তুমি আসবে বলে

 ||১||

তুমি আসবে-এ-এ বলে -এ-এ …..

উফ্ফ! কি অসাধারণ গানটা | একসময় এই গানটার শব্দগুলো শুনলেই ঝুম -এর মনটায় যেন হাজারটা প্রজাপতি একসাথে উড়তো | কিন্তু আজ…… গানটা আগের মতোই সুন্দর, কিন্তু ঝুম এর মনে আর কোনো প্রজাপতি ওড়ে না | কিন্তু বছর খানেক আগেও গল্পটা অন্যই ছিল, আর পরিণতি ঘটার কথাও ছিল অন্য কিছু…… কিন্তু, ভাগ্যের পরিহাসে ঘটল কিছু অন্যই |

শূন্য আকাশের দিকে চেয়ে আজও এগুলোই ভাবে ঝুম | এক নামজাদা কোম্পানিতে কর্মরত সে | সবই ঠিক ছিল | কিন্তু অভি এভাবে এক করে দিয়ে চলে যাবে, এতো ঝুম কল্পনাও করেনি |

ঝুমকে অভির বাড়ির লোকের কোনো অজানা কারণেই হয়তো ঠিক পছন্দ হয়নি | টালবাহানা চলতে চলতে একসময় ভেঙেই গেলো | এতদূর অব্দিও ঠিকই ছিল, কিন্তু অভিও যেদিন বাড়ির লোক গুলোকেই সমর্থন করলো – ঝুম ঘরোয়া নয়, ও বিয়ে করে নাকি সুখী করতে পারবে না, ‘ম্যারেজ মেটেরিয়াল’ নয় | এগুলো অভির মুখ থেকে শোনার পর দাঁড়ায়নি ঝুম |

নিজের মনের মধ্যেই ভালোবাসাটাকে চাপা দিয়েছিলো, অন্ধকারে | কিন্তু মারতে পারেনি | তাই আজও ও কাউকে মানতে পারেনি অভির জায়গায় | কিন্তু, এবার সবটা ওর হাতের বাইরেই চলে গেছে, আর কতদিন সে মা বাবা কে অজুহাত দেবে বিয়ে না করার? আর কোন মুখেই বা দেবে? আর অভিকে তো মা বাবা মেনেই নিয়েছিল | আর আজ যখন সে তার হাত ছেড়ে চলে গেছে, তখন তো আর কিছু বলারও মুখ নেই |

তাই আজ অজস্র টালবাহানার পার মা বাবাকে সম্মতি দিতেই হলো, এই সম্বন্ধ টা পাকা করতে | নাহ, প্রায় ১৫ – ২০ টা সম্বন্ধ সে ভেঙেছে, নানাভাবে, আর তার কোনো কথাই ধোপে টিকলো না |

||২||

মা আজ সকাল থেকে মাথা খারাপ করে দিচ্ছে | পাত্র পক্ষের বাড়ি আজ যাওয়ার কথা | কে পাত্র, কী বৃত্তান্ত কিছুই জানে না ঝুম | জানার ইচ্ছাও নেই | মা বাবাকে শান্ত করতে সে সম্মতিও জানিয়ে দিয়েছে পাত্রকে না দেখেই | কি-ই বা হবে দেখে? মন থেকে যখন সায় নেই, তখন সৌন্দর্যে কী-ই বা যায় আসে?

না, পাত্র পক্ষের সামনে শো-পিস্ সেজে বসেনি ঝুম, আর বসবেও না | ওর ছবি দেখেই পাত্র পক্ষ এক কথায় হ্যাঁ বলে দিয়েছে | ঝুম তো দেখতে সত্যিই সুন্দরী | পছন্দ হবে না-ই বা কেন | ঝুমের চাকরি নিয়েও কোনো অসুবিধা নেই পাত্র পক্ষের | ব্যস, মা বাবা আর এমন ভদ্র, সভ্য, মার্জিত, পরিবার কে না করেননি | এখনকার যুগে বিয়ের আগে নিজের হবু বরকে একবার দেখা তো দূর, একটা কথা অবধি বললো না | এও সম্ভব? পাত্রও চায়নি কথা বলতে |

