||১||
কানের ঝুমকোর পাশ দিয়ে অবাধ্য চুলগুলো বার বার এসে পড়ছে নরম গালে, বার বার বিরক্তি নিয়ে সেগুলো সরিয়ে ক্লাসে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করছে বহ্নি, বহ্নি মল্লিক | সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাসরুম, এস.পি ম্যাডাম আপাতত বোর্ডে কেমিকাল বন্ডিং নিয়ে ব্যস্ত, ক্লাসের বেশিরভাগ ছেলেই সুন্দরী ম্যাম-এর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে | একমাত্র অর্জুনের চোখ অন্যদিকে, দু’চোখ ভরে অর্জুন দেখছে, বহ্নিকে,বহ্নির নরম গালে তখন পড়ন্ত বিকেলের সোনালী আভা, উফফ পাগলই হয়ে যাবে কোনদিন, কিন্তু বলার সাহসও নেই | ‘বলে বন্ধুত্ব নষ্ট হোক চাই না’, ‘বন্ধুত্বটাই দামী’ গোছের সেই সেন্টিমেন্টগুলো এখনো চলেই আসছে যুগযুগ ধরে, এখানেও তার অন্যথা হয়নি | তাই অর্জুন-এর মনের কথা মনেই |
বলেও তো লাভ নেই, বহ্নির বয়ফ্রেন্ড আছে, অর্জুন জানেও সেটা | তবুও বহ্নিকে ভালবাসে, আসলে ভালবাসা তো মেপেজুপে হয় না | আর ও যখন থেকে বহ্নিকে মনে জায়গা দিতে শুরু করেছিল, (হয়তো পরিচয়ের প্রথম দিন থেকেই) তখন তো এত জানতো না বহ্নি সিঙ্গেল নাকি কমিটেড | কিন্তু অর্জুনের বার বার এটাই মনে হয়েছে, বহ্নিও হয়তো….| হয়তো মনের ভুল, তাই আর এসব নিয়ে ভাবে না অর্জুন, তার থেকে যেমন চলছে চলুক | ওর ভালবাসা তো ওর থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না, এটা শুধুই ওর |
বহ্নি হঠাৎ ফিরে তাকাল, সঙ্গে সঙ্গে অর্জুন নিজেকে সামলে নিল, পাছে ওর চোখ ওর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা না করে |
****************
ওদের দলটা , মানে ওরা ছ’জন, তার মধ্যে বহ্নি ছাড়া এতদিনে সবাই জেনে গেছে অর্জুনের মনের কথাটা | শুধু বহ্নি জানে না, বোঝে না, বা হয়তো বুঝতে চায় না | ক্লাসেও মোটামুটি লোকজন আঁচ করে, করবে নাই বা কেন, অর্জুনের হাবভাবই বলে দেয় সবটা | সর্বক্ষণ বহ্নির খেয়াল রাখা, সবকিছুতে অর্জুন আছে |
“….এই যে কবি সুকান্ত”| এস.পি ম্যামের ব্যঙ্গে ভাবনায় দাঁড়ি পড়ল আপাতত অর্জুনের |
খানিক থতমত খেয়ে,”ইয়েস ম্যাম”|
-“চোখটা বোর্ডে দাও একটু |”
ক্লাসে হাসির রোল, অর্জুন আবারও অপ্রস্তুত |
||২||
ব্যস্ততা এখন তুঙ্গে, ওদের ক্লাসের বেশ ক’জন মিলে ঠিক হয়েছে দীঘা যাওয়ার | আপাতত সেই নিয়েই জল্পনা চলছে | চোখের ইশারায় বহ্নি অর্জুনকে বলল,”খুব মজা হবে বল |”
অর্জুনও খুব এক্সাইটেড, এর আগে একসাথে ওরা সবাই মিলে দূরে কোথাও বেড়াতে যায়নি | অর্জুনও মুখের হাসিতে মনের আনন্দটা বুঝিয়ে দিল | ওদের সম্পর্কটা এরকমই, চোখের ইশারাতেই দুই বন্ধু একে অপরের মনের ভিতরটা পড়তে পারে | শুধু অর্জুনের ভালোবাসার ফিলিংসটাই বুঝতে চায় না বহ্নি |
