বন্ধু (১)

bondhu-muktodhara story image

bondhu-muktodhara story image

||১||

“উফফ! বেরোতে কত রাত হয়ে গেল আজ “, বলতে বলতেই টেবিলের ফাইলগুলো তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নিচ্ছে পল্লবী | আজ কাজ শেষ করে বেরতে বেরতে অফিস থেকে বেশ রাতই হয়ে গেছে ওর | কাজের মধ্যে এমন ডুবে গেছিল যে খেয়ালই করেনি ঘড়ির কাঁটা কখন রাত দশটা ছুয়েঁছে |

বেরিয়েই মা-কে ফোন করে দিল পল্লবী | পল্লবী এখানে পেয়িং গেস্ট হিসাবে থাকে, আসল বাড়ি শিলিগুড়ি | মা-কে ফোনে রাত করে ফেরার কথাটা চেপেই গেল পল্লবী | বেকার মানুষটা চিন্তা করবে | তাড়াতাড়ি পা চালালো পল্লবী |

||২||

“আয়, আয়, এই তো, এই তো, দিচ্ছি, এইনে খা…” পাড়ার কুকুর গুলোকে রোজ বিস্কুট খাওয়ায় পল্লবী | ছোট থেকেই ওর পোষ্যদের উপর বড্ড মায়া | নিজেদের বাড়ির কাছেও ও এভাবেই খাওয়াত পাখি, কুকুর, বেড়ালদের | এখানেও তেমন, নিজের পাত থেকে বাঁচিয়ে, ভাত, নয়তো বিস্কুট, মুড়ি, যখন যেমন পারে ঠিক খাওয়ায়, তারপরই ওর শান্তি | আশে পাশের মানুষজন সবাই যে ব্যাপারটা ভাল ভাবে নেয় তা নয় | “বেশি বাড়াবাড়ি”, “আদিখ্যেতা” ইত্যাদি টুকরো কথা ভেসে আসতেই থাকে | পল্লবী বেশি পাত্তা দেয় না, প্রাণীগুলো খুশি দেখেই ও খুশি |

||৩||

একদিন কুকুরগুলোকে খাওয়াতে খাওয়াতে দুটো কুকুর পাশের গলিতেও ঢুকে পড়েছিল | পাশের বাড়ির দত্ত কাকীমা আবার এসব একদম পছন্দ করেন না, হঠাৎই ওনার চিল চিৎকারে পল্লবীর খেয়াল পরে দুটো কুকুর তো নেই | দত্ত কাকীমা শুধু চেঁচিয়েই শান্ত থাকেননি, পাথরের টুকরো ছুঁড়ে মেরে গলি থেকে তাড়ান ওদের |

খুব খারাপ লেগেছিল সেদিন পল্লবীর, অবলা প্রাণী, কোন ক্ষতি তো করেনি, এভাবে তাড়ানোর কি খুব দরকার ছিল? একটা কুকুরের পায়ে ইটের টুকরো লেগে বেচারা একটু খুঁড়িয়েও হাঁটছে | পল্লবী কিছু কিছু জিনিস না দেখারই চেষ্টা করে, যত দেখবে ততই কষ্ট |

||৪||

সুমন, পল্লবীর বয়ফ্রেন্ড | সেও পল্লবীর এই অতিরিক্ত আদিখ্যেতাগুলো একদম সহ্য করতে পারে না |

রোজই সারাদিনের ইতিবৃত্ত গল্প করার সময় স্বাভাবিক ভাবেই পল্লবীর প্রিয় প্রাণীগুলোর কথাও এসেই পড়ে, যেটা সুমনের এক্কেবারে অপছন্দের | সুমন বলে,”প্লিজ এখন তোমার কুকুর বেড়ালের গল্প শুরু করে আমাদের কোয়ালিটি টাইমটা স্পয়েল করো না |”

||৫||

ফোনে বার বার ট্রাই করেও পাচ্ছে না পল্লবী, সুমনকে | এত রাত্রে সুমনটা এলে বড় ভাল হতো, একা এখন এতটা রাস্তা যেতে হবে | আর এখন যা নেটওয়ার্কের অবস্থা, কখনোই টাওয়ার পাওয়া যায় না |

