ফেরিওয়ালা

||১||

“মা, ও মা, আজ তো খুব জোরে বৃষ্টি আসবে বলো, আজ আর খেলনা কাকু আস্তে পারবে না তাই না?”

ছেলে বাবাই-এর কথা শুনে হাতের কাজ থামিয়ে একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল লিপি | লিপি, বাবাই, আর বাবাই-এর বাবা অনির্বাণ, এই নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির যুগেও সমাজকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দিব্যি জয়েন্ট ফ্যামিলি নিয়ে বহাল তবিয়তে আছে, শ্বশুর, শাশুড়ি, দেওর, ভাসুর, জা সবাইকে নিয়ে ভরা সংসার যা এখনকার যুগে সত্যিই ঈর্ষণীয়ই বটে |

ফেরা যাক আগের প্রসঙ্গে | এই ‘খেলনা কাকুর সাথে বাবাই-এর ভীষণ ভাব | ‘খেলনা কাকু’ আর কেউ না, একজন সাধারণ ফেরিওয়ালা, পারে প্লাস্টিকের জিনিসপত্র ফেরি করে বেড়ায় | প্লাস্টিকের বালতি মগ-এর সাথে সাথে প্লাস্টিকের টিয়াপাখি, স্যাপ, গাড়ি, এই সব-ও তার কাছে মজুত থাকে | সেই থেকে বাবাই বাবুর সাথে তার ভীষণ ভাব | ফেরিওয়ালা মানে নিমাই তার আসল নাম, নিমাই-ও খুব ভালবেসে ফেলেছে এই ক’দিনের ছোট্ট বাবাই বাবুকে |

স্কুল থেকে দুপুর ২টো নাগাদ মা-র সাথে বাড়ি ফেরে বাবাই, আর নিমাই-এর আসার সময় ৩টে, এখন তো কিছু কেনার থাকুক না থাকুক, একটিবার নিমাই বাবাই-এর সাথে দেখা করেই যায় | আজ মেঘলা দিনে মুষলধারায় বৃষ্টি নামল বলে, এরকম বদলা দিনে কীভাবে খেলেন কাকু আসবে সেই নিয়ে ভারী দুশ্চিন্তা বাবাই-এর |

||২||

(ক’দিন পর)

“জ্বরটা তো এখনও নামল না |” থার্মোমিটারটা অফ করে রাখতে বলল লিপি | বাইরে তখন মুষলধারে বৃষ্টি, পুরোনো বাড়ির কার্নিশে রঙ্গিন কাঁচের গায়ে বিন্দু বিন্দু জলকণাগুলো ঝোড়ো হাওয়ায় তির তির করে কাঁপছে | ছোট্ট বাবাই-এর মুখের দিকে তাকিয়েছিল লিপি, কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট, অনির্বাণ গেছে ডাক্তার আনতে, তখনই গিরিজাদেবী, মানে বাবাই-এর ঠাম্মি জলপট্টি দিতে দিতে বললেন, “তোমায় তো কদিন ধরেই বলছিলাম বৌমা, ওই নিমাই-এর চাল চলন আমার সুবিধের লাগছে না | এত কিসের দরদ বুঝি না, ঐ আমার নাতিটাকে তুকতাক করেছে….|”

-“এসব কী আজেবাজে কথা বলছ মা…” লিপিকে থামিয়ে দিয়ে শাশুড়িমা আবার যোগ করলেন, “তোমার বুদ্ধিটা একটু কম লাগাও দেখি বৌমা, এত কীসের টান আমায় বলতে পারো? ওর নজর খুব খারাপ, আমি তোমায় সাবধান করছি বৌমা, ওর নজর লেগেই এইরকম রোগে পড়ল আমার দাদুভাইটা | ওর এবাড়িতে ঢোকা বন্ধ কর তুমি |”

||৩||

“ডাক্তার তো দেখাচ্ছি-ই, কিন্তু জ্বর তো প্রায়ই আসছে, সর্দিটাও কমছে না, আমার তো খুব টেনশন হচ্ছে রে, ডাক্তার চেঞ্জ করব ভাবছি, কিন্তু ইনি এদের এবাড়ির ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান | আস্থাটাও তাই একটু বেশি, কিন্তু এভাবে আর কদিন? স্কুলটাও কামাই হচ্ছে পর পর…. ” বোন এর সাথে ফোনে কথা বলছিল লিপি | বাবাই-এর অসুস্থতা নিয়ে সবাই-ই উদ্বিগ্ন, দাদু, দিদা, ঠাম্মা সবাই |

