||১||
-“কীরে অর্ক, আজ কী ভয়ে নামবি না নাকী?”
দু চার অক্ষরের গালা-গালগুলো অনর্গল ভেসে আসতে শুরু করলো সাত সকালে, হোলির দিন | মহান বন্ধুরা এই কাজটা ভালোই পারে, এতদিন পর বাড়ি ফিরে কোথায় একটু শান্তিতে ঘুমোবে তা না, বাধ্য হয়ে উঠতেই হলো |
বারান্দায় যেতেই নীচ থেকে বন্ধু বাহিনী বললেন,”তুই ভালোয় ভালোয় নামবি না উপরে উঠব?”
হাতের ইশারায় ওদের বলল যে আসছে কিছুক্ষন পর |
ওদের চারজনের দলটা রাস্তায় আবার একসাথে, আজ বহুবছর পর অর্ক হোলিতে বাড়িতে | ডাক্তারি পাশ করে অর্ক এখন একটা নার্সিং হোমের সাথে যুক্ত, বেশ তাড়াতাড়িই হাত যশ হয়েছে ওর | অর্কর বাড়ি খুবই সাধারণ, সেই বাড়ির ছেলে হয়ে এত দূর অবধি পৌঁছানো সত্যিই প্রসংসনীয়, নিজের ক্ষমতায় ও আজ সাকসেসফুল |
**************
হোলির দিন, একটু ঐসব খাওয়া দাওয়া হবে না তাই হয় নাকী, ওদের পুরোনো আড্ডার ঠেকটাতেই আজ ওরা চারজন আবার আগের মতন | অর্ক ডাক্তার হয়ে গেলেও এখনও বিন্দুমাত্র অহংকার নেই ওর ভিতর | চারটিতে মিলে খাওয়া শুরু করেছে সবে, একটু নেশাটা জমেছে, অমনি পিছন থেকে সোজা ওর পিঠে একটা বেলুন এসে লাগল | অর্কর খুব তাড়াতাড়ি নেশা ধরে যায়, চোখের সানগ্লাস আর মুখ ভর্তি আবিরে অর্ককে চেনাও যাচ্ছে না | চোখের সানগ্লাসটা ঠিক করে নিয়ে পিছন ঘুরে তাকাল অর্ক, এই তো… নেশার ঘোর কী না কে জানে, এতো অপ্সরা একদম, এমন সুন্দর মামনি অর্ককে রং মেরেছে ভেবেই অর্কর মনটা পুলকিত হয়ে উঠল | ওদিকে মাথা হালকা ঘুরছে, পা-ও অল্প টলছে, হাতের লাল আবিরটা নিয়ে এগিয়ে গেল অর্ক | সন্দীপরা বারবার মানা করছিলো, ছেড়ে দে অর্ক, আজকের দিনে রিঅ্যাক্ট করিস না, ঝামেলা করিস না, ছেড়ে দে |
কিন্তু কথা কানে গেলে তো? ততক্ষনে সামনে সেই অপ্সরা, অর্ক কী করবে বুঝতে না পেরে খানিকটা নার্ভাস | গেছিল মজা করতে, ঝামেলা না বাধে |
ওদিকে তার বাকি দুই বান্ধবী, অনুসূয়া, প্রিয়ম্বদা পগারপার পিছন থেকেই | ঘটনা বুঝতে পেরে সেই সুন্দরী রমণীও পালাতে যাচ্ছিল, অর্ক হাতটা ধরে নেয় | অর্ককে দেখতেও সুন্দর, চেহারাও সুন্দর, পাঞ্জাবী সানগ্লাসে বেশ ভালই লাগছিল, দেখে কিছুক্ষণের জন্য হয়তো সুন্দরীও ক্রাশ খেল অর্ক বাবুর উপর | হাতটা ছাড়াল না, বলা ভাল ছাড়াতে চাইল না, হাতের লাল আবিরটা সুন্দরীর মুখে মাখিয়ে দিল অর্ক | সুন্দরী রাঙা হয়ে তখনকার মত পালাল |
“জিও কাকা”, বলে বন্ধুরা তো ঝাঁপিয়ে পড়ল তখন অর্কর ঘাড়ে, অর্কর তখন নেশার ঘোর বেশ বেড়ে গেছে, বেশ ভাল লাগছে, সুন্দরী এখনও চোখ থেকে সরছেই না, সুন্দরীর নরম গালে লাল আবির লেগে যেন আরও মোহময়ী | “কে বলতো মেয়েটা?”, অর্ক জিজ্ঞেস করল বন্ধুদের |
-“নে বাবা, আরে ও তো গণপতি বুড়োর নাতনি, ওকে চিনলি না?”