****************
বহ্নি বাড়ি ফিরেই বয়ফ্রেন্ড সৌনককে ওদের দীঘার প্ল্যানিং-এর গল্প করছিল |
“তোমার ওই বন্ধুও যাবে নিশ্চই ?” সৌনক প্রশ্ন করল |
“ওই বন্ধু মানে? সবাই তো যাচ্ছি |”- বহ্নি |
“আরে অর্জুন | আমি বলছি শোনো ওর তোমার উপর চাপ আছে |” – সৌনক |
“ধুস, কী যা-তা বলছো, ও আমার কত ভাল বন্ধু জান তুমি?” – বহ্নি |
“সে তোমার কাছে | আমি তো একটা ছেলে, আমি ওর তোমার প্রতি বিহেভিয়ার দেখে তবেই বলছি |”- সৌনক |
“উফফ, এত ইনসিকিওর কেন বলতো তুমি? ছাড়ো এসব ফালতু কথা…|” নিজেদের খুনসুটিতে মগ্ন হলো ওরা |
আর একদিকে অর্জুন, ওকে হয়তো পাগল বললেও কম বলা হবে, সব জেনে শুনেও ওর কোন হেলদোল নেই | ও জানে ও কোনদিন বহ্নিকে পাবে না, তা সত্ত্বেও দিনের ওর দিন শুধু একজনকে নিয়েই ভাবনা |
||৩||
আজ সকালেই ওরা প্রায় জনা পনের নিউ দীঘায় পৌঁছাল, বাসে | হোটেলে ব্যাগপত্র রেখেই সবাই দে ছুট | সামনেই বিশাল সমুদ্র, দিগন্ত বিস্তৃত, দু হাত দিয়ে আহ্বান জানাচ্ছে যেন | যতদূর দেখা যায় শুধুই তার বিশালতা, গভীরতা মাপে কার সাধ্যি | সূর্যের আলোয় চকচক করছে বালির স্তূপ | প্রকৃতির সাজানো এই রূপকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে নিশ্বাস ভরে শুষে নিচ্ছিল অর্জুন |
কিছুক্ষনের মধ্যেই সমুদ্রের ঢেউ-এ গা ভাসালো ওরা | বন্ধুদের সাথে মিলে এত হুল্লোড়, এত আনন্দ, যারা এই আনন্দ, পাগলামোতে মেতেছে, একমাত্র তারাই বুঝবে |
****************
সূর্যের কিরণ আস্তে আস্তে রং পাল্টে সোনালী থেকে রক্ত লাল | অস্তগামী সূর্যের লাল হলুদ আলোর কোলাজে যেন সমুদ্রটার রূপ বেড়ে গেছে আরও কয়েকগুন | তার সাথে দমকা হাওয়া, সাদা ফেনার মতো ঢেউ-এর আছড়ে পড়া, সব মিলে মিশে এক অসাধারণ মুহূর্ত |
মেয়েদের দলটা একসাথে দাঁড়িয়ে ফটো-সেশনে ব্যস্ত, দমকা হাওয়ায় এলোমেলো হচ্ছে বহ্নির রেশমের মতো একঢাল চুল | অর্জুন একলা দাঁড়িয়ে মুগধ হয়ে দেখছে তার বহ্নিকে | কে জানে সেই হাওয়ায় কী নেশা ছিল | সেই নেশার ঘোর লাগল বোধহয় অর্জুনের |
বন্ধুদের জোরাজুরিতে অবশেষে মাতাল হলো নেশায় | শত চেষ্টা করেও এই অবস্থায় নিজের মনের কথা লোকালেও চোখ তো বিশ্বাস ঘাতকতা করবেই | বহ্নি অনেক্ষন অর্জুনকে দেখতে না পেয়ে তাকে খুঁজছিল | কিছুক্ষন পর দেখল আলো আঁধারিতে একটা পাথরের উপর দাঁড়িয়ে অর্জুন | দেখেই বোঝা যাচ্ছে স্বাভাবিক অবস্থায় নেই |
“কীরে এখানে এভাবে একা কেন? যা, সবার সাথে থাকে | টলছিস তো পুরো, কিছু হলে কী হবে?”- বহ্নি |
“আরে ধুর, কী আবার হবে? আর হলেই বা কী? তুই এই পাথরটার উপর ওঠ, দেখ কী দারুন দেখাচ্ছে !” – অর্জুন |
“আমার কোন শখ নেই, তুই দয়া করে যা |”-বহ্নি |
বিরক্ত হয়ে ফিরে আসছিল ওখান থেকে, ডাকল অর্জুন, বলল,”শোন না, একবার ওঠ ওপরটায়, ভরসা নেই আমার উপর?”
