||১||
“উফফ, অ্যাটিচিউড টা দেখেছিস, আগুন তো রে পুরো |” চেক আউট করতে করতে বলল অগ্নি, রূপককে | থার্ড ইয়ারের পৃথা ততক্ষনে করিডর পেরিয়ে ক্লাসরুমের পথে, কাঁচা হলুদ কুর্তি, সিল্কি স্ট্রেট চুল, রুপোলী ঝুমকোতে অসামান্যা লাগছিল পৃথাকে, বলাই বাহুল্য, ছোট্ট টিপ আর ঘন কাজল যেন পৃথার চোখের গভীরতা আরও কয়েক গুন বাড়িয়ে দিয়েছে | রূপক, মানে অগ্নির সর্বক্ষণের সঙ্গী, বলল,”তোর কি মাথা খারাপ, তুই জানিস ও আমাদের সিনিয়র, তারপরও ?”
-“যাহ শালা, সিনিয়র? এটা তো খেয়ালই ছিল না, ধ্যুর ধ্যুর |”
*****************
(RGM কলেজ ক্যাম্পাস)
অগ্নি, রূপক কলেজের ফার্স্ট ইয়ার কমার্স | কলেজে ঢোকার পর থেকেই এমন কোন সুন্দরী বাকী নেই, যে অগ্নির ‘প্রেম’-এর জাল থেকে বাদ পড়েছে | হবে নাই বা কেন, গ্রীক ভাস্কর্যের এমন সুপুরুষকে ‘না’ বলবে, এমন মেয়ে কজনই বা আছে | বরং, সব জেনে শুনে মেয়েরা যেন পতঙ্গের মতন আগুনের কাছে ছুটে আসে, নিজে যেচে পুড়তে, শেষ হতে | লোহিত কণিকার বর্ধিত গতি যেন আরও দ্রুত হয় মেয়েদের, অগ্নির চোখে চোখ রাখলে |
অগ্নির ক্যাসিনোভা ইমেজ, কারওর অজানা নয়, সব জেনে শুনেও মেয়েগুলো প্রেমে পড়ে ছেলেটার, তারপর থেকে সেই… পাঁচদিন পর প্রেম পাখি জানলা দিয়ে পালালে মেয়েদের হাপুস নয়নে কান্না শুরু, আর উল্টো দিকে অগ্নি, ফিচেল হাসি হেসে নেক্সট মেয়ে পটাতে ব্যস্ত ততক্ষনে | প্রেম, ভরসা, বিশ্বাস, ভালবাসা, আস্থা, আনুগত্য এই বিশেষণগুলোর কোন জায়গা অগ্নির জীবনে নেই | তবে একসময় ছিল বইকী, সে অন্য গল্প | যাইহোক, এহেন সেই অগ্নির এখন নতুন প্রেম থুড়ি, এবার ‘মন’ মজেছে পৃথা নামক মেয়েটির উপর |
এতদূর অবধি ঠিকই ছিল, পৃথা অগ্নির সিনিয়র, এই অবধিও ঠিক ছিল, কিন্তু, পৃথা নামের মেয়েটি আর পাঁচটা মেয়েদের মতন না, অগ্নির দিকে ক’বার আদৌ তাকিয়ে দেখেছে বলা মুশকিল | তো যে ছেলের দিক থেকে কোন মেয়ে চোখ ফেরাতে পারে না, সেই ছেলের দিকে এই মেয়ে ফিরেও তাকায়নি এখন, তার উপর সিনিয়র, আর পাঁচজনের মতন যে এই কেস হবে না, তা বলাই বাহুল্য |
||২||
রাগে গজগজ করতে করতে কমন রুমে ঢুকল পৃথা, সঙ্গে টিকলি আর পিপাই, ওর ছোটবেলার দুই বন্ধুও আছে |
-“কী ভাবে বলতো ছেলেগুলো নিজেদের? একটার পর একটা মেয়ে তুলবে, ঘুরে ফিরে দুদিন পর আবার আর একজন? আমার খুব ইচ্ছে করছিল ছেলেটার দু’গালে দুটো ঠাসঠাস করে চড় মারি, নেহাত তোরা আটকালি নয়তো…|”
পৃথার রুদ্রমূর্তি দেখে দুই সখী শান্ত করার চেষ্টা করলো অনেক | কিন্তু খুব একটা শান্ত হলো না পৃথা, ওর এই অশান্ত ব্যবহারের কারণ ঘন্টা খানেক আগে ওর হাত ধরে ওকে ‘প্রেম’ নিবেদন অগ্নির, আর যাওয়ার সময় ওর মাথার ক্লিপটা খুলে দিয়ে বাইকে পালিয়ে যাওয়া, আর যেতে যেতে বলে যাওয়া, ” খোলা চুলেই বেশি মানায় তোমায় |”