-“গণপতি দাদু, মানে গণপতি সেন, ও তার মানে মীরা,…” ভাবতে ভাবতেই… আর কিছু মনে নেই অর্কর |
***************
যখন নেশার ঘোর কাটল, তখন সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত | উফফ মাথাটা কী ধরেছে, উঠে বসতেই আবার মেয়েটার কথা মনে পড়ল অর্কর, আর ভাবতেই ঠোঁটের কোণে আলতো হাসি খেলে গেল | এতটাই বিভোর ভাবনায় যে খেয়ালই করেনি, যে ও নিজের ঘরে নেই, সন্দীপের ঘরে, সন্দীপরা যে ঘরে আছে তাও খেয়াল করেনি ও |
-“ঘুম ভাঙল তোর তাহলে? কতটুকু খেয়েছিলিস ভাই যে এত নেশা?”
অর্ক সবদিনই জেদী, একরোখা, উদ্ধত, কথাবার্তা, কাজকর্মে কোন রাখঢাক নেই | ও সটান বলে ফেলল,”ভাই আমি না প্রেমে পড়ে গেছি |”
তিন জোড়া গোল গোল চোখ অর্কর দিকে তাকিয়ে, “কার ভাই, এই তো এলি? প্রেমেও পড়ে গেলি?”
-“হ্যাঁ রে |”
-“তা কার শুনি?”
-“ওই তো সকালের মেয়েটার |”
সন্দীপ ঠাস করে একটা থাপ্পড় লাগল অর্কর গালে, “তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে? গণপতি সেনের নাতনি ও, পাগল তুই?”
-“তাতে কী, গণপতি দাদু আমায় খুব ভালোবাসেন | আর ও তো মীরা, ও এত বড় হয়ে গেছে তাই চিনতে পারিনি, নয়তো ওকে চিনি তো, ও-ও আমায় চেনে |”
-“তুই বুঝতে পারছিস না আমরা কী বলছি?”
এবার নিখিল বলে, “ওদের সাথে আমাদের তুলনা হয়? নিজেই ভেবে দ্যাখ |”
আর কথা বাড়াল না অর্ক, মনে মনে বলল শুধু,’অর্ক যখন যেটা ভেবেছে করেছে, এবারও তার অন্যথা হবে না |’
||২||
অর্কর বাবা, গিরিশ দত্ত, গণপতি সেনের কর্মচারী, মানে সেন ব্রাদার্স এন্ড সন্স -এর এক সামান্য বেতনভুক্ত কর্মচারী | তা গণপতি সেন অর্ককে ছোট থেকেই খুব স্নেহ করতেন, অর্ক খুবই মেধাবী ছিল, তাই আর্থিক ভাবে সাহায্যও করেছেন, পরে গিরিশের মাইনে থেকে কেটে নিয়েছেন, গিরিশ-এরই জোরাজুরিতে | সেই গণপতি দাদুরই একমাত্র নাতনী মীরা | ছোট বেলায় বেশ কয়েকবার কথাও হয়েছে, বড় হয়ে পর অর্ক পড়তে চলে যায়, তারপর থেকে এই দেখা |
অর্ক এতদিনে ডাক্তার, এখন গিরিশবাবুদের পরিবার মোটামুটি স্বচ্ছল | হ্যাঁ, গণপতি সেনের সমকক্ষ হয়তো না, কিন্তু, অর্ক তো কোনো অংশে কম নয়, তাই অর্কর পিছিয়ে আসার কোন কারণই নেই | অর্ক দুদিন পর গণপতি দাদুর সাথে দেখা করতে গেল, নার্সিং হোম থেকে ফেরার পথে, উদ্দেশ্য একটাই মীরাকে আর একবার দেখা, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ও মীরাকে বলবে ওর মনের কথা |
***************
গণপতি সেনকে প্রণাম করে সোফায় বসল অর্ক | গণপতি দাদু খুব খুশি অর্কর জন্য | কথাবার্তা হচ্ছিলই, গণপতি দাদু না খাইয়ে ছাড়ার মানুষ নন, খেতে খেতে অর্কর চোখ ঘুরছিল সারা বাড়ি, কই কোথাও মীরাকে দেখছে না তো?