“সেন্টি দিস না তো | উফফ, জ্বালিয়ে খেলি “, বলতে বলতে টিলাটার উপর উঠল বহ্নি | উঠে,”কী দেখব হ্যাঁ? অন্ধকারে দেখা যায় কিছু…”|
বহ্নির মুখটা হাত দিয়ে বন্ধ করে দিল অর্জুন,”বকবক থামা, তবে তো ফিল করবি | দেখ অন্ধকার চিরে সমুদ্রের গর্জন, কী ভীষণ গভীরতা …”|
মুগধ হয়ে ঝোড়ো হওয়ার সামনে নিজেকে সঁপে দিল বহ্নি | সমুদ্রের ঢেউ গুলো আছড়ে পড়ছে পা-র কাছে, আর জলের ছিটে এসে লাগছে গায় |
“বুঝিস না তুই কিছু?”, প্রেমের নেশায় মাতাল অর্জুন বহ্নির হাতটা নিজের হাতে নিল,”ভরসা করা যায় না কী একটুও?”
বহ্নির মুখে কোন কথা নেই, হাঁ করে দেখছে অর্জুনকে | এ এক অন্য্ অর্জুন, বন্ধুত্বের আড়ালে একে কখনও দেখেইনি বহ্নি, বা হয়তো দেখতে চায়নি |
“তোকে কতটা ভালবাসি সেটা মুখে বলে বোঝাতে পারব না, কিন্তু বিশ্বাস কর তোর থেকে কিছু আশা করে ভালবাসিনি | আমি জানি তুই সৌনককে খুব ভালবাসিস, আর সবদিন বাসবি, কিন্তু তাও নিজেকে সামলাতে পারিনি | তোর পাশে আমায় সবদিন পাবি তুই,আমায় হয়তো তোর দরকার লাগবে না তাও.. | জানি আমায় তুই পাগল ভাবছিস “, বলেই পাগলের মত হাসতে লাগল অর্জুন | হাসতে হাসতেই তাকাল বহ্নির চোখে, এই চোখ যেন সামনের সমুদ্রের থেকেও গভীর, যেদিকে তাকিয়ে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে সবসময় |
বহ্নি অর্জুনের হাতটা ধরেই রেখেছিল, কথার মাঝে হারিয়ে গেছিল দু’জন দু’জনের চোখে | বাধ সাধল অবাধ্য ঢেউটা, আছড়ে পড়ল ওদের গায়ে | ঘোর ভাঙলো ওদের, বহ্নি সঙ্গে সঙ্গে হাতটা ছেড়ে দিল অর্জুনের, মুখ ঘুরিয়ে মিশে গেল অন্ধকারে | ক্লান্ত অর্জুন দাঁড়িয়ে রইল একা, অন্ধকারের মাঝে, চোখের কোণে জল নিয়ে |
||৩||
দীঘা থেকে ফেরার পর থেকে অর্জুন আর বহ্নির বন্ধুত্বের সমীকরণটা পালটে গেল একদম | বহ্নি, অর্জুনকে সম্পূর্ণ রূপে এড়িয়ে চলে, অর্জুনের চোখের আকুতি দেখেও দাঁড়ায় না ও |
এভাবেই সময় বইতে লাগল, থার্ড ইয়ারের শেষে বহ্নির বিয়ে ঠিক হলো সৌনকের সাথে | অর্জুনও নিমন্ত্রিত ছিল, তার সেই মুহূর্তের মনের অবস্থাটা বলার প্রয়োজন নেই আর |
*****************
কলেজ শেষে স্বাভাবিক ভাবেই সবাই ছিটকে গেল এদিক ওদিক, অর্জুনও চাকরি নিয়ে চলে যায় বেঙ্গালুরু | যে যার নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে |
||৪||
(দুই বছর পর)
অর্জুনের মায়ের কিছু রিপোর্ট আনার কথা আজ অর্জুনের | এমনিই অনেক দেরী হয়ে গেছে | তাড়াতাড়ি গাড়িটা পার্ক করে লিফ্ট-এর জন্য দাঁড়াল অর্জুন | অধৈর্য্য হাতে মোবাইলটা ঘাঁটতে ঘাঁটতেই কানে একটা পরিচিত স্বর ভেসে এল | খুব চেনা চেনা মনে হতেই ফিরে তাকাল অর্জুন | দেখল বহ্নির বাবা, কাকুকে ভালোই চেনে ও | কলেজে পড়া কালীন প্রায়ই দেখা হতো | কাকু খুব ভালমানুষ, তাই আলাপ ভালই ছিল, কলেজের পর থেকে আর নেই যদিও | অর্জুন দেখেই এগিয়ে গেল | ভদ্রলোক রিসেপশনে কথা বলছিলেন, অর্জুন কাছে গিয়ে বলল,”কাকাবাবু আপনি এখানে?”
