন জোর করেই হাজির হলো | সেদিনও তো এরকমই একটা শ্রাবনের দুপুর ছিল, এরকমই ঝোড়ো হাওয়া, মেঘের গর্জন, আসন্ন দুর্যোগের ইঙ্গিত নিয়ে…|
“বলো”, কৌশিক সামনের চেয়ারটায় বসে সোজাসুজি প্রশ্ন করল মৃণালকে | চোখের চশমাটা ভিজে যাওয়ায় ওটা খুলে মুছতে মুছতে আবারও বললো, ” কী হলো? আবার কী বলতে চাও, বলো?”
মৃণাল বলল, “আমি জানি, তুমি কী ভাবছো | এতো নাটক করছি কেন? তাই তো ? একবার বলছি সম্পর্ক রেখো না, আবার আমিই ডাকলাম |”
কৌশিক মুখে না বললেও চোখের ভাষায় বুঝিয়েই দিলো তুমি ডেকেছো এটা যথেষ্ট আমার এই দুর্যোগ মাথায় নিয়ে এখানে আসার জন্য | কেন কী বৃত্তান্ত এগুলো সত্যিই আমার কাছে ইম্পরট্যান্ট নয় |
মৃণাল আর কথা না বাড়িয়ে শুরু করল-“আমি সবটাই বুঝি, ইনফ্যাক্ট এটা যেকোন মেয়েই বোঝে, আমিও তার ব্যতিক্রম নই | আমি আজ তোমায় সবটা তাই বলতে চাই |” নিজের অগোছালো চুলগুলো কপালের উপর থেকে সরিয়ে চোখ রাখল ঝাপসা কাঁচটায়, বলতে লাগল অন্যমনস্ক ভাবে, “আমার বাড়ি বর্ধমানে, আমি কলকাতায় থেকে লেখা-পড়া করেছি, মাস্টার্স কমপ্লিট হতে না হতেই আমার গোঁড়া পরিবারের লোকজন আমার বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল | আমাদের বাড়ির লোকজন এখনও সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের, মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেওয়া উচিত, এটাই ছিল আমার ঠাকুমার বিধান, বাবা কাকারাও তেমনই ধারণা পোষন করত | আমার প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও আমার বিয়ে হয়েছিল এক সুপাত্রের সাথে, আই আইটি থেকে পাস করা ইঞ্জিনিয়ার, বাবার দারুন ব্যবসা, কেই বা না করবে | তাকে চেনবার আগেই বিয়ে হয়ে তার ভোগ পণ্য হয়ে গিয়েছিলাম মাত্র ২৩ বছর বয়সেই |”
কথার মাঝেই কফি শপের বয় অর্ডার নিতে এল | অর্ডার নিয়ে চলে যেতেই কৌশিক বলল,”তারপর?”
মৃণালিনী আবার শুরু করল,”সে কতটা সুপাত্র ছিল আমার প্রথম থেকেই তার আচার আচরণ, কথাবার্তা, চাল চলন কোন কিছুর সাথেই আমার খাপ খাচ্ছিল না | একমাত্র আমার বোঁটা আমায় বুঝতে, আর কেউ না, কেউ না | বাড়িতে বলেও কোন লাভ হয়নি |”
কথার মাঝেই অর্ডার দিয়ে গেল বেয়ারা | কৌশিক বলল,”কিন্তু তোমার স্বামীর কী দোষ ছিল যার জন্য তোমাদের মধ্যে সমস্যা হচ্ছিল?”
মৃণালিনী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,”বিয়ের পরই আবিষ্কার করেছিলাম, সে অন্য নারীতে আসক্ত, এবং সে একজন নয়, একাধিক | হয়তো বা সত্যিকারের প্রেম ভালবাসা হলে আমি তাদের মাঝখান থেকে সরেও আসতাম, কিন্তু কোন ভালবাসা নয়, শুধুমাত্র লালসা ছিল সেটা | একটা দুশ্চরিত্র, জানোয়ার, লম্পট | আমি ওর অফিসের অনেক ঘটনায় কানাঘুষো শুনেছিলাম | প্রথমে মিথ্যে ভাবলেও পরে আস্তে আস্তে বুঝতে পারছিলাম ওগুলো মিথ্যে নয় | আমি লুকিয়ে একটা চাকরির চেষ্টাও শুরু করে দিয়েছিলাম, যে আর এই জানোয়ারের সাথে পারছিলাম না থাকতে | কত মেয়ের সর্বনাশ ও করেছে নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে | প্রতি রাতে ধর্ষিত হতাম, পারছিলাম না আমি, সহ্যের বাঁধ ভাঙতে শুরু করেছিল | সেদিনও এরকম একটা শ্রাবনের দুপুর, প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি, আমি চাকরির খোঁজে বেরিয়েছিলাম | বৃষ্টিতে আটকে পড়েছিলাম, ভেবেছিলাম ফিরে যাব কিন্তু খুব ঝড় বৃষ্টি