মাতৃত্ব

matritwo bengali story imageবিক্রমপুরের রাজ্ বাড়ি ‘রাজ্ নারায়ণ ভিলা’ | এই যুগে দাঁড়িয়ে রাজত্ব গেলেও রাজবাড়ীর ঠাটবাট অক্ষুন্ন | সে খাওয়াদাওয়া হোক বা জীবনযাত্রা, বা রুচি সংস্কৃতি, বা মানসিকতা |

এ হেন, সেই প্রাসাদপম বাড়িটির সর্বময় কর্তা শ্রী দর্পনারায়ণ সিংহ রায় | এনার ঠাকুরদা, দাদা, পরদাদার আমলের বাড়িটি সাজসজ্জা জাঁকজমকে এখনো সাধারণ মানুষের চোখ টানে | বাড়ির চারপাশে বিশাল ফুলের বাগান, রাজপথ ফটক অবধি, বাগানে আস্ত পরীর মূর্তি সমেত ফোয়ারা, গাড়ি বারান্দা, ঝাড়বাতি, সুবিশাল ও ততোধিক সুন্দর ভাবে সাজানো প্রতিটি ঘর, পাথরের কাজ করা অসাধারণ মূর্তি, পেন্টিং, মেহগনি কাঠের আসবাব |

রাশ ভারী মানুষের সাথে সাথে সজ্জনও বটে মানুষটি | গরীব মানুষদের বিপদে আপদে ছুটে যান , স্ত্রী কিরণবালা দেবী |

রাজত্ব না থাকলেও ঐতিহ্য মেনে এখনো রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানও হয় | বেশ কিছু বছর আগে অভিষেক হয়েছিল এবাড়ির বড় ছেলের, মানে দর্পনারায়ণের বড় ছেলে দেবী প্রাসাদ সিংহ রায় এর | সবই ঠিক ছিল | হঠাৎ আলো ঝলমলে প্রাসাদটা তার জৌলুস হারালো সেইদিন যেদিন দার্পনারায়ণের কনিষ্ঠ পুত্র পারিজাত-এর অপঘাতে মৃত্যু হয় একটা কার একসিডেন্টে, তার বিয়ের এক বছরের মধ্যে |

 

**********************

 

রাজত্ব যাওয়ায় এখন রাজ্ পরিবারের সদস্যরা ব্যবসার দিকে ঝুঁকেছে | জ্যেষ্ঠপুত্রের হাতে ব্যবসার দায়িত্ব তুলে দিয়ে দর্পনারায়ণ এখন অধিকাংশ দিন চোখের জল ফেলেন পুত্র শোকে | কিরণবালা দেবী শোকে এতটাই বিহ্বল যে এখনো তাকে কেউ কাঁদাতে পারেনি | শোকে পাথর সে |

পরিবারে আটটি সদস্য, দর্পনারায়ণ, তাঁর স্ত্রী, বড় ছেলে ও তার স্ত্রী ,কন্যা, দর্পনারায়ণের ভাই, ভাইয়ের বউ, তাদের দু কন্যারই বিয়ে হয়ে গেছে, আর পারিজাতের বিধবা স্ত্রী শাওন |

শাওন আর পারিজাতের বিয়েটা হয়েছিল কয়েক মাস আগেই | কত হবে, আট নয় মাস | পারিজাত সবার ছোট হওয়ায় স্বভাবতই সবার একটু বেশিই আদরের ছিল | শাওনকে ঘরের বউ করে এনে কিরণবালা দেবী প্রথমেই একটা কথা বলে দিয়েছিলেন,” আমার ছেলের যেন কোনো কষ্ট না হয়, ওকে বেঁধে রাখিস |”

তা সেই বাঁধন টিকলো কই? ভাগ্য বিরূপ হলে বাঁধে কার সাধ্যি | এই কমাসের মধ্যে সত্যিই পারিজাতের সাথে দৃঢ় বাঁধন টুকুও তৈরি হয়নি; সবে বুঝতে শুরু করেছিল শাওন, কিন্তু বুঝতে না বুঝতেই সব বোঝাপড়ার অবসান হলো |