বন্ধুরা অনেক বার বললেও ঝুমের আর সত্যিই আলাপের ইচ্ছে হয়নি, তার হ্যাঁ বা না-এ কিছু তো যায় আসে না এখন, এর থেকে মা বাবাকে ভরসা করে শ্রেয় |

খটকা যে লাগেনি তা নয়, কিন্তু ভাবলো পাত্র-র ও হয়তো ওর মতোই কোনো কেস, ভালোই হবে | আর ভাবতে পারছে না |

 ****************

আজ ঝুমের বিয়ে | সবাই কত খুশি শুধু ঝুম ছাড়া | আজ সে চিরদিনের জন্য এমন একজনের হাত ধরতে চলেছে যাকে সে দেখেই নি | চেনে না, জানে না, ঠাকুমা দিদির মতোই ঝুমও আজ নিজের জীবন টা ভাগ্যের ওপরই ছেড়ে দিয়েছে | চারপাশের এতো কোলাহল, আনন্দ, আলো, সানাই, এই সব কিছুর মাঝে চারপাশটা নিস্তব্ধ গতিহীন যন্ত্রের মতো চলছে তার শরীরটা | মাসির ডাকে টনক নড়লো | গায়ে হলুদের তত্ব এসেছে, ডাকছে | ভালো, এসেছে তো এসেছে | বিয়ের সব অনুষ্ঠান এক এক করে চললো , আর ঝুমের মধ্যে অস্বস্তি বাড়তে লাগলো | কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি, এরকম তো হয়নি কখনো |

সন্ধে ঘনিয়েছে, সানাই- আলো মিলিয়ে এক মোহময় পরিবেশ | মাসি জেঠীরা তো বলেই চলেছে – “খুব সুন্দর লাগছে আজ ঝুমকে | বর এর মাথা নাকি ঘুরে যাবে |” ঝুম এর এসব ইয়ার্কি আর এখন ভালো লাগে না |

“বর এসেছে, বর এসেছে…” হঠাৎ কোলাহল | বুক ধড়পড় করতে লাগলো ঝুমের | কিরকম অদ্ভুত চাপা উত্তেজনা হচ্ছে | ওর এরকম তো হওয়ার কথা নয় | ও তো বিয়ে টা করতে হবে বলে করছে | বর এসেছে সে কেমন হবে, এসব ভেবে তো লাভ নেই | বিয়েটা তো করতেই হবে | তাও যেন সব কিরকম তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে | অসম্ভব টেনশন হচ্ছে অজানা অচেনা মানুষটা আর তাকে ঘিরে অনিশ্চিত ভবিষৎ টা নিয়ে |

শুভ দৃষ্টির সময় উপস্থিত | এবার ঝুম সেই অপরিচিত অজানা মানুষটাকে দেখতে চলেছে যার সাথে সে সারাজীবন কাটাবে | পান পাতা সরিয়ে ধীরে ধীরে তাকালো ঝুম | প্রথমে চোখে চোখ, চোখ টা বড়ো চেনা চেনা না? পান পাতা সরিয়ে দেখলো ঝুম, একী?

এটা কি করে হতে পারে? চারপাশটা অন্ধকার হয়ে এলো ঝুমের, জ্ঞান হারালো ঝুম |

 ||৩||

ঝুম আর অভির সেই কলেজ থেকে প্রেমের শুরু | সবার চোখে একেবারে পারফেক্ট কাপেল | এই কাপেলকে ঘিরে বহুজনের বহু হিংসে রয়েছে | ঝুম অভির প্রেমে অন্ধ হয়ে বহুজনকে না বলেছে | সে হতেই পারে,সব প্রেমেই হয় | কিন্তু দেবদা মানে দেবাশীষ চৌধুরী, সব জেনে শুনেও বার বার ঝুমকে তার নিঃস্বার্থ ভালোবাসার কথা জানিয়েছে | দেবদা ওদের ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র ছিল ২বছরের | ঝুম “না” বলতে দুবার ভাবেনি, কিন্তু এতবার এতভাবে না বলেছে, যে ঝুমের নিজের ব্যবহারের জন্য খারাপই লাগছিলো | ও জানে দেবদা সৎ কিন্তু অভি ওর প্রাণ | তাই সে যেমনই হোক হ্যাঁ বলার প্রশ্নই ওঠে না |