অর্জুনকে দেখে খানিক ঘাবড়ে গেছিলেন ভদ্রলোক, আশিষ মল্লিক, বললেন,” আরে অর্জুন, তুমি এখানে?”
-“আমার তো এখানেই পোস্টিং, মা-র কিছু রিপোর্টস নেওয়ার ছিল | কিন্তু আপনি ?
মুখটা কেমন হয়ে গেল আশিষ বাবুর | কিছুক্ষন ইতস্তত করে তারপর পিছনঘুরে হাতের ইশারায় দেখালেন…বহ্নিকে | অর্জুন ওনার হাত অনুসরণ করে বহ্নিকে দেখে পাঁচ পা পিছিয়ে গেল, এই কী সেই বহ্নি? ওর হাসিখুশি মিষ্টি বহ্নির সাথে তো এর কোন মিলই নেই | অবিন্যস্ত সাজপোশাক, কোটরাগত চোখ, ঘোলাটে উদভ্রান্তের মতো দৃষ্টি, এ কে? অর্জুন ছুটে যেতে গেল বহ্নির কাছে, একলা চুপ করে বসে আছে জানলার দিকে চেয়ে, কাকাবাবু আটকালেন,”এখন ওর কাছে যাস না অর্জুন |” একরাশ প্রশ্ন নিয়ে তাকাল অর্জুন, কাকাবাবু বুঝতে পেরে বললেন,”ও অসুস্থ, মানসিক ভাবে, এখন তুই ওর কাছে গেলেও কোন লাভ হবে না |”
ততোধিক হতবাক হয়ে অর্জুন প্রশ্ন করল,”কিন্তু এসব হলো কী করে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না |”, বলেই অসহায় ভাবে অর্জুন তাকিয়ে রইল বহ্নির দিকে | বহ্নির তো আজ সুখে ঘর করার কথা, অর্জুনও তো তাই চেয়েছিল, কিন্তু…..| নিজের অজান্তেই অর্জুনের চোখ দুটো ভিজে গেল |
****************
” সৌনক বিয়ের বছর দেড়েকের মাথায় একটা কার অ্যাক্সিডেন্ট-এ মারা যায় | সেই ট্রমা থেকে বহ্নি আজও বেরতে পারেনি, তারপর থেকেই মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত বহ্নি চিকিৎসাধীন | কিন্তু এখন তেমন কিছুই উন্নতি হয়নি | সৌনক আর বহ্নির ফ্ল্যাট থেকে বহ্নিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল বহ্নির মা বাবা, কিন্তু বহ্নিকে এখন থেকে একচুলও নড়ানো যায়নি | ও সৌনকের স্মৃতি ফেলে কোন ভাবেই যাবে না | আজ অবধি বহ্নিকে কেউ কাঁদতে পর্যন্ত পারেনি | সেই দিনটার পর থেকেই ও এরকমই |” পুরোটা বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আশিষ বাবু |
অর্জুন সম্পূর্ণ বাকরুদ্ধ | এরকম কিছুর কথা ভাবা তো দূর, এখনও বিশ্বাসই হচ্ছে না ওর |
কথাবার্তার পর ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বাড়ি ফিরল অর্জুন | ফেরার পর থেকে একবারের জন্যও নিজের চোখ থেকে সরাতে পারেনি বহ্নির ওই রূপটা | এগুলো তো ওর প্রাপ্য ছিল না ওর, তাহলে? অর্জুন মরে যেতে পারতো , সৌনকের সাথে এসব কেন হলো?’ আবোল তাবোল চিন্তার সাক্ষী রইল রাত জাগা তারা গুলো শুধু |
||৫||
(কিছুদিন পর, ডঃ বসুর চেম্বারে)