*****************
পৃথা থার্ড ইয়ার সায়েন্স, একজন সিনিয়রকে সম্মান তো দিতে জানেই না, উল্টে এই ধরনের রসিকতা, এটা পৃথা কিছুতেই মানতে পারছিল না | বড়লোক বাপের বখে যাওয়া ছেলে, কলেজে পড়তে তো আসে না, আসে এসব করতেই… ইত্যাদি ইত্যাদি | গজগজ করতে লাগল পৃথা, মনটাকে শান্ত করার জন্য |
অগ্নির বাবার কন্সট্রাকশনের বিজনেস, অবস্থা স্বচ্ছল তা বলার অপেক্ষা রাখে না, বাড়ি শ্যামবাজার | পৃথার বাড়ি শিলিগুড়ি, এখানে পি.জি তে থেকে পড়াশোনা করে | পৃথার বাবা সরকারি চাকুরে, অবস্থা ভালোই |
পৃথা কলকাতায় শোভাবাজারে থেকে, এখন থেকে কলেজটা কাছে হয়, তাই | কিন্তু আজ সেই লেট হয়েই গেল, ক’দিন ধরেই ঘুম থেকে উঠতে এত দেরী হয়ে যাচ্ছে, আর তারপর পুরো দিনটাই ডিস্টার্বড হচ্ছে, তাড়াহুড়ো করে বাস স্টপে পৌঁছাল বাসের জন্য পৃথা | বারবার ঘড়ি দেখা আর বাসের অপেক্ষার মাঝে চোখ গেল উল্টোদিকের ফুটপাথে, অগ্নি, বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে, হয়তো কোন রূপসীর অপেক্ষায় | স্বভাবতই পাত্তা দিল না পৃথা | বাস এসে যেতে উঠে পড়ল ও, পিছনে ওর জন্যই অপেক্ষারত অগ্নির দিকে ফিরেও তাকাল না পৃথা |
||৩||
(বেশকিছুদিন পর)
সময় নিজের নিয়মে প্রবহমান | পৃথার বারবার উপেক্ষা, অগ্নির মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই একটা জিদ তৈরি করছিল | আজ অবধি কোন মেয়ে অগ্নিকে ‘না’ বলেনি, ইনফ্যাক্ট বলতে পারেনি, সেখানে এই মেয়ে অগ্নিকে হ্যাঁ বলা তো দূর, বরং অগ্নির দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না | আর এটাই অগ্নির ইগো, বলা ভাল মেল ইগোকে সজোরে আঘাত করেছে, এখন পৃথাকে হ্যাঁ বলানোটা অগ্নির কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে যাচ্ছিল | দিনের পর দিন, দিনের বেশীর ভাগ সময়টা পৃথাকে নিয়ে ভাবতে গিয়েই কেটে যায় অগ্নির, ওর আত্মসম্মান, ওর কলেজ ইম্প্রেশন-এর কী হবে |
****************
কলেজে ঢুকল অগ্নি | নাহ, এখনও অবধি পৃথা অগ্নিকে ভালভাবে দেখেওনি, অগ্নি মেনেই নিয়েছে পৃথা আর ওকে হ্যাঁ বলবে না | এই একটা মেয়ের কাছে ও হেরে গেল | এই মেয়ে অন্য সব মেয়ের থেকে বড্ড আলাদা, তার চরিত্রে অহংকার – দম্ভ নয়, বরং দৃঢ় – ঋজু মনোভাব, চাল চলনে ব্যক্তিত্বে প্রখর |
****************
লাইব্রেরির সামনের করিডরটায় অগ্নির সাথে দেখা হলো পৃথার | দেখা হলো বলা ভুল, নিজের খেয়ালে চলতে চলতে হঠাৎ অগ্নি দেখল পৃথা সিঁড়িতে একলা বসে | এভাবে তো কখনো বসে থাকে না, সবসময় তো দৌড়া দৌড়ি করেই চলেছে | চুপচাপ বসে এক কোণে, ভাল করে তাকাতেই চোখে পড়ল ওর চোখে জল | একমুহূর্তের জন্য হলেও থমকাল অগ্নি, এরকম রুদ্রমূর্তির চোখে জল কী করে? পৃথা আর কান্না ! মেলানো যায় না শব্দ দুটো |
-“কী হয়েছে?” অগ্নি আর জিজ্ঞেস না করে পারল না |
কোন উত্তর দিল না পৃথা, শুধু মুখটা অগ্নির দিক থেকে ফিরিয়ে সরে বসল |
অগ্নিও ছাড়বার পাত্র নয়, পৃথার মুখ থেকে না শুনে উঠবে না | কিছুটা সময় কথা চালাচালির পর অবশেষে পৃথার ধৈর্য্য ভাঙল |