পারিজাতের সাথে শাওনের বয়সের পার্থক্য টাও এখনকার যুগ অনুপাতে অনেকটাই – প্রায় ১২ বছর | শাওনের এখন মাত্র ২০ বছর | এখন যেখানে জীবন অসংখ্য রঙের তুলিতে মেতে ওঠার কথা, সেখানে, শাওনের জীবনের রং শুধুই সাদা | শাওনের মা ছোট বয়সেই মারা গেছলেন, বিয়ের পর পরই শাওনের বাবা মারা যান, এবার স্বামী, শাওন কি এতটাই অপয়া? কাউকে কেন ধরে রাখতে পারে না ও ?

যেদিন মৃতদেহ রাজবাড়ীর দালানে এলো, শাওন একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল পারিজাতের বন্ধ চোখের দিকে | ……..’স্বামীকে যত্নে ভালোবাসায় একটু একটু করে বাঁধছিলামই যখন তখনি এভাবে চলে যেতে হলো ?’

শাওনকে সেদিন কিরণবালা দেবী শুধু বলেছিলেন, “ধরে রাখতে পারলি না রে?” | ব্যস আর কোনো কথা, কান্না, কিছুই না,……….. কিরণবালা দেবী যন্ত্রের মতো নিজের কাজ করে যান  এখন সারাদিন |

শাওনের মা নেই তাই শাশুড়ি মা ই মাতৃস্নেহে মেয়ের মতো এবাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন শাওনকে, সেই মানুষটার থেকেই তার পরম প্রিয় জিনিসটা যেন কেড়ে নিয়েছে শাওন | এখন আর ইচ্ছে করলে মার কোলে গিয়ে বলতে পারে না শাওন, ” মা একটু হাত বুলিয়ে দাও “| খাইয়ে দেয়ার আবদারও আর করা হয় না শাওনের | তার চেয়ে বরং সারাদিন শাওনের কেটে যায় নিজের ঘরে, খোলা জানালা দিয়ে রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া গাছ গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে শাওন | রাধাচূড়াও কৃষ্ণচূড়ার আগুন রঙা লাল আঁচে যেন প্রেমে, লজ্জায় নত হচ্ছে | আগুন রঙা লাল আর কাঁচা হলুদ রঙে মিলে মিশে একাকার সামনের দালানের বাইরে টুকু |

বিধাতা যেন সবটুকু রং দিয়ে সাজিয়েছে চারপাশটা | শুধু শাওনের সিঁথির রংটাই হারিয়ে গেছে | এভাবেই বেশ কিছুদিন কেটে গেলো কিন্তু বিধাতার ভাবনা হয়তো কিছু অন্যই ছিল |

 

*************************

 

” বাবা আমি তাহলে ডাইরেক্ট একবার ওনাদের সাথে মিট করে আসি, ডাইরেক্ট কথা বললে ব্যবসাতেও সুবিধেই হবে |”- ডাইনিং টেবিলে বসে চিকেন খেতে খেতে রোহিত তার বাবাকে জিজ্ঞেস করে, রিসেন্ট যে কনস্ট্রাকশন বিসনেস এর ব্যাপারে কথা চলছে ‘সিংহ রায় এন্ড কো’ সঙ্গে, তার ব্যাপারে | রোহিতের বাবা মিস্টার দেবাশীষ লাহিড়ী ‘লাহিড়ী কন্সট্রাকশনস’ কর্ণধার |

ছেলের কথায় সায় দিয়ে বললেন,” আমিও তাই ভাবছিলাম | তাহলে তুমি এজ সুন্ এজ পসিবল বেরিয়ে পড় | ওখানে কিছুদিন থেকে পুরোটা বুঝে এস |”

” ওকে ডান”, বলে রোহিত টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লো | রোহিতরা মুম্বাই-এ থাকে তবে বাঙালি |