লুচি তরকারি শেষ করে অগত্যা উঠতেই হলো | বেরোবার আগেও ঝাড়বাতির ফাঁক দিয়ে ভিতর বারান্দার কোনা, মেহগনি কাঠের সোফার আড়াল, শ্বেত পাথরের টেবিলের ওপার, সবটুকু তন্ন তন্ন করে দেখেও পেল না মীরাকে দেখতে | গণপতি দাদুর ছেলে মানে মনোজ কাকুর সাথে বেরোবার আগে দেখা হলো, উনি বাড়ি ছিলেন না | মীরার মা মানে গণপতি দাদুর পুত্রবধূ, মীরা যখন খুব ছোট তখনই মারা গেছলেন |
অবশেষে বেরিয়েই পড়ল অর্ক | বাগান পেরিয়ে গেট-এর কাছে যাচ্ছে তখনই দেখা মীরার সাথে, ততক্ষনে আঁধার নেমেছে, নিয়ন আলোয় মীরার মায়াবী মুখটা দেখে আরও একবার মীরার প্রেমে পড়ল অর্ক | কিন্তু সেদিনের আবির মাখা অর্ককে দেখে আজ চিনতে পারেনি | সেদিন জোর করে আবির মাখিয়ে দেওয়া অবাধ্য, উদ্ধত ছেলেটা অর্কই, সেটা বুঝল মীরা একটু পর, যখন অর্ক বলল,”আমার দেওয়া লাল আবিরকে এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে?” বুঝতে পেরেই বড্ড লজ্জা পেয়ে গেছিল মীরা, সেটা ওই আলো আঁধারিতেও অর্ক বুঝতে পেরেছিল |
সামলে নিয়ে হাসি লুকিয়ে যতটা সম্ভব গম্ভীর হয়ে মীরা বলল,”পিছু করে করে এখানেও চলে এসছেন? দাদুকে একবার বললেই…”|
কথাটা শেষ হলো না, এক হ্যাঁচকা টানে, মীরাকে কাছে টেনে নিল অর্ক, অর্ক-র এই ঔদ্ধত্য, পাগলামো দেখে একটু হলেও মীরা দুর্বল হয়ে গেছিল ওর প্রতি | তাই আজও মীরা কোন বাধা দিল না | মীরার মুখটা কাছে টেনে অর্ক বলল,”আমি অর্ক, গণপতি দাদুর সাথে দেখা করেই বাড়ি যাচ্ছি, আর আমি কাউকে ভয় পাই না, অন্তত ভালবাসলে তো না-ই |”, বলে মীরার বাঁধা চুলটা খুলে দিয়ে অর্ক বলল, “এভাবে বেশি ভাল লাগছে |”
চলে গেল অর্ক | হাঁ করে ওর চলে যাওয়া দেখছিল মীরা, অর্ক এত বড় হয়ে গেছে, শুনেছি ডাক্তারও হয়ে গেছে | অর্কর বাহুডোরে আবদ্ধ মীরা এখন মুক্ত, তাও যেন আবার, বারবার এভাবেই অর্কর কাছে নতি স্বীকার করতে ইচ্ছে করছে | খুলে দেওয়া চুলটার মধ্যে যেন অর্কর ছোঁয়া মিশে আছে | মুগধ হয়ে তাকিয়ে রইল মীরা, কতক্ষন এভাবে তাকিয়েছিল জানে না, অর্কর অবলীলায় নিজের ভালবাসার কথাটা বলে দেওয়ার পর থেকে শুধু নিজেকে খুব স্পেশাল মনে হচ্ছিল ওর | মনে হচ্ছিল এই সুন্দর মুহূর্তটা এখানেই থমকে থাকুক |
||৩||
(বেশ কিছুদিন পর)
-“অর্ক প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো, এক্ষুনি বাড়িতে জানানোটা ঠিক না, আর বাড়িতে অশান্তি হবে |”
মীরাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই অর্ক বলল,”কেন হবে অশান্তিটা? আর অশান্তি হবেই যখন, আজই হোক, কাল করে লাভ কী?”