-” তোর প্রব্লেমটা কী বলতো? কী ভাবিসটা কী তুই নিজেকে? কত জ্বালাবি আর আমায়? তোর প্রতি আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই না তো কোনদিন হবে, কেন বিরক্ত করছিস বলতো? আর ওই হ্যান্ডসাম হিরোর জন্য মরি না আমি, এটা মাথায় ঢুকিয়ে রাখ, পারলে একটা ভদ্র মানুষ হ | আর দয়া করে আমায় একা ছাড়, আর প্লিজ জ্বালানোটা বন্ধ কর | আমি তোর সিনিয়র এটা মাথায় রাখিস |” কথাগুলো ঝড়ের বেগে বলে উঠে চলে গেল পৃথা |
অগ্নির কানে কথাগুলো যত না প্রবেশ করল, তার থেকে বেশী লাগল বোধ হয় মনে | এভাবে কোনদিন কেউ বলেনি, আজ বড় অদ্ভুত লাগছিল অগ্নির | সত্যিই তো, ও কী করছে? কেনই বা করছে? যবে থেকে ঐ ঘটনাটা ঘটেছিল রীতিকার সাথে, তারপর থেকেই…. , আর ভাবতে পারছিল না অগ্নি, উঠে পড়ল ও |
||৪||
কিছুদিন ধরেই অগ্নির মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে হঠাৎই, কী পরিবর্তন সেটা ও নিজেও জানে না, কিন্তু কিছু তো পাল্টেইছে | কী তা জানা নেই, শুধু পৃথাকে আর আগের মত একটা চ্যালেঞ্জে হিসাবে দেখতে পারে না ও | পৃথার জায়গা অগ্নির মনে অগ্নির অজান্তেই যেন একটু বদলে যাচ্ছিল, ক’দিন আগেও যে মানুষটাকে চ্যালেঞ্জ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারতো না, হঠাৎ করেই তাকে একটা মানুষ ভাবতে শুরু করেছিল |
রাত্রে একাধিক মেয়ের সাথে চ্যাট করে, গল্প করে টাইম পাস করতে আর ভাল লাগছিল না অগ্নির | নিজের মধ্যেকার পরিবর্তনটা আস্তে আস্তে জোরালো হচ্ছিল, সেটা অগ্নি পরিষ্কার বুঝতে পারছিল | রীতিকার পর কই আর কখনো কারও জন্য এরকম হয়নি তো, সব মেয়ে অগ্নিকে পাত্তা দিত, আর অগ্নিই তাদের ধরতো ছাড়তো, আর এ তো পাত্তাও দিল না, তারপরও অগ্নির ওর প্রতি এত টান কেন বাড়ছে | তাহলে কী….. নাহ, অগ্নি আর ভাবতে চাইলো না, এসব ওর জন্য নয়, তাই এসব যত দ্রুত সম্ভব মাথা থেকে বের করে দেওয়াই ভাল |
***************
(বেশ কিছুদিন পর)
পৃথা আর অগ্নির মধ্যেকার তিক্ততা এখন আগের থেকে অনেকটা কম | নাহ, অগ্নি আর বিরক্ত করে না পৃথাকে, বরং একজন সিনিয়রের সাথে দেখা হলে যেরকম ব্যবহার কাম্য, সেটাই করে | তবে এতদিনে অগ্নি এটুকু বুঝে গেছে, নিজের অজান্তেই ও পৃথাকে ওর মনে না চাইতেও সেই জায়গাটা দিয়ে ফেলেছে, যেটা একদিন রীতিকাকে দিয়েছিল, আর রীতিকার পর আর কেউ সেই জায়গা নিতে পারেনি |
পৃথাও অগ্নির সাথে এখন যতটা সম্ভব স্বাভাবিক-ই ব্যবহার করে, পৃথাও অগ্নির ভিতর এই পরিবর্তনটা লক্ষ্য করেছে বইকী | কিন্তু, দেখেও অনেক কিছু অদেখা করতে হয়, পরিস্থিতির কারণে, সেটা বোঝে পৃথা | অগ্নিও নিজের মনের মধ্যে নিজের আবেগটা সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিল | শুধু একদিন ভুল করে ড্রিঙ্ক করে মেসেজ করে ফেলল পৃথাকে, ব্যস | মস্তিস্ক কাজ করছিল না আর মন তো কথা শোনেই না, হয়েই গেল ভুলটা | রীতিকার বিস্বাসঘাতকতা করে চলে যাওয়া আর তারপর অগ্নির জীবনের সমস্ত চাপান-উতোর সবটা বলে ফেলল অগ্নি পৃথাকে, পৃথা অগ্নির জন্য কী, সেটাও বলে ফেলল বিশ্বাসঘাতক মনটা |