পরিকল্পনা মাফিক রোহিত পৌছালো তার গন্তব্য স্থল ‘সিংহ রায় ভিলা’ | রোহিত এর আগে গ্রাম, রাজবাড়ী কিছুই দেখেনি, তাই এটা ওর কাছে একটা ভালো স্মৃতি হয়েও থাকবে | এই ভেবে রোহিত এগিয়ে গেলো প্রাসাদের মূল গেটের কাছে | আগে থেকে বলাই ছিল তাই দারোয়ানকে পরিচয় দিতেই দারোয়ান গেট খুলে স্বাগত জানালো ও মূল বাড়িতে খবরও গেলো |

মূল ফটক থেকে বাড়ি অবধি ছোট সরু রাস্তা টার দুপাশে কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়ার গাছ | এছাড়া বাড়ির চারপাশটা যতদূর চোখ যায়, চোখ ধাঁধানো অজস্র ফুলের বাগানে রোহিতের মনটা ভরে গেলো | ফুল দিয়ে ঢাকা ছোট রাস্তা দিয়ে এগোতে এগোতে রোহিতের চোখ পড়লো, সামনের তিন তলার বিশাল বারান্দাটায় | কে যেন দাঁড়িয়ে একজন কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়ার ফুল গুলো একমনে দেখছে |

দেখেই রোহিতের চোখ আটকে গেলো | অসামান্যা সুন্দরী , হাতে হয়তো পুজোর থালা, একটু যেন ভেজা চুল, কপালে চন্দনের টিপ্, গলানো সোনার মতো গায়ের রং | ঘিয়ে রঙের সিল্ক ধরনের শাড়ী পরা মেয়েটা কে? বয়সে তো রোহিতের থেকে ছোটই লাগছে | এবাড়ির মেয়ে মনে হচ্ছে | হাঁ করে দেখতে দেখতেই এবাড়ির দরজায় এসে গেছে রোহিত | মেয়েটা এবার বারান্দা দিয়ে সোজাসুজি দেখতে পেয়েই মুখে ঘোমটা টেনে চলে গেলো |

বাড়ির লোকজন খুবই খাতির করলো | “কাল থেকে কাজ শুরুর কথা, আজ বিশ্রাম করুন ” এই বলে দর্পনারায়ণ আহ্বান জানালেন |

অতিথি সেবার কোনো ত্রুটি থাকেনি, একথা বলাই বাহুল্য | কিন্তু এইসব কিছুর ভিড়ে রোহিত খালি ওই বারান্দার মেয়েটার কথাই ভাবছিলো | তাকে তো কোথাও দেখছে না |

এভাবেই রোহিতের চোখ তন্ন তন্ন করে খুঁজে চললো সেই পরীকে, না কোন অলংকার, না কোন সাজের বাড় বাড়ন্ত, তাও কত সুন্দর, কত শুদ্ধ যেন |

সারাদিন সবার সাথে আলাপ হলো, কথাও হলো , দেবীপ্রসাদের মেয়ের সাথে খুব ভাব হয়ে গেছে রোহিতের | তিতলিই ওকে বাগান দেখতে নিয়ে গেলো | এতো বড় বাগান যে একদিনে দেখা সম্ভবই নয় | “আবার কাল দেখাবো সব ঘুরিয়ে”, ছোট্ট তিতলি এই বলে বাড়ি ফিরলো | ক্লান্ত থাকায় রোহিত সে রাত্রে তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়লো |

পরদিন অসাধারণ একটা গন্ধে রোহিতের ঘুম ভেঙে গেলো রোহিতের | প্রথমে ভাবলো ফুলের বাগান থেকে গন্ধ আসছে | পরে বুঝলো এটা তো চন্দনের গন্ধ, একদম খাঁটি চন্দন | রোহিতের ঘুম ভেঙে গেলো, ভাবলো ভোরের প্রকৃতির রূপটা দেখে আসে | এখনো হালকা শীত লাগে ভোরে, বসন্তকাল এলেও একটা চাদর জড়িয়ে রোহিত বেরোলো | চারপাশটা একটু ঘুরে বাড়ি ফেরার পথে আবার দেখলো রোহিত বাগানে ফুলের সাজি হাতে সেই কালকের মেয়েটি | আজ পরিষ্কার ভাবে দেখলো মেয়েটিকে | এতো পবিত্র, এতো নির্মল সেই রূপ যে চোখ ফেরানো দায় | কিন্তু এত বড় রাজবাড়ীর মেয়ে হয়েও প্রসাধন বলতে কপালে শুধু চন্দনের টিপটা |