শেষ বার দেবদার সাথে ব্যবহারটা খুবই খারাপ হয়ে গেছে, ঝুম বুঝেছে সেটা | ওর নিজেরই এতো খারাপ লাগছে | যে ন্যূনতম কথা টুকু হতো সৌজন্য বিনিময়ের জন্য সেটুকুও বন্ধ করে দিয়েছে ঝুম, এতেই ভালো হবে |

 ||8||

অনেকবার ডাকাডাকির পার অবশেষে ঝুমের জ্ঞান ফিরেছে | সারাদিন না খেয়ে, দুশ্চিন্তায় মনে হয় black out হয়ে গেছলো | শরীরটা যেন চলছেই না |

একটু ধাতস্থ হতে ও আবার উঠে বসলো | কতক্ষন অজ্ঞান হয়েছিল কে জানে? কী যে হচ্ছে কে জানে ওর সাথে | মাথাটা ঝিম-ঝিম করছে | কিন্তু ভাবার মতো অবস্থাতেও নেই আর ও | বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হলো | ঝুম যে তখন কিসব দেখলো কে জানে | কোনোরকম বিয়ের অনুষ্ঠানটা মিটলে বাঁচি, এটাই ভাবছে ঝুম |

মালাবদল করতে গিয়ে আবার তাকিয়েছে ঝুম | না, আর তো ভুল হতে পারেনা | এটা কী করে হতে পারে? ও তার মানে ভুল দেখেনি – সামনে বরের আসনে বহুপরিচিত দেবদা | আজ এতো বছর পর দেবদা …. কী করে হতে পারে? সবথেকে বড়ো কথা দেবদার সাথে ও থাকতে পারবে না | এটা অসম্ভব | আর কেউ হলে ঠিক ছিল, দেবদাকে জাস্ট অসম্ভব | কী করবে এখন? চিৎকার করে বিয়ে বন্ধ করে দেবে? অভির জন্যই দেবদার মুখের ওপর না বলেছিলো ঝুম, আজ ওর মান সম্মান সব ধুলোয় মিশল | কেন বিয়ের আগে একবার ছবিটা দেখলো না | ও আর কখনো তাকাতে পারবে দেবদার দিকে? দেবদাই বা কী? আর মাথা কাজ করছে না |

এতো কিছু ভাবতে ভাবতে কখন সিঁদুর দান এর সময় উপস্থিত ও খেয়ালই করেনি | না, এটা হতে পারেনা | সমস্ত অনুভূতিগুলো গলায় দলা পাকিয়ে দম বন্ধ হয়ে আসছে | কাঁদতে ইচ্ছে করছে চিৎকার করে, ও যে আর মুখ দেখাতে পারবে না নিজের কাছে, দেবদার কাছেও | সিঁদুর দানটাও হয়ে গেলো |

হেরে গেলো আজ ঝুম, ডাহা হেরে গেলো | নিজের চোখে চোখ রাখার জায়গাটাও আর নেই ঝুমের |

 ||৫||

শ্বশুরবাড়ি আসার পর থেকে দেবদাকে একবারও ধারে কাছে দেখেনি ঝুম | কোনোরকম ভনিতা, অভদ্রতা এখনো অবধি করেনি | বৌভাতও হয়ে গেলো | ফুলশয্যার কথা ভাবতেই অসহ্য লাগতে লাগলো ঝুমের,শ্বশুরবাড়ির ননদ, জা, এদের সবার ঠাট্টা ইয়ার্কি আর কানে পৌঁছছে না ঝুমের | ওকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে সবাই চলে গেলো | কিছুক্ষন পর দেবদাও এলো | দরজা টা দিতেই ঝুমের বুকটা ধড়পড়িয়ে উঠলো | এবার কি সেই একই ঘটনার স্বীকার হবে ও যা আর পাঁচটা মেয়ে প্রতিনিয়ত ঘরে ঘরে হচ্ছে | প্রতিদিন ম্যারিটাল রেপ এর স্বীকার হচ্ছে অসংখ্য মেয়ে | ওর কপালেও কি এই লেখা ছিল? হে ভগবান !

