সবকিছুর ঊর্ধ্বে

চোখে ভোরের কাঁচা রোদটা পড়তেই ঘুমটা ভেঙে গেল, সচরাচর ঘুম ভেঙে না এত ভোরে । এত ভোরে উঠে করবটাই বা কী ? মন মেজাজটা ভালও নেই। গানটা নিয়ে খুব স্ট্রাগল করতে হচ্ছে, মৌমিতার সাথেও….। ধ্যুর, আবার ঐ চিন্তা মাথায় এসেই গেল ,

উঠে বসলাম খাটে, মাথাটা খুব হালকা লাগছে, একটু বেটার ফিল হলো । জানলার বাইরে দুটো পায়রা বসে বকবকম করছে । অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলাম, খুব মনে পড়ছিল পুরোনো দিনগুলোর কথা, আমাদের প্রেমের প্রথম দিককার কথা । তখন তো তুই এই গান পাগল ছেলেটাকেই ভালবেসেছিলি, এরকম অগোছালো ছেলেটারই প্রেমে পড়েছিলি, তবে আজ কেন হাত ছাড়লি? হাত ছাড়বিই তো ধরলি কেন? তোর বাবার পছন্দ মতো সরকারী চাকুরে জামাই আমি কোন দিনই হতে পারব না সেটা জেনেই তো এগিয়েছিলি ।

চোখটা বন্ধ করে নিলাম । আর পারছি না ভাবতে, সেই কবে থেকে তোকে ভালোবেসেছি, ভালবাসা কী বুঝেছি তোকে ভালোবেসেই । এভাবে আমায় ছেড়ে কিভাবে চলে যেতে প্যারিস তুই? না, এ কিছুতেই আমি হতে দেব না ।

আবার মনের মধ্যে জেদটা চেপেই গেল । গান করি তাতে কী খারাপ রে? অ্যালবাম বেরোবে, স্টেজ শো করি, প্লে ব্যাক সিংগিং আমার স্বপ্ন, তোরও তো তাই ছিল জানতাম, যে আমি যেন আমার স্বপ্নকে ছুঁতে পারি । হঠাৎ তবে কী হলো? বাবাই সব? আমি কী কেউ নয়?

আর পারছিলাম না ভাবতে, একটু ফ্রেশ হতে হবে, উঠে পড়লাম । ঠান্ডা জলের ধারাও যেন আমায় আজ শান্ত করতে পারছে না । কী ভীষণ এক অস্থিরতা ভিতরে । ভালবাসার খাতিরেই গানটাকে কিছুটা হলেও অবহেলা করে চাকরি খুজছিলাম হন্যে হয়ে, কী করে পারলি?

****************

বাইরে বেলা বাড়ছে, ভাবলাম একবার দেখা করে আসি । যা কপালে আছে হবে, শেষ চেষ্টা এই সম্পর্কটাকে বাঁচানোর আমায় করতেই হবে, তারপরে অন্য কিছু । ঘরের দরজা খুলে দেখি মা তখন সবে রান্নাঘরে চায়ের জল চাপিয়েছে । মা কে “আসছি” বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই বেরিয়ে পড়লাম । আমার বাড়ি থেকে মৌমিতার বাড়ি হেঁটেও যাওয়া যায়, অটো বা বাসেও যাওয়া যায়, আজ কেন জানি না হেঁটে যেতে ইচ্ছে হলো । সেই রাস্তাগুলোর সুবাস নিতে ইচ্ছে হলো যেখানে আমাদের ভালোবাসার পুরোনো গন্ধ মিশে আছে । হাঁটতে লাগলাম সেই চিরপরিচিত পথ ধরে ।

বাড়ির সামনে ব্যস্ততা, লোকজন । আজ তো ওর আশীর্বাদ, এসবের জন্যই তো আমায় ছাড়লো । এত লোভ তোর? সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, টাকা এত ইম্পরট্যান্ট ভালবাসার থেকে? রাগে দুঃখে অসহ্য লাগছিল নিজেকে, নিজের বোকামোর জন্যই আজ এই দশা । ওর বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম । ব্যস্ততার কারণে সদর দরজা খোলাই ছিল, ঢুকে পড়লাম । ওর ঘর আমি ভালোই চিনি । কিন্তু মাঝপথে কেউ পথ আটকালে আজ রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে, মনে মনে ঠিক করে নিলাম, আজ ওকে আমার প্রশ্নগুলোর জবাব দিতেই হবে । প্রশ্নের উত্তরগুলো পেলেই আমি চলে যাব এখন থেকে ।

****************

ওর পরিবারের আমার বংশ পরিচয় নিয়েও অনেক সমস্যা । ওরা ব্রাহ্মণ আর আমরা ব্রাহ্মণ নই যে, কিন্তু তুই তো সব জেনে এগিয়েছিলি ।

হাজারো অন্তর্দ্বন্দ্বের বেড়া ডিঙিয়ে আমি ওর ঘরের কাছে পৌঁছেই গেলাম ? সবার আলেখ্যে, ধীর পায়ে এগোতে লাগলাম ওর ঘরের দিকে, এদিকটায় কেউ নেই এখন আপাতত । ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ । ঘরে নক করতে যেতেই চোখ পড়ল জানলায় । বন্ধ জানলার ওপাশে পর্দাটা ঘরের হাওয়ায় উড়ছে, আর তাতেই দেখলাম সেই দৃশ্য ।