||৫||
(এক বছর পর)
অগ্নি আর পৃথা সিনিয়র জুনিয়র হলেও আজ খুব ভাল বন্ধু | অনেক তিক্ততা পেরিয়ে, সব জেনেও অগ্নির সাথে আর কোন দুর্ব্যবহার করেনি পৃথা, বন্ধুত্বটা রইল-ই | কিন্তু হঠাৎ একদিন…
****************
আজ বিগত কয়েকদিন ধরে অগ্নি পৃথাকে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও ফোনে পাচ্ছে না | ওর পিজিতে গেল, সেখানেও কোন খবর নেই, বাড়ির ফোনেও পেল না, কোন ভাবেই যোগাযোগ করতে পারছে না, কী হলো হঠাৎ? অগ্নি আবার কী কিছু ভুল করলো? রীতিকাও তো এভাবেই চলে গেছিল | যদিও পৃথার প্রতি অগ্নির ভালোবাসাটা একান্তই নিজস্ব, পৃথার এখানে কোন দায় নেই, তাই বিশ্বাসঘাতকতার যুক্তিটা তো পৃথার জন্য খাটেও না | অনেক যুক্তি ছিল খাটানোর জন্য, কিন্তু কোনভাবেই অগ্নি নিজেকে শান্ত করতে পারছিল না, কীভাবে নিজেকে শান্ত করবে ও….. পৃথাকে কবে ও এতটা ভালোবেসে ফেলেছে ও তো নিজেও বোঝেনি |
***************
(কিছুদিন পর)
চিঠি এসছে একটা, আজ সকালেই, পৃথা পাঠিয়েছে | চিঠিটা খুলে পড়া অবধির মুহূর্তটাও যেন দীর্ঘ মনে হচ্ছিল অগ্নির, পড়তে শুরু করল ও, যার জন্য এতদিন ধরে অপেক্ষা করছিল ও |
“প্রথমেই এইরকম অদ্ভুত ভাবে যোগাযোগ করার জন্য একটা ক্ষমা চেয়ে নিলাম সিনিয়র হলেও | যদিও আর কোন উপায়ও ছিল না আমার | তোকে চিঠিটা লেখার কারণ একটাই, আমি জানি তুই আমার সাথে যোগাযোগের আপ্রাণ চেষ্টা করেছিস এবং করছিস, তোর কাছে একটাই অনুরোধ, আর চেষ্টা করিস না | এবার বদলে ফেল অভ্যেসটা, কারণ এই অভ্যেসটাতো তোকে করতেই হবে, আমি আর কোনদিন ফিরব না | আমি জানি তুই আমায় ভালোবাসিস | হ্যাঁ, আর পাঁচটা মেয়ের সাথে টাইম পাশের মতো না সেটা, সেটাও জানি | আমি তোর থেকে সিনিয়র সেটা জেনেও তুই বারবার দুঃসাহস দেখিয়েছিস, সেটা ভাবলে আমার এখনও হাসি পায় | যাক গে, আমার জন্য অপেক্ষা করাটা এবার ছেড়ে দে, কষ্ট ছাড়া কিছুই পাবি না | তোর মনে আছে, একদিন তুই আমায় কাঁদতে দেখেছিলি সিঁড়িতে বসে, সেদিনই খবরটা প্রথম পেয়েছিলাম | হুম, আমার হাতে খুব বেশী সময় নেই, সেজন্যই সেদিন ভেঙে পড়েছিলাম |”
আমিও কী তোকে? জানি না, হয়তো…. | থাকে কিছু কথা না বলা | প্লিজ আর প্রশ্ন করে ক্ষতবিক্ষত করিস না নিজের মনটাকে | তুই যখন চিঠি হাতে পাবি, তখন আমি কী অবস্থাতে, আমি নিজেও জানি না | অপেক্ষার অবসান ঘটা, ভালো থাকিস |
নাহ, করেনি অপেক্ষা অগ্নি, আর কোন প্রশ্নও করেনি, কী যায় আসে প্রশ্ন উত্তরে, কিন্তু ভালোবাসা বন্ধ করেছিল কী? নাহ, ভালোবাসতে অধিকার তো একমাত্র ওর, কেউ সেটা ছিনিয়ে নিতে পারেনি ওর থেকে | আজ ও মানুষের মতো একটা মন নিয়ে বাঁচে, পৃথার জন্যই | হাঁ, ও ওর জীবন পথে এগিয়ে গেছে শুধু পৃথার জায়গাটা ওর মন থেকে কেউ আর এ জীবনে নড়াতে পারবে না |