এসব ভাবতে ভাবতেই দেবদা বলে উঠলো “তুই খাটে শুয়ে পড়, আমি সোফায় ম্যানেজ করে নেব |” ঘি তে আগুন পড়াটাই বাকি ছিল , সাথে সাথে বিস্ফোরণ হওয়ারই ছিল |

” তুমি তো সবটাই জানতে তাই না দেবদা? ” ঝুম |

“মানে?”- দেবদা |

“মানে তুমি জেনে শুনেই এটা করলে | তুমি কি আমার ওপর প্রতিশোধ নিতে চাইছিলে? খুব দরকার ছিল কি এতো বড় নাটকটার?”

” তুই ও কি বিয়েতে সম্মতি দিস নি? তোকে তো জোর করে নিয়ে আসিনি |”

” আমি বিয়ের আগে তোমার ফটো আদৌ দেখিনি, দেখলে কখনো এই বিয়েতে মত্ দিতাম না|”

” এটাও কি আমার দোষ?”

” তুমি তো এটাই চেয়েছিলে, যাতে আমি তোমার সামনে নত হই, আর তুমি তোমার বীরত্ব দেখাতে পারো, তুমি কত মহান, সেটা দেখাতে পারো, সেটা প্রমান করতে পারো |”

কিছুক্ষন নিস্তব্ধতার পর দেব বললো -” তুই আমায় ভুল বুঝছিস এবারে | আজ অনেক ধকল গেছে, শুয়ে পড় |” এই বলে নির্বিঘ্নে শুয়ে পড়লো ও ঘুমিয়েও পড়লো |

ঝুম ফুলশয্যার খাটে অন্ধকারে একা বসে রইলো, খুব কান্না পাচ্ছে ওর, এগুলো কি হচ্ছে ওর সাথে | কি পাপ করেছিল যে আজ ওকে দেবদার কাছে এভাবে অপমানিত হতে হচ্ছে |

কখন ঘুমিয়ে গেছে কে জানে? ভোরের নির্মল আলো চোখে পড়তেই ঘুম ভাঙলো, দেখলো ঘরে দেবদা নেই ও একাই | উঠে স্নান সেরে নীচে নামলো | শ্বশুরবাড়ির বাকি প্রত্যেকটা সদস্য খুবই ভালো, মিশুকে | কিছুদিনেই ওদের সবার সাথে মিশে গেলো ঝুম | এছাড়া, অফিসেও কাজ আছে | সব মিলিয়ে বেশ ব্যস্ত |

ওর কাকাই মানে খুড়শ্বশুর বিয়ে তে আসতে পারেননি, নিজের কাজে বাইরে ব্যস্ত ছিলেন | ফিরে এসেছেন ৩মাস হলো | একদিন ব্রেকফাস্ট টেবিল-এ বোমাটা ফাটালেন | দেবের বিয়েতে তো থাকতে পারেননি অনেকটা তার কম্পেনসেশন হিসেবেই ওদের হানিমুন ট্রিপটা উনি স্পনসর করছেন, গ্যাংটক | সবাই তো খুব খুশি, ঝুম এতো অপ্রস্তুতে বোধহয় কখনো পড়েনি | ও দেবদার দিকে একবার তাকালো, দেবদা চোখ টা নামিয়ে নিলো, কিছুই বললো না | ও আগ বাড়িয়ে কি করে বারণ করবে? এছাড়া দেবদার তার মানে মত্ আছে | ছিঃ ছিঃ নীচ এতটা দেবদা? ঝুম উঠে চলে গেলো |

রাত্রে ডিনার এর পর দেবদা ঘরে আসতেই ঝুম বললো, “তার মানে তুমি চাও এই ট্রিপ টায় যেতে?”