-“দেখুন, উনি এখনও ট্রমা থেকে বেরোননি | এখন পুরোটাই ধৈর্য্য ধরে সামলাতে হবে আগেও বলেছি, আর এই সব কেসে কার কতটা টাইম লাগে এক্সাক্ট ওভাবে প্রেডিক্ট করা যায় না, একেক জন একেক রকম | তাই ধৈর্য্য ধরতেই হবে | তবে হ্যাঁ, আপনি এত কাছের বন্ধু, আপনি গেলে উনি হয়তো তড়িঘড়ি রিকভার করতেও পারেন | তবে কেসটা খুব সেনসিটিভ, তাই খুব সাবধান |”
ডাক্তার বাবুর সাথে কথা বলে বেরলো অর্জুন আর আশিষবাবু | শুরু হলো অর্জুনের নতুন লড়াই, বন্ধুত্বের নতুন পরীক্ষা |
*****************
অর্জুনকে দেখেই হাতের কাছের ফুলদানিতে ছুঁড়ে ফেলল বহ্নি | বহ্নির চোখে যেন প্রকৃত অর্থেই বহ্নি শিখা, অর্জুনকে দেখেই ভায়োলেন্ট হয়ে উঠেছে ও |
অর্জুন এরকম কিছু হবে স্বপ্নেও ভাবেনি, বহ্নি এভাবে রিঅ্যাক্ট করছে কেন? ওকে জানতেই হবে | যে ভাবেই হোক, বহ্নিকে জীবনের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতেই হবে |
*****************
-“অর্জুন, এতে হিতে বিপরীত হতে পারে, এরকম পাগলামো করো না |”
-“না কাকাবাবু, ও নিজেকে বন্দী করে রেখেছে, ওকে একবার কাঁদাতে হবে অন্তত, এভাবে আর কতদিন? আমি আর ওকে এভাবে দেখতে পাচ্ছি না |
*****************
বহ্নির রুদ্রমূর্তিকে উপেক্ষা করে অর্জুন জোর করে দাঁড়ালো বহ্নির সামনে | হাতের কাছে যা ছিল, আবারও ছুড়ে মারতে উদ্যত হলো বহ্নি | নিজের সর্ব শক্তি দিয়ে বহ্নির হাত দুটো চেপে ধরল অর্জুন, “বহ্নি প্লিজ এসব বন্ধ কর, আমায় চিনতে পারছিস না? আমি তোর বন্ধু, তোর অর্জুন রে |”
….বহ্নি কিছুক্ষন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল অর্জুনের দিকে |
“সৌনক আর নেই রে, এটা মেনে নিতেই হবে, তোকে এভাবে দেখে সৌনক কি কষ্ট পাচ্ছে না? প্লিজ নিজেকে একটু সামলা, একটু কাঁদ | আমায় এখনো চিনতে পারছিস না? আমাদের সব বন্ধুদের খবর দিয়েছি, সবাই কাল চলে আসবে, আমরা আবার আগের মতন | তোর মনে আছে আমাদের ঘন্টার পর ঘন্টার আড্ডা, খিল্লি, কী দারুণ এনজয় করতাম আমরা | আবার আমরা ওরকম আনন্দ করব, তুইও করবি, তুই শুধু একটু নিজেকে সামলা, আমি সব পরিস্থিতে তোর পাশে আছি |”
কে জানে অর্জুনের কথা গুলোয় কী ছিল? হয়তো এক বন্ধুর অপর বন্ধুকে মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার তীব্র আকুতি, হয়তো বা একটা নিঃস্বার্থ এক তরফা প্রেমের ভগবানের কাছে আকুল প্রার্থনা, হয়তো বা দুটোই |
“অর্জুন এসছিস?”, অবশেষে মুখ ফুটে এই দুটি শব্দ বলল বহ্নি |
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি অর্জুন, চিনতে পারছিস, তুই একদম ঠিক হয়ে যাবি , সব ঠিক হয়ে যাবে…”
অর্জুনকে থামিয়ে বহ্নি হঠাৎ বলে উঠল,”সৌনক আর আসবে না বল আমার কাছে?”
