H2SO4

h2so4_muktodhara story image

h2so4_muktodhara story image

||১||

আজকের গল্প এক রাজা ও রাণীর | না, যেরকম রাজা রানীর গল্প ভাবছেন, তা নয় | এ রাজা, রাণী আমাদের সমাজেরই একজন, যারা নিজগুণে আজকের রাজা ও রাণী |

বাস্তবকে তো অনেক দেখলাম, একটু নাহয় কল্পনাকে দেখি আজ? হতেও পারে, যদি এটাই কোনদিন বাস্তব হয়ে ওঠে |

****************

“রাজা, ওঠ, কলেজের দেরী হয়ে যাবে | রোজ এই তাড়াহুড়ো, আর ভালো লাগে না, ওঠ বাবা |”- একমাত্র ছেলে রাজাকে ঘুম থেকে রোজকার মতো জাগানোর চেষ্টা চলছে রমা দেবীর | রাজা, রমা চৌধুরী ও প্রকাশ চৌধুরীর একমাত্র সন্তান, চৌধুরী ইন্ডাসট্রিজ -এর হবু একচ্ছত্র অধিপতি |

গোল খাটে শুয়ে রাজা ঘুমের ঘরে বলে উঠল,”প্লিজ রাণী, এরকম করো না, এত তাড়াতাড়ি কেন যাচ্ছ?”; জানলার দামী পর্দা সরাতে সরাতে ছেলের এহেন ঘুমের ঘোরের প্রেমালাপ শুনে চমকে উঠলেন রমাদেবী | ছেলের মুখের কাছে কানটা নিয়ে গিয়ে ভাল করে শুনলেন, “আরে কত দেখবে আর ওজোনোলিসিস-এর মেকানিজম, আমার দিকেও তো একটু তাকাও, কি গো?”

রমাদেবী ছেলের কান্ড-কারখানায় বুঝলেন, এই ছেলে নির্ঘাত প্রেমে পড়েছে | “দাঁড়া, দেখাচ্ছি তোর মজা”, এই বলে ছেলের চুলের মুঠিটা বেশ করে ধরে ঘুমটা ভাঙালেন |

“আহ! মা, কি করছো টা কী? একটু শান্তিতে ঘুমাতেও দেবে না?” মাথা চুলকাতে চুলকাতে রাজা বলল |

-“ঘুমোচ্ছ, নাকী ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে প্রেম করছ, কোনটা? রাণীটা কে?”

মা-এর এহেন অকস্মাৎ এইধরনের প্রশ্ন শুনে রাজা যারপরনাই অবাক হয়ে গেল, “মা রাণীর কথা জানলো কী করে?” বিড়বিড় করতে করতেই রমাদেবী এবার ছেলের কান ধরলেন, “বলবি কীনা? না বুড়ো বয়সে মার খাবি?”

“বলছি, বলছি, আহ, ছাড়ো মা, লাগছে তো”, বলে কানে হাত বোলাতে বোলাতে রাজা বলল,”রুক্মিণী, মানে রাণী আমার সাথে organic chemistry-র টিউশনে পড়ে, ডাকনাম রাণী |”

“তারপর?”- রমা দেবী |

“তারপর আবার কী?”-রাজা |

“তা সেই রুক্মিণী, রাণী যাই হোক, সে তোমার স্বপ্নে কী করছে?”-রমাদেবী |

রাজা ভাবল,’মা ওর স্বপ্নের কথা বুঝলো কী করে?’ আমতা আমতা করে বলল, “না মানে, ইয়ে, মানে, রাণীকে তোমার, রাণীকে তোমার …”

রমাদেবী কিল মারলেন,”বলবি কী?”

“রাণীকে তোমার বৌমা বানাবো ভেবেছি”, এক নিশ্বাসে বলে দম নিল রাজা |

রমাদেবী মিচকি হেসে বললেন,”নিজের মাকে বলতে এত লজ্জা?”