দেব,” আমি তো কিছুই বললাম না এখনো, তুই ই ভেবে নিস্ “|

ঝুম, “যখন বলোনি বলতেও হবে না আর”|

দেবদা,”বেশ অগত্যা | আর একটা কথা প্লিজ রাখিস, আমাদের ঘরে মধ্যকার এই সমঝোতাটা যেন বাইরে কেউ বুঝতে না পারে, নয়তো সবাই খুব কষ্ট পাবে | এই টুকু একটু দেখিস | বাইরে তুই আমার বৌ হয়েই থাকিস সবার কাছে |” এই বলে শুয়ে পড়লো সোফায় |

আজ দেবদার মুখে বৌ শুনে একটা অন্যরকম অনুভূতি হলো ঝুমের | বলা যেতে পারে শুনতে খারাপ লাগলো না কথাটা | ধুর কি সব ভাবছে , আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লো ঝুম বিছানায় | কিছুক্ষন আবোল তাবোল ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়েও পড়লো |

 ||৬||

গ্যাংটকে পৌঁছেছে ওরা দুজন এই বেলা ১০টা নাগাদ | সব আগে থেকে বুক করাই ছিল | হোটেলে এসে ওরা ফ্রেশ হয়ে নিলো | খুব টায়ার্ড, খেয়েদেয়ে জিরোতেই হবে একটু | এখানে এসে মনটা বেশ ভালো লাগছে ঝুমের | দুপুরে হোটেলেই খেয়ে শুয়ে পড়লো একটু |

ওদের ঘরের সোফার মতো নয় এই ঘরের সোফাটা, রট আয়রনের আর একটু ছোট,দেবদার শুতে খুব প্রব্লেম হচ্ছে দেখলো সেটা ঝুম | খারাপ লাগছিলো একটু, বলতে গেলো | তারপর ভাবলো, কি না কি ভেবে নেবে, থাক দরকার নেই | শুয়ে পড়লো |

প্রায় বিকেল হয়ে গেছে, ঘুম ভাঙলো ঝুমের | ঘরে দেবদা নেই, বাথরুম বারান্দা সব দেখলো | কোথায় গেলো কে জানে | ঘরে দেবদা নেই | বাথরুম, বারান্দা সব দেখলো | কোথায় গেলো কে জানে ? গেছে হয়তো আশেপাশে | সন্ধে ঘনাতে লাগলো, এবার ওর একটু চিন্তা হচ্ছে বৈকি | ফোন করে দেখবে একবার? কি ভাববে? যা ভেবে ভাবুক চিন্তা থেকে তো মুক্তি | ফোন আনরিচেবল |নীচে রিসেপশনে নামলো ঝুম | রিসেপশনে বললো দুপুরেই বেরিয়েছেন উনি | উফফ! কি করছে কোথায় গেছে এতক্ষন? এবার বেরিয়ে দেখবে নাকি ? এতো আচ্ছা মুশকিল হলো | হোটেলটার চারপাশটা জুড়ে খুব সুন্দর একটা বাগান আছে | ছোটদের খেলার জায়গা, বড়দের আড্ডার জায়গা সব আছে | ঝুমের বেরিয়েই মনে হলো দেবদার গলার আওয়াজ পেলো | দেখলো বাগানের আর একটি ফ্যামিলির সাথেই দিব্যি আড্ডা দিচ্ছেন বাবু | আর এদিকে ঝুম অযথা টেনশন করছিলো | মানুষ তো বলে যায় |

দেব এর দিকে ঝুম এমন ভেবে তাকালো, যদি কলিযুগ না হতো, এখানেই ভস্ম হয়ে যেত দেব | হনহন করে ঘরে ফিরে এলো ঝুম | সব কিছুর লিমিট আছে একটা, এভাবে নতুন জায়গায় কেউ না বলে কয়ে চলে যায়, কমন সেন্স ও কি নেই কোনো?