উফফ বাধ্য হয়েই বাসে  চাপল পল্লবী | বাস ধরতে ধরতে এখন ঘড়ির কাঁটা ১০:২০, বাসে গোটা পাঁচেক লোক | একজন ভদ্রমহিলা আছেন এটাই স্বস্তির |

বাস ফাঁকা রাস্তা ধরে হু হু করে এগোতে লাগল | জানলার ধারের সিটটায় বসেছিল পল্লবী | ফোনের টাওয়ার আসতেই পরপর নোটিফিকেশন গুলো ঢুকতে লাগল | ইস, অনেকগুলো মিসড কল রয়েছে সুমনের, নিশ্চই খুব চিন্তা করছে ফোনে না পেয়ে |

তাড়াতাড়ি ফোন করলো পল্লবী, ফোনে সুমনকে স্টপেজে দাঁড়াতে বলে দিল | স্টপেজ থেকে পল্লবীর পি.জি টা খানিকটা রাস্তা, একটু ফাঁকা | শুনশান স্টপেজে নেমে সুমনকে দেখে স্বস্তি পেল |

“কি হলো আজ এত দেরি?”, বলতে বলতেই এগিয়ে এল সুমন | পল্লবী সুমনের সাথে কথা বলতে বলতে এগোতে লাগল | সুমনের বাড়ি পল্লবীর পি.জি থেকে হাঁটা পথের দূরত্ব |

অন্ধকার গলিটা ইদানিং কিছু উঠতি গুন্ডা টাইপ ছোকরার ঠেক  হয়েছে | পল্লবী তাড়াতাড়ি পা চালাতে লাগল, যাতে জায়গাটা যত দ্রুত সম্ভব পেরনো যায় |

“কী মামণি একটু আমাদেরও দেখ”- অন্ধকার চিরে একটা গলা ভেসে এল যেটা শুনেই বোঝা যায় গলার ওপারের মানুষটা মাতাল | পল্লবী ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিল | “ও বাবা, সাথে বডিগার্ডও আছে, তা এই লাল্টু বডিগার্ড কেন আছে মামণি “- আরেকজন পাশ থেকে বলল |

টিমটিমে বাল্বের আলোয় পল্লবী আর সুমন দেখতে পেল ওরা চার জন আছে | পল্লবী সুমনকে এদের কথায় রিঅ্যাক্ট করতে মানা করল বারবার, কিন্তু সামনে পথ আটকে দাঁড়াল ছেলেগুলো |

“কী মামণি, শুধু ওকে দেখলে হবে? আমাদেরও একটু সেবা করে দিয়ে যাও” বলেই হাত টানলো ছেলেটা পল্লবীর | শুরু হলো হাতাহাতি | সুমন একা ওরা চারজন, রিল লাইফ নয়, যে সুমন একাই একশ, বেশিক্ষন আটকাতে পারলো না সে | পল্লবীর উপর চড়াও হতে বেশি সময় লাগেনি ওদের | নিজের সবটুকু দিয়ে পল্লবী চেষ্টা করছিল বাঁচার | সুমনের মাথায় আঘাত পেয়ে পা তখন টলছে, হঠাৎ, খুব ভয়ঙ্কর একটা শব্দ কানে এলো পল্লবীর | কিছু বোঝে ওঠার আগেই অন্ধকার থেকে খান পাঁচেক কুকুর এক নিমেষে ঝাঁপিয়ে পড়ল জানোয়ার গুলোর উপর |

পল্লবী সুমনও অবাক ঘটনার আকস্মিকতায় | কুকুর গুলো প্রাণপনে চেষ্টা করছে যাতে পল্লবীর গায়ে একটা আঁচড়ও না লাগে | কামড়ে ধরেছে মানুষরূপী পশুগুলোকে | পল্লবী আর সুমন হতভম্বের মতন কিছুক্ষন দাঁড়িয়েই ছিল, টনক নড়তে ওরা দৌড়ে সামনের অন্ধকার রাস্তার দিকে, যদি কোন ‘মানুষ’এর সাহায্য পাওয়া যায় | যতটা সম্ভব জোরে চিৎকার করতে থাকে ওরা , অন্ধকার আর ঘন কুয়াশার বুক চিরে যদি কারও কানে পৌঁছায় গলার ডাক |