রোহিত ভাবলো, আজ কথা বলতেই হবে | রোহিত এগিয়ে গেলো | মেয়েটি একমনে ফুল তুলছে, সে তাকায়ওনি |

“শুনছেন?” হঠাৎ অচেনা পুরুষ কণ্ঠ কানে যেতে অবাক চোখে ঘুরে তাকালো শাওন রোহিতের দিকে |

ভোরের নরম আলো শাওনের মুখে পড়ে তাকে যেন আরও অসাধারণ করে তুলেছে | রোহিত শাওনের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে | শাওন এখানে কেউ এভাবে থাকতে পারে ভাবতে পারেনি, নিজের ভিজে চুল সামলে মাথায় ঘোমটা টেনে ওখান থেকে চলে আসছিল |

রোহিত আবার বললো,”আপনি কি এবাড়িতেই থাকেন? আসলে কালও আপনাকে একবার দেখেছিলাম |” শাওন কথার উত্তর না দিয়ে হন হন করে চলে গেলো | রোহিত অবাক হয়ে রমণীর অকস্মাৎ প্রস্থানের দিকে চেয়ে রইলো |

সারাদিন ব্যবসার কাজে, কথাবার্তায় কেটে গেলো | বিকেল হতে তিতলির সাথে রোহিত বেরোলো আশপাশটা ঘুরতে | কথায় কথায় তিতলিকে রোহিত জিজ্ঞেস করলো,” তোমার দিদির নাম কী?”

তিতলি অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,” আমার তো দিদি নেই “|

রোহিত,” তাহলে ওই যে একটি মেয়ে, ঘিয়ে রঙের শাড়ী, চন্দনের টিপ্, উনি কে হন?”

তিতলি বুঝতে পেরে বললো,” ওহ! ওটা তো আমার কাম্মা | শাওন সিংহ রায় , আমার কাকিমা |”

রোহিতের মনটা হঠাৎ মুচড়ে উঠলো | কাকিমা মানে তো এবাড়ির বৌ | এটা ভাবেই রোহিতের মনটা কেমন যেন ধু ধু করে উঠলো, কেন সে নিজেও জানে না | সারা রাস্তা রোহিত কোন কথা বললো না | হঠাৎ রোহিতের কী মনে হলো, বললো, ” আচ্ছা তিতলি তোমার কাকুকে তো দেখলাম না “|

তিতলির মুখের উদ্ভাসিত হাসিটা একঝটকায় মিলিয়ে গেলো | বললো,” আমার কাকু এই ছয় মাস হলো মারা গেছেন “|

রোহিত শুনে কষ্ট পেলো নাকি খুশি হলো রোহিত জানে না | কারোও মৃত্যু সংবাদে খুশি হওয়ার কথা নয়, কিন্তু তাও যেন রোহিতের খুব রিলাক্সড লাগলো হঠাৎ | রোহিত আর তিতলি গল্প করতে করতে বাড়ি ফিরলো |

 *********************

শাওন অহোরাত্র কৃষ্ণ সেবাতেই মগ্ন | পারিপার্শ্বিক জগতে কী ঘটছে সে সব বিষয়ে পুরোপুরি নির্ল্লিপ্ত | সন্ধ্যা পুজোর সময় চন্দন ঘষছিলো শাওন | এই ঠাকুর ঘরে আর ওর ঘরের বারান্দা যেখান থেকে ফুলের গাছ দেখা যায়, এই দুটো জায়গাতেই একমাত্র শান্তি পায় শাওন | চন্দন বাটতে বাটতেই হঠাৎ শাওনের সকালের ছেলেটার কথা মনে হলো | কে ঐ ছেলেটা ? কিরকম অদ্ভুত ভুবন ভোলানো দৃষ্টি, যেন কিছু না বলেই সব বুঝিয়ে দেয় | বার বার শাওনের সামনে চলে আসছে সে চেহারাটা |