দেবদা তারও কিছুক্ষন পার ঘরে ফিরলো | ঝুম ফেটে পড়লো, “সব কিছুর সীমা আছে একটা | তুমি আমায় কিছু না জানিয়ে এভাবে চলে যাবে? কোনো বুদ্ধি নেই মাথায়?”

দেব-” তুই তো ঘুমোচ্ছিলি, আমি শুতে পারলাম না, তাই ক্যামেরা নিয়ে ফটো তুলতে বেরিয়েছিলাম, তার পর ফিরে হোটেলটার বাগানে বসলাম | আড্ডা দিতে দিতে সময়টার খেয়াল করিনি | আর তুই হঠাৎ বরের খোঁজ করবি আমি বুঝতে পারিনি | “

ঝুম আর কিছু বললো না | বরের খোঁজ আদৌ নয়, একটা যে কোনো মানুষ এরকম করলে চিন্তা হবে, বর বলে আলাদা কিছু নয় | বলতে গেলেও আর এটা বলতে পারলো না ঝুম, বা বলতে চাইল না |

সেদিন আর ঘোরাঘুরি হলো না | একেই তো মাথা গরম | খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়লো | কিন্তু শুতে গিয়েও সেই একই প্রব্লেম, সোফা | রট আয়রনের তাই পায়েও লাগছে, আর খুব বেশি লম্বাও নয় |

ঝুম বলেই ফেললো, “তুমি খাটে শুয়ে পড় দেবদা, আজ আমি সোফায় শুচ্ছি |”

” না না ঠিক আছে, তুই কেন সোফায় শুবি, আমি ম্যানেজ করে নেবো |”

“৩ মাস ধরে তো তুমিই শুচ্ছ  সোফায়, একদিন আমি শুলে কিছু হবে না, তুমি খাটে এস |”

“শুতে পারবি না এতে, কম্ফোর্টেবল নয় এটা |”

“ঠিক আছে,খাটেই শোব, খাটটা তো বড়, তুমি চলে এস |”

এটা বলতেই দেবদা খানিক্ষন হাঁ করে তাকিয়ে তারপর খাটে এসে এক কোন শুয়ে পড়লো | ঝুমও আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লো | শুয়ে শুয়ে ভাবলো, ইস কি বললো ঝুম? নিজেই কিনা লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে খাটে শুতে বললো? কিন্তু আর কিই বা বলতো? এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়লো |

৬ দিন পর গ্যাংটকে ট্রিপ সেরে ওরা ফিরলো | সবার জন্য অনেক গিফটও এনেছে | সবাই খুব খুশি, একটু একটু ঝুমও | ওদের মধ্যে গুমোট ভাবটা যেন অনেকটা কম | দেবদা কোনোদিনও জোর করে স্বামীর অধিকার ফলাতে আসেনি, ওর এই সততাই ওর শ্রেষ্ঠ সম্পদ |

 ||৭||

প্রায় ৮মাস হয়ে গেলো | একটু একটু করে এবাড়ির সকালেই ঝুম এর আপন হয়ে উঠেছে | সবাইকে নিয়ে ঝুম খুব একটা খারাপ নেই | আজ দেবদার জন্মদিন, ঝুম জানতো-ই না | দেবদাও আগ বাড়িয়ে বলেনি, ওর মিষ্টি ননদটা এসে বললো |

ঝুম তো প্রথমে অপ্রস্তুত-ই হয়ে গেছল বলতে গেলে | ও উইশ ও করেনি দেবদাকে | দেব দার মা বললেন ঝুম যেন আজ দেবের পছন্দের কিছু একটা বানায় | কি আর বলবে ও, অগত্যা রাজি হলো | ছুটি ও নিলো অফিস থেকে | ঝুম তো সেভাবে জানেও না, দেবদার কি প্রিয়? দেবদা অফিস বেরিয়ে গেলো, কিভাবে জানবে?