শীতের রাত,তাও  সৌভাগ্যবশতঃ, কিছু বাড়ির বারান্দায় আলো জ্বললো, ওদের অবস্থা দেখে বেরিয়ে এলো পাড়ার কেউ কেউ | পল্লবীর লোকদের নিয়ে এগোল আবার সেই অভিশপ্ত জায়গাটার দিকে | নিভু আলোতেও চোখে পড়ল, একটা কুকুরের পা দিয়ে রক্ত ঝরছে, কিন্তু এখনো ছাড়েনি মানুষরূপী পশুটাকে | পশুটার কাছে যে ধারালো অস্ত্র ছিল, তাই দিয়েই বাঁচার জন্য প্রাণপণে মেরে চলেছে কুকুরটার পায়ে |

লোকজন, পুলিশ ইতিমধ্যে জড়ো হয়ে গেছে | কেউ হয়তো মজা দেখছে, কেউ এমনি দেখার জন্য দেখছে | জানোয়ারগুলো ধরা পড়ার পর তবেই কুকুরটা ছাড়ল, নেতিয়ে পড়ল রাস্তায়, রক্তে ভাসছে আশপাশটা | প্রভু ভক্তির প্রমান দিতে গিয়ে যা হয় হোক, নিজের প্রাণটাই সই | সবাই যেন আজ লজ্জিত একটা অবলা জীবের সামনে |

(ঘটনার ছয় মাস পর)

সুমন-“ওদের খাইয়ে এলে?”

পল্লবী-“হ্যাঁ, এখন আমার থেকে তোমার চিন্তা কিন্তু অনেক বেশি দেখছি ওদের নিয়ে  |”

সুমন-“হবে না? যাদের জন্য আজ মান সম্মান নিয়ে সুস্থভাবে বেঁচে আছি তাদের কথা ভাববো না?”

***************

নাহ, ওই কুকুরটার ঐ পা-টা বাদ দিতে হয়েছে | এখন ওর তিনটে পা | ঐ তিনটে পা ওলা কুকুরটাকে দেখে এখনও যেন কোথাও পাড়ার মানুষগুলোর মন বলে ওঠে, ‘ভালবাসায় সব সম্ভব, সব’|

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with ❤

এরকম আরো কিছু গল্প

মুক্তি

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেল, আকাশ তখন থেকে ঠায় বসেই রয়েছে ঘাটে। এখন বাঁধানো ঘাট থেকে করিডোর হয়ে বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরে পুজো দেওয়া অনেকটা সহজ

Read More »

বন্ধু হবি চল

বাক্সপেটরা নিয়ে স্টেশনেই বসে ছিল নয়না, বৃষ্টি পড়েই চলেছে, মুষলধারায়। বাবা বলল আরেকটু অপেক্ষা করতে, এত বৃষ্টিতে তো ছাতাও হার মানবে, আর বেরিয়ে রাস্তাও অজানা

Read More »

ক্লিক

।।১।। -“মালিনী, কালকের মিটিংটা কখন ফিক্স করেছ? -“ম্যাম, সকাল ১১টা।” -“ওকে, কনফার্মেশন পেয়ে গেছ?” -“ইয়েস ম্যাম।” -“ওকে গুড। আর।।। এক মিনিট।।।” টেবিল থেকে ফোনটা তুলে

Read More »

শিক্ষা

।।১।। দাপুটে, বদরাগী, মেজাজি এই সব কটা বিশেষণই বেশ ভালো যায় মিসেস বোসের সাথে। রেণুকা বোস আর অমরনাথ বোস সানফ্লাওয়ার এপার্টমেন্টে ১২০০ স্কোয়ারফিটের ফ্ল্যাট 2c

Read More »

বিদায়

।। ১।। রীতিমত জোর করেই নন্দিনীকে পাহাড়ে নিয়ে এলো সঙ্গীতারা। আসার ইচ্ছে তো ছিল না ওর একদমই, শরীর সাথ দিলেও মনটা কোনোভাবেই সাথ দিচ্ছে না।

Read More »

মামাবাড়ি

।।১।। একবার নিজের ঘড়িটা স্টেশনের ডিজিটাল ঘড়ির সাথে মিলিয়ে নিল মিনি, সময় তো হয়ে গেছে। উল্টো দিকের দুটো মেট্রো এসে গেল কিন্তু এদিকের মেট্রোর কোনো

Read More »

Share with ❤