এর উত্তর কী দেবে আর অর্জুন? চুপ করে থাকা ছাড়া আর কী-ই বা করবে, তাও বলল,”সৌনক তোর কাছেই আছে, তোকে দেখে ও-ও কষ্ট পাচ্ছে |”
বহ্নির মুখ চোখ লাল, যেন এতদিনকার ইচ্ছাকৃত ভাবে পর্দা ঢেকে রাখা বাস্তবতা বেরিয়ে পড়ায় সহ্য করতে পারছে না সত্যের তেজ | মুহূর্তেই গলতে শুরু করল যেন সত্যের আঁচে | হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল বহ্নি, সৌনককে আবার ফিরে পাওয়ার তীব্র আর্তনাদ, যে আর্তনাদ মূল্যহীন |
||৬||
আগের থেকে এখন খানিকটা সুস্থ বহ্নি, হয়তো অর্জুনের ভালবাসা আর নিখাদ বন্ধুত্বের ডাকে সাড়া দিতে বাধ্য হয়েছে | সেই থেকে একবারও বহ্নিকে নাগালের বাইরে করেনি অর্জুন | তারপর থেকে আরও মাস দুয়েক কেটে গেছে | একটু একটু করে বহ্নি আবার হাসছে, আবার বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মাতছে | তবে এখনও অনেকটা পথ বাকী | বহ্নির মা বাবাও বুঝে গেছেন অর্জুনের মনের কথাটা, হয়তো সত্যিকারের ভালোবাসা কখনও চাপা থাকে না তাই |
“বহ্নিকে অর্জুনই সামলে রাখতে পারবে হয়তো”-এরকমই ধারণা থেকে আশিষবাবু অর্জুনকে আসল কথাটা জানান | না, সৌনক নেই বলে এখন সৌনকের জায়গাটা অর্জুন নেয়নি, নিতে চায়ওনি, কারন সৌনকের জায়গা নেওয়া কোনদিনই সম্ভব না | আর বহ্নির মনে অন্তত জোর করে গেড়ে বসার মানুষ অর্জুন নয় | তার থেকে ওর না ভাগাভাগি হওয়া নিঃস্বার্থ প্রেম, থাকুক না এরকমই, ক্ষতি কী? বহ্নি আর ওর বন্ধুত্বটাই না হয় বাঁচুক, সজীব হয়ে |
****************
নার্ভ-এর ওষুধগুলো এখন অনেক কম খেতে হয় বহ্নিকে | আজ অনেকদিন পর অর্জুন আর বহ্নি একটা লং ড্রাইভে, বৃষ্টি নেমেছে, ঝাপসা কাঁচের দিকে তাকিয়ে বহ্নি বলল, “সবদিন আমার পাশে থাকবি তো? আমাদের বন্ধুত্বটা এরকম গাছগুলোর মতই সজীব থাকবে তো রে?”
শব্দের প্রয়োজন নেই, অর্জুনের চোখই বলে দিল যা বলার “আছি, থাকবো “|