হঠাৎ খেয়াল এলো, গ্যাংটকে বেড়াতে গিয়ে ঝুম দেখেছিলো দেবদা খুব মিষ্টি পছন্দ করে | মানে ওতে কখনো না বলে না | ওটাই তবে সেফ সাইড, মিষ্টি ই বানাবে | অনেক ভেবে ঠিক করলো, ছানার পায়েস করবে |

প্ল্যান মতো তাই সব চলছে | বার্থডে সেলিব্রেশন নিয়ে মেতে আছে সব | শুধু, ঝুম নিজের মতোই আছে | সবাই মাইল surprise দেবে ঠিক করেছে |

সন্ধে নেমে গেলো দেবদার কোনো পাত্তাই নেই | এতো সেলিব্রেশন এ ঝুম আর আগের মতো বিরক্ত হয় না, খারাপ লাগছে না এসব | সবাই বললো ওকে ফোন করতে | ও একটু hesitate করছিলো | ও দেবদাকে ফোন করেনি বলতে গেলে কখনো, খুব প্রয়োজন না পড়লে |

ফোন সুইচ অফ বলছে | হয়তো চার্জ নেই |

সন্ধে ৭ টা বেজে গেলো | এতো দেরি তো হয় না | অফিসে কি কোনো পার্টি আছে? বার্থডে এর জন্য |

সন্ধে ৭.৩০ টা বেজে গেলো | এবার সত্যিই চিন্তা হচ্ছে | ঝুম এর হঠাৎ টেনশন কেন হচ্ছে সে নিজেও জানে না, কিন্তু হচ্ছে |

এই কয় মাসে ওর নিজের মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে, সেটা ও নিজেও feel করে | দেবদার জন্য ভাবে এখন | তবে কি ও দেবদার প্রেমে পড়লো? ধুর, না না | কিন্তু ঘড়ির কাঁটা তো পেরিয়েই যাচ্ছে, ৮টা বেজে গেলো | হঠাৎ ড্রয়িং রুম থেকে চিৎকার ভেসে এলো, ওর শাশুড়ির | ঝুম ছুটে গেলো | কি হলো?

নিউজ ই দেখাচ্ছে, দেবদার অফিস বিল্ডিং এ ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ঘটেছে | অনেক লোক আটকে আছে | মানুষের বাঁচার আশা খুব কম, এতটাই ভয়াবহতা সেই অগ্নির |

ঝুম এর সামনে সবকিছু কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেলো | এ হতে পারে না | সবটাই সাদাকালো লাগছে চারপাশটা, ভগবান বার বার ওর থেকে ওর ভালোবাসাকে কেড়ে নিতে পারে না | হ্যাঁ, এই মুহূর্তে এটাই মনে ঝুমের | ওর দেবদাকে ছাড়া বাঁচবে না ও | যে মানুষটাকে এতো অপমান করেছে ও, এতো অবহেলা করেছে | আজ তার জন্যই ওর চোখ থেকে অঝোর জল পড়ছে |

ও যেভাবে হোক ওখানে যাবে, ফিরিয়ে আনবে ওর স্বামীকে | ঝুম কে আটকে রাখাই মুশকিল হয়ে গেছে | এরকম রুদ্র মূর্তি! এরকম শান্ত মেয়েটারএই রুপ ভাবাই যাচ্ছে না | ওদিকে শাশুড়ি মা জ্ঞান হারিয়েছেন | বাড়িতে যা-তা অবস্থা, কে কাকে সামলাবে? ঝুম তো দেবদার কলিগ দের নম্বর ও জানে না | এবার কি করবে? কোথায় খুঁজবে ওর দেবকে?