শাওন কাজে মন দিলো | কাজ মিটিয়ে ঠাকুর ঘর থেকে বেরোতেই শাওন শুনল তিতলি আর সকালের ভদ্রলোকের গলা | শুনেই শাওনের অস্থির লাগছিলো | শাওন তাড়াতাড়ি দালান পার হয়ে ওপরে যাওয়ার সিঁড়ির দিকে জোরে পা চালিয়ে চলে যাবে এমন সময় মুখোমুখি সেই ছেলেটির সঙ্গে |

রোহিত ও শাওন একে অপরের দিকে কিছুক্ষন চেয়ে ছিল | এখন তিতলি বলে উঠলো ,” এই যে আমার কাম্মা, যার কথা তুমি জিজ্ঞেস করছিলে রোহিতদা | এই যে |”

শাওন চলে যেতে উদ্যত হতেই রোহিত পথ আটকায় | শাওন থতমত খেয়ে রোহিতের দিকে তাকায়, এরকম কিছু প্রত্যাশা করেনি বলে | রোহিত বলে,”আপনি কী কথা বলতে পারেন না ? বার বার এভাবে উত্তর না দিয়ে চলে যান |”

আমায় ঘরে সন্ধ্যের ধুপ দেখতে হবে, বলেই শাওন চলে যায়, ঘরে গিয়েই শাওন দোর আটকায়, বুকের ভেতর যা ধড়পড় করছে | ভারী মিষ্টি তো ছেলেটি | আচ্ছা তিতলি কী বললো, ছেলেটি শাওনের কথাই জিজ্ঞেস করছিলো? হঠাৎই অনেকদিন পর হেসে উঠলো শাওন | কারন ওর জানা নেই, বহুদিন পর ঘরের আয়নায় নিজেকে একটু ভালো করে দেখতে ইচ্ছে হলো ওর |

ধুৎ, কী সব পাগলামো করছি | উঠে পড়ে শাওন |

এভাবেই পরের কিছুদিনে শাওন রোহিতের কাছে সহজ হয়ে ওঠে | এই প্রথম শাওন পরপুরুষের সাথে কথা বলে | যদিও সবার অলক্ষে, ভোরবেলা ফুল তোলার সময় | ভারী মজার মানুষ এই রোহিত,মজার মজার কত কথা বলেন |

এই দু’তিন দিনেই শাওন যেন আবার আগের শাওন এ ফিরেছে | একদিনে যেন কত বয়স বেড়ে গিয়েছিলো শাওনের | এখন ওর হাসতে ইচ্ছে করে | রোহিত এতো সুন্দর মানুষ যে শাওন অবাক হয়ে দেখে ওকে, আর ভাবে ওর কথা | এখন বারান্দায় বসেও শাবু খেতে খেতে ওর কথাই ভাবছিলো | ………..কতদিন ভালো কিছু খায়নি | হঠাৎ হাওয়ায় ফুলদানিতে মাটিতে পড়ে, আর সেই আওয়াজে শাওন আবার বাস্তবের মাটিতে এসে পড়ে |

ছিঃ ছিঃ ছিঃ , এসব কী ভাবছে শাওন | একজন বিধবা হয়ে পরপুরুষের কথা ভাবাও যে পাপ | ছিঃ, না আর এসব চিন্তাকে মাথায় উঠতে দেওয়া যায় না | ও যেমন, ওকে এরকমই থাকতে হবে সারাজীবন | এসব স্বপ্ন ভাবাও পাপ | অজান্তেই শাওনের চোখ দিয়ে নোনতা জলের ধারা নামে, কেন? তা শাওনও জানে না |

*************************

 

রোহিত শাওনকে নিয়েই বিভোর, ওর বাবাকে ফোন করে সব জানায় রোহিত; যে ও শাওনকেই বিয়ে করতে চায় | প্রথম দর্শনেই শাওনকে মনে বসিয়েছে রোহিত | কিন্তু, শাওন এবাড়ির ছোট বৌ, বিধবা সবকিছুই খুলে বলে রোহিত তার বাবাকে | রোহিতের বাবা সবদিন ছেলের পাশে থেকেছেন, আজও তাই রইলেন | রোহিত ঠিক করলো কালই শাওনকে বলবে | আর কিছুদিনের মধ্যেই ও চলে যাবে, তাই শাওন এর বাড়ির লোককে রাজি করিয়ে তবেই যাবে |