মা-এর কথা শুনে রাজার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল, তার মানে মা সব সময়ের মতো রাজার পাশেই আছে | রমাদেবী ছেলের থেকে শুনে জানতে পারলেন, রাণীর প্রেমে রাজা বহুদিন ধরেই হাবুডুবু খাচ্ছে, কিন্তু এখনো অবধি বলার সাহস জোটাতে পারেনি | রাণী পাশের পাড়ায়-ই থাকে, বছর দেড়েক হলো ভাড়া নিয়ে এসেছে |

||২||

আজ রাজার মনটা খুশি খুশি, মা পাশে আছে, এটা জানার পরই মনটা খুব শান্ত লাগছে | এবার সব কিছু খুব সহজ মনে হচ্ছে | বাইক নিয়ে কলেজে ঢুকলো রাজা |

****************

আজ অর্গানিক স্যার এক্সট্রা ক্লাস নেবেন, মানে আজ একটু বেশিক্ষন ধরে রাণীকে দেখা যাবে, ভেবেই আনন্দে মনটা নেচে উঠল রাজার | আর দেরী করবে না রাজা, অনেকদিন হলো, এবার বলতেই হবে | ওর বিশ্বাস রাণীও ওকে ভালবাসে, না বলবে না |

****************

-“রুক্মিণী সেন, রোল নাম্বার 5 ….রোল নাম্বার 5?”

“ইয়েস ম্যাম, রোল নাম্বার 5 |” উঠে দাঁড়িয়ে অন্যমনস্ক রুক্মিণী উত্তর দেয় |

ম্যাম বিরক্ত হয়ে বললেন, “মনটা কোথায় থাকে হ্যাঁ? বসো |”

রাণীর মন এখন প্রজাপতির মতো ওড়ে  রাজা ছেলেটার জন্য, কী মিষ্টি আর ইনোসেন্ট টাইপ | হাঁ করে তাকিয়ে থাকে, ভেবেই হেসে ফেলে রাণী | অর্গানিক টিউশনে মন বসাতে রীতিমত এফোর্ট দিতে হয় রাণীকে | সেই কবে থেকে ছেলেটার জন্য রাণীও ফিল করে, কিন্তু সে ছেলে এমন লাজুক না তো কথা বলে না কিছু | রাণী ওর মনের কথা আজ অবধি তাই বোঝাতেও পারেনি ছেলেটাকে |

****************

কলেজ  শেষ করে টিউশন-ও আছে আজ | রাণী আর ওর বান্ধবীরা একসাথেই যায় পড়তে, কিন্তু আজ নেহা আর শ্রেয়া দুজনই অ্যাবসেন্ট | অগত্যা একাই হাঁটা লাগল | হাঁটতে হাঁটতে অন্যমনস্ক ছিল রাণী | দিনের বেশির ভাগ সময় এখন ওর কাটে কল্পনার জগতে, রাজাকে নিয়ে | রাজা কী আদৌ বোঝে রাণীর মনের অবস্থাটা?

হঠাৎ-ই পিছন থেকে জোরে বাইকের আওয়াজ, রাজাও বাইকেই পড়তে আসে, সেই ভেবেই রাণী শব্দ পেয়ে পিছনে ফিরে তাকাল, “হে ভগবান আবার সেই মাস্তান গুণ্ডাটা ধাওয়া করছে | তাকে বেশ কিছুদিন ধরেই বিরক্ত করছে এই গুণ্ডাটা | এতদিন সেটা ফোনে সীমাবদ্ধ ছিল, এখন রাস্তাতেও শুরু হলো মনে হয় |

রাকেশ নাম হলেও কেটে ছেটে সেটা রকি মস্তান হয়ে গেছে | এর জ্বালায় পাড়ায় থাকা দায় | প্রথম প্রথম পাত্তা দিত না রাণী, কিন্তু এখন বড্ড বাড়াবাড়ি শুরু করেছে |

“কী জানেমন ! আমার অ্যানসারটা তো এখনো পেলাম না |” বলেই রাণীর মুখের সামনে বাইক থামাল রকি | এবার একটা ব্যবস্থা করতেই হবে, নয়তো এই বাড়াবাড়ি আরও চলবে |

“কবে থেকে তোমার পথ চেয়ে বসে আছে , মামণি এস, বাইকে চলে এস | ওসব পড়ে তড়ে কি হবে, দু’দিন বাদে তো আমারই বৌ হবে |”- এই বলে রকি রাণীর হাত ধরে টান দিল | রাস্তায় ঐ মুহূর্তে তেমন লোকজন ছিল না, তাই রাণী জানত যা করার ওকেই করতে হবে | নিজের হাতের ভারী ব্যাগটা নিয়ে নিজের ক্যারাটে জানা দক্ষ হাতে সজোরে মারে রাণী, ছিটকে বাইক থেকে পড়ে যায় মস্তান |