কথার মাঝেই কানে এলো নিমাই-এর গলা | ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল ঠিক ৩টে | এই সময়টার জন্য বাবাই যেন হাঁ করে বসে থাকে | খেলনা কাকুর গলার আওয়াজ পেয়েই এই রুগ্ন শরীরেও তড়াক করে খাট থেকে নেমে দে দৌড়, সোজা দালান, সিঁড়ি পেরিয়ে সদর দরজায় |

লিপি জানে এবার একটা অশান্তি বাঁধতে চলেছে | ইদানিং গিরিজা দেবী আর নিমাইকে সহ্য অবধি করতে পারেন না, ওনার স্থির বিশ্বাস নিমাই-এর কুনজর বা তুকতাক ইত্যাদি ইত্যাদি-ই দায়ী বাবাই-এর অসুস্থতার জন্য |

*****************

বাবাই-এর মলিন মুখে এই অনাবিল হাসিটা সত্যিই বড্ড মধুর, এই হাসিটা দেখার জন্যই যাই হয়ে যাক, রোদে পুড়ে জলে ভিজেও হাজির হয় নিমাই নিজের শীর্ণকায় শরীর, মাথার ঝাঁকি, আর একগাল হাসি নিয়ে | দুইজনে মিলে কত সুখ দুঃখের গল্প তা সে যত অল্প সময়ই হোক, বাবাই অপেক্ষা করে থাকবেই, নিমাই আসবেই | লিপি একপাশে দাঁড়িয়ে দেখে আর নিজের মনেই হাসে | সত্যিই তো, এই পৃথিবীতে এখন ‘মানুষ’ আছে, সারল্য আছে, পাঁক সবটা বোধ হয় ছুঁতে পারেনি |

*****************

-“আবার ঐ এনামুখো, আঁটকুড়োর ব্যাটা-টা এসেছে, আর তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি বৌমা?”

শাশুড়ি মা-র তীক্ষ্ণ, তির্যক মন্তব্যে টনক নড়লো লিপির, ফিরে তাকাল, ততক্ষনে গিরিজাদেবী দালান পেরিয়ে সদর দরজার কাছে হাজির | লিপি বুঝতে পারছিলো, যা হওয়ার নয় তাই হচ্ছে | ওর হাতের বাইরে চলে যাচ্ছিল সবটা | বাধা দেওয়ার একটা ক্ষীণ চেষ্টা করল বটে, তবে কিছু লাভের লাভ হলো না |

******************

একটা গরিব, সাধারণ ফেরিওলাকে যতটা বিদ্ধ করে কথা শোনানো সম্ভব , একটা মানুষের নিঃস্বার্থ, সরল ভালোবাসাকে অপমান করে, কুৎসিত মন্তব্য করে যতটা ছোট করা যায়, তার সমস্ত উপকরণ সাজিয়ে নিজের কাজ সারলেন গিরিজাদেবী, এই আশায় যে তার দাদুভাই ঠিক ‘সুস্থ’ হয়ে যাবে | এই আঁটকুড়োর কুনজর থেকে ওনার দাদুভাইকে উনি উদ্ধার করলেন এমন আশায় ওনার মুখটা দেখবার মতো ছিল | বারবার বাধা দেওয়া সত্ত্বেও লিপির কোন বাধাই ধোপে টেকেনি, আর ছোট্ট বাবাই ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে শুধু সার্কাসটা দেখছিল |

||৪||

ঐ ঘটনার পর নিজের মলিন মুখ, মাথার ঝাঁকি, মলিন গামছা নিয়ে আর ঐ বাড়ি যায়নি নিমাই | গরীব তো, তাই গরীব মানুষটার চোখের নোনতা জলটা ঘরের মলিন ছেঁড়া বালিশেই শুকিয়ে গেছে, বাইরের সভ্য সমাজ কদরও করেনি, খোঁজও করেনি |