একরোখা অর্ককে সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে মীরা, ফোনে যতটা সম্ভব শান্তভাবে মীরা বলল,”দেখ, তুমি অবুঝের মতো কথা বলছো, আস্তে আস্তে বলব বাড়িতে, নয়তো মানবে না আমাদের সম্পর্কটা |”
-“না মানার কী আছে? আমি লেবারের ছেলে বলে? আচ্ছা আমার যোগ্যতা কী কিছু কম? তাহলে? নাকী তুমিই আমার কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছ? কোনটা?”
-“অর্ক তুমি এভাবে কেন কথা বলছ? তুমি তো কথা দিয়েছিলে কখনো আমার চোখের জলের কারণ হবে না, তবে আজ এরকম কেন?”
-“এখন আমার সবটাই খারাপ তাই তো? তুমি না জানালে আমিই জানাব বাড়িতে, রাখো, আমার এখন ও.টি আছে |”, বলেই ফোনটা রেখে দিল |
মীরা আজ বড্ড দিশেহারা, অর্কর এই পাগলামির জন্যই ও অর্ককে ভালবেসেছিল, আজ এই পাগলামোই ওকে ক্লান্ত করে তুলেছে | এত উদ্ধত, এত জেদি কেন তুমি অর্ক? একটু ভরসা নেই আমার উপর? আমি তো বলছি আমি ঠিক সময়ে জানাব, সব কিছুর একটা সঠিক সময় থাকে, এটুকু বুঝছ না? অর্কর দেওয়া ফটোফ্রেমটায় ওদের দু’জনের ফটো দেখতে দেখতে চোখের জলে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল ফ্রেমের কাঁচটা | বারবার অর্ককে ফোন করল, অর্ক ইচ্ছে করে ফোনটাও তুলছে না, কাঁদতে কাঁদতে একসময় মীরা ঘুমিয়ে গেল |
||৪||
অর্ক নিজের বাড়িতে জানানোর পর থেকেই অশান্তি চরমে উঠেছে, নিজের মনিবের বাড়ির মেয়ের সাথে সম্পর্ক কোনভাবেই সম্ভব নয় একথা জানিয়েই দিলেন অর্কর বাবা, অর্ক যখন বলে এখন তোমার চাকরির দরকার কী, তখন গিরিশবাবু অর্কর গায়ে হাতও তোলেন | এ সম্পর্ক অসম্ভব, এই টুকুই বলে চলে গেলেন গিরিশবাবু | রাগে, অপমানে গা মাথা জ্বলছিল অর্কর, কী দরকার ছিল তাহলে ওকে ডাক্তারী পড়ানোর? খামতিটা তো সেই রয়েই গেল |
বারবার ফোন করছে মীরা, ধরল না অর্ক, মীরাও তো ওকে অপমানই করেছে, ওর একটাই দোষ, ও লেবারের ছেলে, ওর যোগ্যতাটা কেউ একবার দেখল না? না খেয়েই সে রাত্রে শুয়ে পড়ল অর্ক |
***************
সকালে উঠে মেসেজ দেখল মীরার, অসংখ্য মিসড কল সাথে | লিখেছে বাড়িতে অলরেডি সন্দেহ করছে, তাই অশান্তিও হয়েছে, এখন যেন অর্ক একটু ধৈর্য্য ধরে, মাথা ঠান্ডা রাখে | আপাতত পিসির মেয়ের আশীর্বাদ, তাই শিলিগুড়ি যাবে, তার আগে যেন একবার দেখা করে | পড়েই ফোনটা খাটে ছুঁড়ে ফেলে দিল অর্ক |
দেখা তো করবোই না, ফোনও করব না, উত্তরও না, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নার্সিং হোমে বেরিয়ে গেল অর্ক |
***************
প্রায় বার কুড়ি ফোনের পর অর্ক ফোনটা ধরল মীরার | ধরতেই মীরার কান্নার আওয়াজ, “কেন এরকম করছো? আমি তো করিনি কিছু..|”