পরদিন ভোরবেলা শাওন আর রোহিত একই সময়ে বাগানে যায় | শাওন আজ রোহিতের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলছে | রোহিত শাওনের দিকে এগোতেই, শাওন চলে যেতে উদ্যত হয় | রোহিত শাওনের হাতটা ধরে | “শাওন, আমার তোমায় আজ একটা কথা বলার আছে | প্লিজ সেটা শুনে চলে যেও | আমি তোমার বেরঙিন জীবনটাকে আমার জীবনের সবটুকু রং দিয়ে রাঙিয়ে দিতে চাই,তুমিও কী তাই চাও? তাহলে যাওয়ার আগে আমি তোমার শ্বশুর বাড়ির সাথে কথা বলবো |”

শাওনের ভিতরে তখন চলছে তুমুল ঝড়, অস্তিত্বের লড়াই, এতো বড় পাপ শাওন করতে পারবে না | রোহিতের হাত ছাড়িয়ে শাওন ঠাকুর ঘরে ছুটে চলে যায় | কিন্তু অলক্ষ্যে কাকিমা মানে দর্পনারায়ণের ভাইয়ের স্ত্রী সবটা লক্ষ্য করেন ছাদ থেকে | দেখেই উনি সেটা সরাসরি জানান কিরণবালা দেবীকে |

শাওন নিজের কৃষ্ণ ভগবানকে বলে,” আমি কী করবো বলে দাও ঠাকুর | এর থেকে ভালো তুমি আমায় তোমার কাছে নিয়ে নাও “| কাঁদতে থাকে শাওন | ভালোবাসার কোনো অধিকার তার নেই, তা ভালো করেই জানে সে |

*****************

 

” দিদি সবই তো শুনলে, এবার তো কিছু বল | এই নোংরামির একটা বিহিত কর দিদি | স্বামী খেয়েছে বছরও ঘোরেনি | এর মধ্যেই এসব? ছিঃ ছিঃ | দুধ দিয়ে কাল সাপ পুষছ গো দিদি | তুমি যদি না জানাও তাহলে আমি কী তোমার দেওরকে বলবো দাদাকে পুরো টা জানাতে?”

কিছুক্ষন নিস্তব্ধতার পর কিরণবালা দেবী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন |

ঠাকুর ঘরেই বসেছিল শাওন | বেশ কিছুক্ষন পরেই শুনলো নীচের বসার হল ঘরে চিৎকার চেঁচামেচি | ও ভিতরের বারান্দা দিয়ে ঝুঁকে দেখতেই দেখলো, রোহিত কে কাঠ গড়ায় দাঁড় করিয়ে বাবা, কাকা, দাদা, কাকিমা, সবাই রাগারাগি করছেন | তাহলে কী রোহিত বলে দিলো বাড়িতে?

এবার তো আত্মহত্যা ছাড়া কোন উপায়ই রইলো না শাওনের | এসব শুনে আর কেউ শাওনকে ক্ষমা করতে পারবে? ছিঃ ! লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে তার |

শ্বশুর মশাই উপর দিকে তাকিয়ে বললেন, ” বৌমা নীচে এস “| শাওন নীচে যেতেই মা-র দিকে চোখ গেল | নিজেকে অপরাধী ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছে না শাওন |

বাবা ,মা-র দিকে তাকিয়ে শুধোলেন,” আমি যা কিছু শুনছি সব সত্যি? আজ তো অন্তত চুপ থেকো না | এবার মুখ খোলো, এটা আমাদের সম্মানের প্রশ্ন “|

শাওন কিরণবালা দেবীর দিকে তাকিয়ে রইলো এক কাতর আবেদন নিয়ে,এসব কিছু সত্যি নয় যেন বলে মা | সব যেন মিথ্যেই বলে, শাওন ঠিক রোহিত কে ভুলে যাবে | আজ মা শুধু শাওনের সম্মান টুকু বাঁচিয়ে দিক |