সেদিন | সেদিন বোনটা কলকাতা এসেছিল, ফিরতে পারেনি ও-ও সেদিন বর্ধমান, ফোনে জানায় আমার বাড়িতে থাকবে সেদিন | আমিও সেইমতো কেনা কাটা করে বাড়ি ফিরতে গিয়ে আটকে গেলাম, ওকে জানাতে ফোন করেছিলাম কিন্তু ফোনে তখন নেটওয়ার্কও নেই | বৃষ্টিটা একটু থামলে তাড়াতাড়ি পা চালাই বাড়ির পথে | ফ্ল্যাটের দরজার সামনে পৌঁছে চাবি ঘুরিয়ে খুলতে খুলতেই একটা আর্তনাদ কানে এসেছিল, গলাটা আমার বোনের ছিল | এক সেকেন্ডের জন্য সমস্ত খারাপ চিন্তাগুলো একসাথে মাথায় ভিড় করে এসেছিল, লক ঘুরিয়ে দরজা খোলা সেটাও যেন দীর্ঘ সময় মনে হচ্ছিল | দরজা খুলে ঘরে ঢুকতেই দেখি ফ্ল্যাট সম্পূর্ণ এলোমেলো |
প্রচন্ড জোরে বাজ পড়ছে, বাইরের মানুষের কানে কিছু পৌঁছানো সম্ভবও না | দরজার ফাঁকের হালকা আলোতেও বুঝলাম, কিছু একটা ঘটছে, বা ঘটেছে | মাথা কাজ করছিল না, দৌড়ে ভিতরে ঢুকি, আমার শোবার ঘর থেকে আর্তনাদটা আসছে, দরজা ভিতর থেকে লক, নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা মেরেছিলাম দরজায় | জানি না তখন এত শক্তি কীভাবে এসেছিল আমার, আমার বোনটাকে বাঁচাতে হবে এটাই মাথায় ঘুরছিল | দরজা ভেঙে দেখি জানোয়ার লম্পটটা সেদিন উন্মত্ত অবস্থায় অসুরের শক্তি নিয়ে চড়াও হয়েছিল আমার বোনের উপর | আদালত, পুলিশ, সমাজ প্রত্যেকে জানে সেদিন আমার বোন ঐ পদক্ষেপটা নিতে বাধ্য হয়েছিল | আমার লম্পট স্বামীকে আত্মরক্ষার স্বার্থে খুন করতে না চাইলেও নিজে বাঁচার জন্য খুন করে ফেলেছিল ও …| কিন্তু আসলটা জানে শুধু আমি আর বোন… হাতের কাছে পিতলের ভারী ফুলদানিটা ছিল, সর্বশক্তি দিয়ে ওর মাথায় সেদিন…|”
কড় কড় করে বাজ পড়ল বাইরে, মৃণালিনীর চোখ দুটো বিদ্যুতের ঝলকানিতে দেখল কৌশিক | এ কে? একে তো কোনোদিন দেখতে পায়নি কৌশিক, আগুন জ্বলছে চোখ দুটোয়, কী ভীষণ তেজ সেই আগুনে… |
“আমার বৈধব্য আমার নিজে হাতে তৈরি, আর তাতে আমার আজও কোন দুঃখ নেই |”, থামল মৃণালিনী, মাথাটা অল্প নীচু, যেন বড্ড ক্লান্ত | আজ এতগুলো কথা কাউকে বলে হালকা হলো যেন, জোরে জোরে শ্বাস পড়ছে |
কৌশিকের চোখ বিস্ফারিত, কিছু বলার ভাষা নেই আর ওর, বেশ কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা |
সারাটা রাস্তা আসতে আসতেও যেন ঘোর কাটছে না কৌশিকের, এরকম কিছু স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি ও | যাওয়ার আগে মৃণাল একটা কথাই বলে গেল,”এবার সব শুনে বুঝে যদি ভালোবাসার ক্ষমতা থাকে, তবেই কাছে এস, নয়তো প্লিজ আর কোন ভাবেই আমার সাথে সম্পর্ক রেখো না, ভাল থাকো |” লক্ষী প্রতিমার মতো মুখখানি, কিন্তু স্বচ্ছ চোখে আজ মায়াময় গভীরতা ছিল না, ছিল আগুন, আর সেই আগুনের আঁচে যেন একটু একটু করে গেলে চলেছে কৌশিক | মা লক্ষী নয়, মা কালী, আর এই একেক রূপেই বারবার মোহিত হচ্ছে যেন কৌশিক | এত নির্ভিক, এত দৃঢ় মনের একজন মানুষ, যে অন্যায়ের সাথে কখনো আপোষ করবে না |
***************
(কিছুদিন পর)
“বিয়ে, দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক এগুলো আমার হাতে নেই, কিন্তু তোমায় ভালবাসাটা এই মুহূর্তে সম্পূর্ণভাবে আমার হাতে আছে, এবার কী একটু এই অধমের জায়গা হবে আপনার মনে?” কৌশিকের কথা শুনে হেসে ফেলল মৃণালিনী, সে হাসি নকল নয়, সে হাসি মুক্তোর মতোই সুন্দর | ওদের নতুন এক শুরুর সাক্ষী রইল সেদিনকার পড়ন্ত সোনালী বিকেলটা |