মীরা কাঁদলে অর্কর মাথার ঠিক থাকে না, অর্ক নিজেকে সামলে মীরাকে শান্ত করল | কিন্তু কিছুতেই নিজের অপমানটা ভুলতে পারছে না, বারবার লেবারের ছেলে বলে যে ব্যবহার আর অশান্তি ও সইছে, সেটার জন্যই আরো মাথাটা গরম হচ্ছে, তাই বেশিক্ষণ কথা বলতেও পারল না | দেখা করতে পারবে না জানিয়ে দিল | অপর প্রান্তে মীরা তখন বড্ড কষ্ট পাচ্ছে, ওর তো কোন দোষ নেই, ওকে কেন দূরে সরিয়ে দিচ্ছে অর্ক? একবার দেখাও করল না |
||৫||
বেরোবার আগে এসএমএস করে রওনা হলো মীরারা, অর্ক অ্যাজ ইউজুয়াল রিপ্লাই করল না, নিজেকে কাজে ডুবিয়ে রাখল | কোথাও হয়তো বুঝতে পারছে যে ও ভুল করছে মীরার সাথে, ও তো কিছু করেনি, কিন্তু তাও খুব রাগ হচ্ছে অর্কর |
***************
মীরা যাওয়ার পর থেকে গুড মর্নিং, গুড নাইট এসএমএস ছাড়া আর কোন বাক্যালাপ নেই আপাতত, অর্ক একটিও রিপ্লাই করেনি | সকালে অর্ক নার্সিং হোমে চলে গেল, এখন ও.টি আছে একটা, তার আগে নিজের মনটা শান্ত রাখা খুব জরুরি | অ্যাক্সিডেন্ট কেস, অর্ক যথাসম্ভব নিজেকে ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করলো, ফোন সুইচ অফ আছেই |
….উফফ, কিছুতেই কনসেনট্রেট করতে পারছে না অর্ক, এরকম তো কখনো হয়নি | বারবার মীরার কথা মনে পড়ছে, এখনই মীরার সাথে কথা বলতে হবে, এক্ষুনি | অপারেশন টেবিলে বারবার ভুল করছিল অর্ক, অর্ক যথেষ্ট নিপুন হাতে সবটা সামলায় সবদিন, আজ ওকে এভাবে দেখে বাকি ডাক্তার, নার্সরাও অবাক |
পারল না অর্ক, বেরিয়ে এল, জানে নিজের প্রফেশনাল এথিক্স-এর সাথে অন্যায় করল এটা | কিন্তু নিজেকে সামলাতে পারল কই?
***************
বেরিয়ে ফোন অন করল অর্ক, এক্ষুনি মীরাকে ফোন করতে হবে, কতদিন ভাল ভাবে গলাটা শোনেনি ওর, বেকার কত কাঁদল, আর কাঁদাল ও | এক্ষুনি ওকে বলতে হবে ওকে কতটা ভালবাসে অর্ক | মীরার এসএমএস দেখলো,”আই লাভ ইউ “, লেখা | কাল রাত্রের পাঠানো, অর্ক এই দেখল | ফোন লাগল মীরাকে, বারবার আন অ্যাভেলেবেল, সুইচ অফ, এই সব বলছে | বড্ড অস্থির লাগছে ওর | প্লিজ মীরা, এবার তুমি অন্তত রাগ করো না, ক্ষমা করে দাও আমায় | ফোনটা ইচ্ছে করে অফ করে দিয়েছ বলো? লক্ষীটি রাগ করো না, ফোন তোলো, মনে মনে আপ্রাণ ডাকতে লাগল অর্ক মীরাকে | বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল |
***************
কিছুক্ষন পর, নার্স এসে খবর দিল, “সরি স্যার, পেশেন্ট মারা গেছেন |” ইসস অর্ক আজ এ কী করলো, নিজের পার্সোনাল প্রব্লেমের জন্য এভাবে নিজের কাজে গাফিলতি করলো, ক্ষমার অযোগ্য এটা, এখন অর্ক ওদের বাড়ির লোককে কী জবাব দেবে? এত বড় ফেলিওর-এর সম্মুখীন ও কোনদিন হয়নি | আজ ও থাকলে হয়তো বাঁচাতেও পারত | মুখটা ঢেকে মাথা নীচু করে নিজের চেম্বারে বসে রইল অর্ক |
||৬||
পুরো একটা দিন কেটে গেছে, মীরার ফোন এখনও অফ, কী আশ্চর্য, এবার অর্কর খুব রাগ হচ্ছে আবার, ওর তো টেনশন হয় নাকী?