“একদম আর বিরক্ত করার সাহস দেখাবি না, অনেকদিন ধরে সহ্য  করছি |” এই বলে রুদ্রমূর্তিতে রাণী এগিয়ে চলে যায় |

রকি মস্তান ভাবতে পারেনি এরকম কিছু একটা হবে | “এই ঘটনার জের আমি তুলব শালী” বিড়বিড় করে বলল রকি |

||৩||

আজ একদম রেডি হয়ে এসেছে রাজা, আজ বলবেই রাণীকে ওর মনের কথা | রাণী উল্টো দিকের রাস্তা থেকে পার হয়ে এলেই বলবে, কিছুক্ষন অপেক্ষার পরই দেখল, ওর রাণী সাদা সালোয়ারে অপরূপা হয়ে আসছে এদিকে | রাণীকে দেখলেই যেন সব কেমন ওলট পালট হয়ে যায় ওর | কত কি বলবে বলে ভাবে, কিন্তু বলতে আর পারে না | কিন্তু আজ আর না, মা-ও বলেছে, এবার বলে দিতে | মা যখন সাথে আছে তখন কিসের ভয়? হাতের গোলাপের  তোড়াটা পিছন দিকে লুকিয়ে রাখল |

উফফ, এত গাড়ি আসছে যে পারও হতে পারছে না রাস্তাটা | আর তর সইছে না যেন |

হঠাৎ রাজা দেখল বাইকে করে কয়েকটা ছেলে রাণীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে | বড় বড় লরিগুলো যাওয়ার জন্য ঢাকা পড়ে যাওয়ায়, ভাল ভাবে দেখতে পেল না রাজা | সিগন্যাল থামছেও না যে এক্ষুনি রাস্তাটা পার হয়ে যাবে | আবার একটা বড় লরি এল, কয়েক সেকেন্ডের জন্য ওপারের রাস্তাটা রাজার দৃষ্টির আড়ালে গেছিল |

হঠাৎ একটা বীভৎস চিৎকার | সিগন্যাল পড়তেই রাজা ছুটল ওপারে | বাইক চালাচ্ছিল যে ছেলেটা সে রাস্তায় পড়ে কাতরাচ্ছে, আর সাথে ওর রাণীও | রাজার মাথায় কিছুই ঢুকল না | সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতাল ছুটল রাজা |

||৪||

“ডাক্তারবাবু কেমন আছে এখন রাণী?” উদ্বিগ্ন রাজা তখন থেকে হাসপাতালেই, মাকে খবর দিয়েছে | মা, বাবা দুজনেই এসেছে যদিও |

“দেখুন খুব বেশী কিছু ক্ষতি হয়নি মেয়েটির, ওর নিজের বুদ্ধিমত্তার জন্য | তবে যে মেল পেসেন্ট, তার মুখটা পুরোই জ্বলে গেছে | আমরা পুলিশে খবর দিয়ে দিয়েছি, এক্সকিউজমি | “

***************

রকি রাগে অন্ধ হয়ে রাণীর মুখে অ্যাসিড ছুড়তেই এসেছিল, কিন্তু ওই মুহূর্তে রাণী অসম্ভব বুদ্ধিমত্তা আর দক্ষ ক্যারাটের সাহায্যে রকির কনুই-এ আঘাত করে | তাই খানিকটা অ্যাসিড রাণীর বাম গালে পড়লেও পুরোটা পড়েনি, বাকি অ্যাসিড টা হাত ঘুরে পড়ে যায় রকির নিজের মুখেই |

পুলিশ এসে বাকি ব্যবস্থা নিছে | মিঃ প্রকাশ চৌধুরী, মানে রাজার বাবা সবটা সামলে নেবেন রাজা নিশ্চিত | রাণীর আর কোন ক্ষতি হবে না ও জানে |

রাণীর সাথে এখনো দেখা করতে দিচ্ছে না | রাণীর বাড়ির লোকও অপেক্ষা করছে | রাজা মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিল, ভাবছিল,’মা আর কি রাণীকে মেনে নেবে বৌ হিসাবে? যতোই সমাজ এগোক, একটা পোড়া মুখকে কজনই বা সমাদর করে?’