এদিকে, প্রায় ৯টা | দরজায় বেল বাজলো | নন্দিনী দরজা খুলতেই দেখে দেব হাসি হাসি মুখে হাজির |

আর বোলো না বন্ধুরা খুব করে ধরলো আজ treat চাই, জোর করে নিয়ে গেলো পার্ক স্ট্রিটে | সে খেয়ে দেয়ে যতটা সম্ভব দ্রুত চাপলাম বাসে | ওই জন্য এতো দেরি হলো | সে কি জ্যাম | ফোন করে জানাতে গেলাম, দেখলাম ফোন অফ হয়ে গেছে চার্জ আউট হয়ে | শাশুড়ি মা তখন ছেলেকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা | প্রাণ ফিরে পেয়েছেন বুকে |

শুধু ঝুম এক কোনে দাঁড়িয়ে ছিল | এ কি মানুষ? সেলিব্রেট করছে, আর এই কঘন্টায় ও তো মরেই গেছল, দুঃস্বপ্নের মতো কেটেছে এই কয়েক দণ্ড | ছুটে চলে গেলো ঝুম ওপরের ঘরে | দেবদা ঘরে যেতেই ফেটে পড়লো- “তুমি কি মানুষ? মানুষের টেনশন হয় বোঝো না তুমি?”

আমার ভুল হয়ে গেছে রে | বললাম তো সবটা, আর উপায় ও তো ছিল না, আর এরকম কান্ড ঘটেছে আমি জানতাম না, যেই জেনেছি গেছলাম কল করতে বাড়িতে, তার ওপর জ্যাম …..|

কথা শেষ হলো না, ঝুম উঠে দাঁড়ালো, দেব এর কাছে এলো, চোখে জল আর অনেক অভিমান |

“আমি এই কিছুক্ষন এর মধ্যে যে মরে গেছিলাম চিন্তায় সেটা একবারও বুঝলে না? এই তুমি ভালোবাসো

আমায়? সব কি তোমায় বলে বোঝাতে হবে? ভলোবাসি তোমায়, কখন বেসেছি নিজেও বুঝতে পারিনি”|

দেব দুহাত দিয়ে ঝুমের চোখের জল মুছিয়ে দিলো, দুহাত দিয়ে ঝুমের মুখটা ধরে বললো, ” আমি যে এই দিনটার অপেক্ষা তেই ছিলাম, আমি যদি আজ মরেও যেতাম…..” ঝুম দেবের মুখটা চেপে বললো ” আমার ভালোবাসাকে আমার থেকে আর কেউ কেড়ে নিতে পারবে না, তুমি আসবে বলেই আজ আমি বেঁচে আছি |

ঝুম আর দেবের ঠোঁট দুটো আবদ্ধ হলো নিবিড় চুম্বনে, আবেশে নিমগ্ন হলো দুটি শরীর, দেবের বুকে মাথা রাখলো ঝুম | 

বার্থডে কেক কাটার সময় নন্দিনী বললো ,” দাদা তোর বিয়ের পর প্রথম বার্থডে, বৌদি কি গিফট দিলো?

দেব ঝুম এর দিকে তাকিয়ে – “আমি আমার লাইফ এর সবথেকে দামি গিফ্ট টা আজই পেয়েছি”| ঝুম লজ্জায় রাঙা হয়ে চোখ নামিয়ে নিলো |

 

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

চল রাস্তায় সাজি ট্রাম লাইন

।।১।। উফফ, আমার কানের নীল ঝুমকোটা কোথায় রাখলে মা, খুঁজেই পাচ্ছি না, দেরী হয়ে যাচ্ছে তো।”- তাড়াহুড়োয় মা কে হাঁক দিলাম, ওদিকে লিপস্টিকের শেড আর

Read More »

বেনামী (শেষ অংশ)

।।৩।। ভাইজাগ শহরটা বেশ সুন্দর, পরিপাটি, সাজানো, একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিলাম রামকৃষ্ণপুরমে। বাবা মা আমার সাথে এসে সবটা সাজিয়ে দিয়ে গেছল। জয়েনিং-এর প্রথম দিন স্বভাবতই

Read More »

বেনামী (প্রথম অংশ)

-“মুন তোকে কতবার ঠিক বলতে হবে, ব্যাগটা গোছাচ্ছি, আর কী কী নিবি তুই দেখে নিবি আয় ।” মা-এর গলা খাঁকারিতে নড়ে চড়ে বসলাম একটু, হাতের

Read More »

Share with