*****************

বাবাই-এর শরীরের উন্নতি নিমাইকে তাড়ানোর পরও হচ্ছে না দেখে গিরিজা দেবীর হিসাবে খানিক ভুল হচ্ছিল বোধ হয়, কিছুতেই মেলাতে পারছিলেন না |

******************

বাবাই ভাল নেই, একটুও ভাল নেই, না শরীরটা, না মনটা | খেলনা কাকু আর আসে না, বাবাই-এর আর মন খুলে গল্প করা হয় না অনেকগুলো খেলনা দেখতে দেখতে, খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে,….. খেলনা কাকু আর বাবাই-এর বাড়ির দরজায় একগাল হাসি নিয়ে আসে না |

******************

ঘটনার পর একবারই এসেছিল নিমাই, এক বড় ডাক্তারের খোঁজ দিতে | সেই ডাক্তারের খোঁজ পেয়ে অবশেষে নতুন করে চিকিৎসা শুরু হয়েছিল বাবাই-এর, নিউমোনিয়া ধরা পড়ে |

এখন বাবাই সুস্থ, কিন্তু খেলনা কাকু এই বাড়ির কাছে আর আসে না, দেখা না হোক, ভালবাসা তো আছে, রাস্তার মোড় ঘুরতে গিয়ে নিমাই ঠিক বাবাই-এর বারান্দায় দাঁড়ানো করুণ মুখটা দেখেই নিজেকে লুকিয়ে চলে যায়, চোখের জলে ঝাপসা হয় দৃষ্টি | লিপি সবটা জানে, বোঝে, কিন্তু কুসংস্কারের এই নোংরা শিকড় যে এত সহজে উপড়ানো যায় না | আর কত প্রজন্ম পর এই অভিশাপ থেকে মুক্ত হবে সমাজ, সেটাই দেখার | পরিবর্তন শুধু বাইরেটার জরুরি নয়, মনটারও পরিবর্তন হোক না এবার |

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

মুক্তি

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেল, আকাশ তখন থেকে ঠায় বসেই রয়েছে ঘাটে। এখন বাঁধানো ঘাট থেকে করিডোর হয়ে বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরে পুজো দেওয়া অনেকটা সহজ

Read More »

বন্ধু হবি চল

বাক্সপেটরা নিয়ে স্টেশনেই বসে ছিল নয়না, বৃষ্টি পড়েই চলেছে, মুষলধারায়। বাবা বলল আরেকটু অপেক্ষা করতে, এত বৃষ্টিতে তো ছাতাও হার মানবে, আর বেরিয়ে রাস্তাও অজানা

Read More »

ক্লিক

।।১।। -“মালিনী, কালকের মিটিংটা কখন ফিক্স করেছ? -“ম্যাম, সকাল ১১টা।” -“ওকে, কনফার্মেশন পেয়ে গেছ?” -“ইয়েস ম্যাম।” -“ওকে গুড। আর।।। এক মিনিট।।।” টেবিল থেকে ফোনটা তুলে

Read More »

শিক্ষা

।।১।। দাপুটে, বদরাগী, মেজাজি এই সব কটা বিশেষণই বেশ ভালো যায় মিসেস বোসের সাথে। রেণুকা বোস আর অমরনাথ বোস সানফ্লাওয়ার এপার্টমেন্টে ১২০০ স্কোয়ারফিটের ফ্ল্যাট 2c

Read More »

বিদায়

।। ১।। রীতিমত জোর করেই নন্দিনীকে পাহাড়ে নিয়ে এলো সঙ্গীতারা। আসার ইচ্ছে তো ছিল না ওর একদমই, শরীর সাথ দিলেও মনটা কোনোভাবেই সাথ দিচ্ছে না।

Read More »

মামাবাড়ি

।।১।। একবার নিজের ঘড়িটা স্টেশনের ডিজিটাল ঘড়ির সাথে মিলিয়ে নিল মিনি, সময় তো হয়ে গেছে। উল্টো দিকের দুটো মেট্রো এসে গেল কিন্তু এদিকের মেট্রোর কোনো

Read More »

Share with