মৌমিতার গলায় ফাঁস, সিলিং থেকে ঝুলন্ত দেহটায় তখনও প্রাণ আছে, ঝটপটি খাচ্ছে শরীরটা । প্রাণপনে চিৎকার করতে লাগলাম, ডাকতে লাগলাম সবাইকে, পরক্ষনেই বুঝলাম দরজাটা ভেঙে আগে ওকে বাঁচাতে হবে, ওটা সবার আগে করা দরকার, হা ঈশ্বর! এই জন্যই মৌমিতা বলত, তোমায় ছাড়া আর কাউকে এই জীবন থাকতে ভালবাসতে পারব না, আজ বুঝছি কতটা সত্যি ছিল কথাগুলো । খুব অসহায় আর অপরাধী লাগছিল নিজেকে । গায়ে যত শক্তি ছিল প্রাণপনে দিলাম ধাক্কা দরজায় । আমার মৌমিতাকে যে করেই হোক আমায় বাঁচাতেই হবে, আর কেউ আমাদের আলাদা করতে পারবে না । আমি লজ্জিত যে এরকম একজন মানুষকে আমি সন্দেহ করেছিলাম, ও ঠিক আমায় ক্ষমা করে দেবে ।

ধাক্কাটা দরজায় দিতেই সজোরে পড়লাম মেঝেতে, দরজাটা কি ভেজানোই ছিল? চোখ মেলে তাকাতেই দেখলাম বিছানার উপর সিলিং থেকে ঝুলন্ত মৌমিতার দেহটা ততক্ষণে স্থির হয়ে গেছে ।

হতভম্বের মতন বসে রইলাম খানিক্ষন । এটা কি হলো? এরকম তো হওয়ার কথা ছিল না, আমরা তো ভালবেসে এক হতে চেয়েছিলাম । কিছুক্ষণের মধ্যেই বাইরের লোকজনের গলার আওয়াজ কানে এল । ঘর ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকাতেই হোঁচট খেলাম । দরজাটা তো ছিটকিনি দিয়ে আটকানো । তার মানে? আমি যে এক্ষুনি ঘরে দরজা ঠেলে ঢুকলাম । অনেক কিছু একসাথে মাথার মধ্যে জট পাকাতে লাগল । মনে হচ্ছিল কেউ মাথায় হাতুড়ি পিটছে, দরদর করে ঘামছিলাম অজানা আশঙ্কায়, সামনে মৌমিতার ঝুলন্ত দেহ । আর কিছু ভাবতে পারছিলাম না, উঠে দাঁড়ালাম আস্তে আস্তে । আয়নায় চোখ পড়তেই আঁতকে উঠলাম….

কোন প্রতিচ্ছবি ছিল না আয়নায় । কাল রাত্রে ড্রাগের ডোজটা বেশীই হয়ে গেছিলা । আস্তে আস্তে সব মনে পড়ল, তার মানে আমিও….

এবার আর কেউ আমাদের আলাদা করতে পারবে না । আমি আর তুমি….. সবকিছুর ঊর্ধ্বে ।

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

মুক্তি

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেল, আকাশ তখন থেকে ঠায় বসেই রয়েছে ঘাটে। এখন বাঁধানো ঘাট থেকে করিডোর হয়ে বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরে পুজো দেওয়া অনেকটা সহজ

Read More »

বন্ধু হবি চল

বাক্সপেটরা নিয়ে স্টেশনেই বসে ছিল নয়না, বৃষ্টি পড়েই চলেছে, মুষলধারায়। বাবা বলল আরেকটু অপেক্ষা করতে, এত বৃষ্টিতে তো ছাতাও হার মানবে, আর বেরিয়ে রাস্তাও অজানা

Read More »

ক্লিক

।।১।। -“মালিনী, কালকের মিটিংটা কখন ফিক্স করেছ? -“ম্যাম, সকাল ১১টা।” -“ওকে, কনফার্মেশন পেয়ে গেছ?” -“ইয়েস ম্যাম।” -“ওকে গুড। আর।।। এক মিনিট।।।” টেবিল থেকে ফোনটা তুলে

Read More »

শিক্ষা

।।১।। দাপুটে, বদরাগী, মেজাজি এই সব কটা বিশেষণই বেশ ভালো যায় মিসেস বোসের সাথে। রেণুকা বোস আর অমরনাথ বোস সানফ্লাওয়ার এপার্টমেন্টে ১২০০ স্কোয়ারফিটের ফ্ল্যাট 2c

Read More »

বিদায়

।। ১।। রীতিমত জোর করেই নন্দিনীকে পাহাড়ে নিয়ে এলো সঙ্গীতারা। আসার ইচ্ছে তো ছিল না ওর একদমই, শরীর সাথ দিলেও মনটা কোনোভাবেই সাথ দিচ্ছে না।

Read More »

মামাবাড়ি

।।১।। একবার নিজের ঘড়িটা স্টেশনের ডিজিটাল ঘড়ির সাথে মিলিয়ে নিল মিনি, সময় তো হয়ে গেছে। উল্টো দিকের দুটো মেট্রো এসে গেল কিন্তু এদিকের মেট্রোর কোনো

Read More »

Share with