***************
খেতে বসে আগের দিনের পেপারটা ওল্টাতে ওল্টাতে দেখল শিলিগুড়ি থেকে কলকাতা গামী বাসের বিশাল অ্যাক্সিডেন্ট | অর্ক নিজেকে নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে এত বড় একটা খবর খেয়ালই করেনি, এবার অসম্ভব টেনশন হচ্ছে অর্কর | মীরার কিছু হয়নি তো? ও ঠিক আছে তো? টেনশনে এবার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে ওর, এখনও ফোন অফ, এবার কী করবে অর্ক?
নার্সিং হোমে পৌঁছাল অর্ক, নিজের কেবিনে যাচ্ছিল, পাশ থেকে শুনলো, “হ্যাঁ বাস অ্যাক্সিডেন্টের কেসটায় অনেকগুলো বডি আন আইডেন্টিফায়েড, কেউ নিতেও আসেনি,…”, এইটুকু শুনেই অর্কর মাথাটায় এক সেকেন্ডের মধ্যে যেন কারেন্ট খেলে গেল |
-“সিস্টার, বাস অ্যাক্সিডেন্টটা কোথাকার?”
-“স্যার, শিলিগুড়ি টু কলকাতা |”
…একটা তীব্র ঝাঁকুনি লাগল যেন অর্কর, পায়ের তলার মাটি সরে যেতে লাগল ওর |
-“আমায় লিস্ট আর বডিগুলো কোথায় আছে দেখান |”
-“কিন্তু স্যার, ওগুলো হঠাৎ…|”
-“যা বলছি, তাই করুন |”
-“ওকে স্যার, আপনি আমার সঙ্গে আসুন |”
সিস্টারের সাথে দ্রুত পায়ে মর্গে গেল অর্ক, উফফ যা ভাবছি তা যেন সত্যি না হয় |
সিস্টার, মর্গের কর্মচারীদের এক এক করে ঐ একসিডেন্টের বডিগুলো দেখাতে বলল | সব বিকৃত মৃত মানুষের শবদেহ গুলো দেখতে দেখতে গুলিয়ে উঠছিলো অর্কর, কিন্তু শান্তিও হচ্ছিল, মীরা ঠিক আছে তাহলে নিশ্চয়…|
-“স্যার, বেশির ভাগ বডিই স্পট ডেড ছিল, এনার অপেরেশনটাই আপনি করেছিলেন, যিনি তখনও বেঁচে ছিলেন, পরে মারা যান, বলেই কাপড়টা সরিয়ে দিল কর্মচারীটি |
…….কিছুক্ষনের নিস্তব্ধতা, চারপাশটা থমকে গেছে, বড্ড ভারী বাতাস, অর্ক যেন নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না, সামনে পড়ে রয়েছে মীরা, ওর মীরা, সেদিনের অপেরেশনের সময় সত্যিই পেশেন্টের মুখটা একবারও দেখেনি অর্ক | নিজের মীরাকেই বাঁচাতে পারেনি ও? এত বড় হারের সম্মুখীন হবে এ তো কল্পনাও করেনি ও, এই ও ডাক্তার? নিজের হাতে, নিজের গাফিলতিতে মীরাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল সেদিন ও, খুনের থেকে কম কিছু কী এটা? নিজের হাতটা দেখে শিউরে উঠল একবার, চিৎকার করার ক্ষমতা টুকুও নেই, জ্ঞান হারাল অর্ক |
****************
“তোমার সাথে তো শেষ বারের মতো দেখাও করিনি, কথা বলিনি, বাঁচানোর সুযোগটা পেয়েও শেষ করেছি, আমি তো খুনী, আমায় কী তুমি করবে ক্ষমা? আমি নাকী ডাক্তার, হি হি | এত বড় হার, এত বড় ব্যর্থতা কারও থাকে নাকী?” এই কথাগুলো বিড়বিড় করতে করতেই নিজের হাতদুটো দেখছে অর্ক, সম্পূর্ণ মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত, এখন চিকিৎসাধীন | নিজেকে মীরার খুনী মনে করে |