হঠাৎ পিছন থেকে মা বলল,”ওসব ভাবনা মাথাতেও আনবি না, রাণীর মতো ক্যারাটে জানা বৌমাই ঠিক , তোকে বাগে রাখতে পারবে | যে কাজটা করিসনি করে না এবার | আর তোর মা তোকে এত খারাপ শিক্ষা দেয়নি যে একটা পোড়া চামড়ার কাছে তোর ভালবাসা হেরে যাবে ? হেরে যাবে তোর এতদিনের প্রতীক্ষা | এত ছোট মন আমার তো নয়, আমার ছেলেরও নয়, আমি জানি |”

আবারও মাকে পাশে পেল রাজা |

(বেশ কিছুদিন পর)

“অনেক দেরি হয়ে গেছে রাজা, একদিন তোরই মনে হবে তুই ভুল করেছিলি | এটা আর হয় না, আমার একদিকের মুখ তোকে ভালবাসতে বলবে, আর একদিক বলবে ঘৃণা করতে | তুই প্লিজ চলে যা |”

রাজা জোরে রাণীর হাতটা চেপে ধরল,”আমি তোকে ছেড়ে কোথাও যাব না | রসায়নের এত ক্ষমতা হয়নি, যে সামান্য সালফিউরিক অ্যাসিড আমাদের প্রেমে বাধা হয়ে দাঁড়াবে, বুঝলি ? তুই যেমন, তোকে সেভাবেই চাই, ব্যস | কিন্তু তোকেই চাই | তোর মনকে ভালোবাসি, উপরের চামড়াটা নয় |”

রাণী লজ্জায় মাথা নামালো, আর কে না জানে, মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ |

****************

গল্পটা অন্যও হতে পারত, যদি রাণী ক্যারাটে টা না জানত | যেটা রোজ খবরের পাতায় দেখি আমরা | কিন্তু রাজার মতো কজনই বা আছে? এরকম মানুষ থাকলে কিছুটা হলেও হয়তো অনেক রাণী আবার ভালবাসতে পারবে, সুখী হতে পারবে আর পাঁচটা মেয়ের মতো |

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with ❤

এরকম আরো কিছু গল্প

মুক্তি

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেল, আকাশ তখন থেকে ঠায় বসেই রয়েছে ঘাটে। এখন বাঁধানো ঘাট থেকে করিডোর হয়ে বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরে পুজো দেওয়া অনেকটা সহজ

Read More »

বন্ধু হবি চল

বাক্সপেটরা নিয়ে স্টেশনেই বসে ছিল নয়না, বৃষ্টি পড়েই চলেছে, মুষলধারায়। বাবা বলল আরেকটু অপেক্ষা করতে, এত বৃষ্টিতে তো ছাতাও হার মানবে, আর বেরিয়ে রাস্তাও অজানা

Read More »

টিফিনবাক্স

প্রতিবারের মতন এই বছর ও সমস্ত সরঞ্জাম গুছিয়ে বেরোনোর জন্য ব্যস্ত অমিত, অন্তত সন্ধ্যার মধ্যে বেরোতে না পারলে খুব মুশকিল। পুজোর দিকটা কতদূর কি হলো

Read More »

ক্লিক

।।১।। -“মালিনী, কালকের মিটিংটা কখন ফিক্স করেছ? -“ম্যাম, সকাল ১১টা।” -“ওকে, কনফার্মেশন পেয়ে গেছ?” -“ইয়েস ম্যাম।” -“ওকে গুড। আর।।। এক মিনিট।।।” টেবিল থেকে ফোনটা তুলে

Read More »

শিক্ষা

।।১।। দাপুটে, বদরাগী, মেজাজি এই সব কটা বিশেষণই বেশ ভালো যায় মিসেস বোসের সাথে। রেণুকা বোস আর অমরনাথ বোস সানফ্লাওয়ার এপার্টমেন্টে ১২০০ স্কোয়ারফিটের ফ্ল্যাট 2c

Read More »

বিদায়

।। ১।। রীতিমত জোর করেই নন্দিনীকে পাহাড়ে নিয়ে এলো সঙ্গীতারা। আসার ইচ্ছে তো ছিল না ওর একদমই, শরীর সাথ দিলেও মনটা কোনোভাবেই সাথ দিচ্ছে না।

Read More »

Share with ❤