কিরণবালা দেবী মুখ খুললেন, ” পুরোপুরি সত্যি”|

শাওন যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না | মনে মনে ভাবলো, তোমার ছেলেকে বেঁধে রাখতে পারিনি বলে এই ভাবে শোধ তুললেন মা? আমি যে তোমায় নিজের মা-ই ভাবতাম | আমিই কী তোমার ছেলেকে ধরে রাখতে পারিনি ? তুমিও তো পারোনি | সব দায় কী আমার?

ভাবতে ভাবতেই দেখলো শ্বশুর মশাই লজ্জায় মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছেন |

 

হঠাৎ, কিরণবালা দেবী বললেন, “মা-র কাছে কিছুই গোপন থাকে না | আমি শাওনকে নিজের মেয়ের মতোই স্নেহ করেছি, এই বাড়িতে এনেছি | নিজের ছেলেকে তো ধরে রাখতে পারিনি, নিজের মেয়েকে আর হারাতে চাই না | আজ শাওন আমার নিজের পেটের মেয়ে হলেও আমি এটাই করতাম | ওরও বাঁচার অধিকার আছে | আর কেউ না থাকুক আমার পাশে আমি নিজে দাঁড়িয়ে শাওন আর রোহিতের বিয়ে দেব | শাওন আর রোহিত পরস্পর k ভালোবেসে ভালো থাকবে”|

হল ঘর জুড়ে নিস্তব্ধতা | সত্যিই মা সব থেকে ভালো বোঝে শাওনকে | এতো ভালো হয়তো শাওন নিজেকেও বোঝে না | অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো শাওন মা-র দিকে | এমন মাতৃত্বের রূপ কজনই বা দেখতে পায় ? আজ শাওন-এর জীবন ধন্য, এই মাতৃত্ব কে দেখে |

 

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

মুক্তি

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেল, আকাশ তখন থেকে ঠায় বসেই রয়েছে ঘাটে। এখন বাঁধানো ঘাট থেকে করিডোর হয়ে বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরে পুজো দেওয়া অনেকটা সহজ

Read More »

বন্ধু হবি চল

বাক্সপেটরা নিয়ে স্টেশনেই বসে ছিল নয়না, বৃষ্টি পড়েই চলেছে, মুষলধারায়। বাবা বলল আরেকটু অপেক্ষা করতে, এত বৃষ্টিতে তো ছাতাও হার মানবে, আর বেরিয়ে রাস্তাও অজানা

Read More »

টিফিনবাক্স

প্রতিবারের মতন এই বছর ও সমস্ত সরঞ্জাম গুছিয়ে বেরোনোর জন্য ব্যস্ত অমিত, অন্তত সন্ধ্যার মধ্যে বেরোতে না পারলে খুব মুশকিল। পুজোর দিকটা কতদূর কি হলো

Read More »

ক্লিক

।।১।। -“মালিনী, কালকের মিটিংটা কখন ফিক্স করেছ? -“ম্যাম, সকাল ১১টা।” -“ওকে, কনফার্মেশন পেয়ে গেছ?” -“ইয়েস ম্যাম।” -“ওকে গুড। আর।।। এক মিনিট।।।” টেবিল থেকে ফোনটা তুলে

Read More »

শিক্ষা

।।১।। দাপুটে, বদরাগী, মেজাজি এই সব কটা বিশেষণই বেশ ভালো যায় মিসেস বোসের সাথে। রেণুকা বোস আর অমরনাথ বোস সানফ্লাওয়ার এপার্টমেন্টে ১২০০ স্কোয়ারফিটের ফ্ল্যাট 2c

Read More »

বিদায়

।। ১।। রীতিমত জোর করেই নন্দিনীকে পাহাড়ে নিয়ে এলো সঙ্গীতারা। আসার ইচ্ছে তো ছিল না ওর একদমই, শরীর সাথ দিলেও মনটা কোনোভাবেই সাথ দিচ্ছে না।

Read More »

Share with