অন্য মা

anyoma muktodhara story image

anyoma muktodhara story image

||১||

” I am sorry to say, কিন্তু এটাই fact, ওর পক্ষে সন্তান ধারণ করা সম্ভব না |” নতমস্তকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও রূঢ় সত্যটার উপর থেকে পর্দা সরিয়ে দিল ডঃ চ্যাটার্জী ওরফে অয়নের ছোটবেলার অভিন্নহৃদয় বন্ধু সায়ক |

রিপোর্টটা হাতে নিয়ে বেশ কিছুক্ষন পাথরের মত বসে রইল অয়ন, অয়ন আর মেঘলার বিয়ে হয়েছে বছর চারেক | ইতিমধ্যেই আত্মীয় স্বজনরা বলতে শুরু করে দিয়েছে, যা হয় আরকী | অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও মেঘলা সন্তান ধারণ করতে না পারায় অবশেষে যাতায়াত শুরু হয় ডাক্তার, চেম্বার, হাসপাতালে | এখন এটা জানার পর মেঘলাকে কিভাবে ফেস করবে অয়ন সেটাই মনের মধ্যে তালগোল পাকিয়ে চলেছে | চেম্বার থেকে বেরিয়ে পার্কিং লট থেকে গাড়ি নিয়ে বেরলো অয়ন দিল্লী রাস্তা ধরে |

অয়ন আর মেঘলার ভালবাসার বিয়েতে ওরা একে অপরকে চেনে দশ বছর ধরে | বিয়ের পর থেকেই ওরা ওদের বেবি কেমন হবে সেই নিয়ে স্বপ্ন বুনত | অয়ন বলতো, “আমার একটা ছোট্ট মেঘলা চাই”, মেঘলা বলতো,”আমিও চাই আমাদের মিষ্টি একটা মেয়ে হোক” | তার নাম ঠিক করা থেকে শুরু করে সবকিছুর প্ল্যানিং সেরে রেখেছিল দুজনে | এখন মেঘলাকে সত্যিটা বলবে কীভাবে?

হাতের মুঠো ফোনটা বেজে উঠল, মেঘলা ফোন করেছে |

-” হ্যালো |”

-” হ্যাঁ বল |”

-” গেছেলে চেম্বার? রিপোর্ট পেলে?”

-“হুম |”

-” কি বললো অয়ন?”

-” বাড়ি গিয়ে বলছি |” ফোনটা কেটে দিল অয়ন |

||২||

রিপোর্টগুলো নিয়ে মেঘলা এলো চুলে মাটিতে বসে আছে | মা হওয়ার ক্ষমতা নেই তকমা মারা কাগজগুলো ইতিউতি উড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ফ্ল্যাটের মেঝেতে | সেই দিকে তাকিয়ে মেঘলা বলল, ” আচ্ছা কোন ভুল হচ্ছে না তো?”

“সায়ক তো যথেষ্ট ভাল gynecologist | ও বার বার রিচেক করেছে, রিপোর্টে কোথাও ভুল নেই | আর এর আগেও তো অনেক ডঃ দেখল কেউ কি আশার কথা শোনাতে পারল?” বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল অয়ন |

***************

মেঘলা নিজেকে বন্দি করে রেখেছে সম্পূর্ণ একলা ঘরে | নিজের এতদিন ধরে বোনা স্বপ্নগুলোকে এভাবে চুরমার হতে দেখবে কখনো ভাবেনি | একজন নারী যখন মাতৃত্বের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়, তখন তার কাছে এর থেকে বেশি দুর্ভাগ্যের আর কিছু হয় না |

অয়নই বা কি ভাষায় সান্তনা দেবে? কীই বা বলবে? এত অসহায় কোনদিন নিজেকে লাগেনি | ওর হাসিখুশি মেঘলাকে এইভাবে দেখতে পারছে না অয়ন | মেঘলার মুখের হাসিটাই ওর কাছে সব থেকে দামি |

অফিসের কাজে আজকাল একটু বেশিই ভুল হচ্ছে অয়নের, সবসময়ই অন্যমনস্ক | অনেক ভেবে আজ সায়ককে ফোন করল |

-“হ্যাঁ বল ভাই |”

-“আজ একটু দেখা করতে পারবি? খুব দরকার |”

-“হ্যাঁ নিশ্চই,…..”

-“ওকে |”

টাইম, প্লেস ফিক্সড করে অয়ন কাজে মন দিল |

****************

(সন্ধে ৭টা…)

“দ্যাখ, সবই তো বুঝলাম, আমি একটা কথা ভাবছিলাম বলতেও পারি, তুই রাজী হবি কিনা জানি না |” -সায়ক |

“মেঘলা খুশি থাকলে আমি রাজী |” -অয়ন |

“দ্যাখ তোরা সারোগেসির হেল্প নিতে পারিস |” -সায়ক |

ভ্রু দুটো কুঁচকে অয়ন সায়কের দিকে এমন ভাবে তাকালো যেন এরকম কিছু ভাবা তো দূর, শোনাও পাপ |

“কীসব বলছিস? তোর মনে হয় কেউ রাজী হবে বলে?” -অয়ন |

“জানতাম তোর এরকমই রিঅ্যাকশন হবে | আচ্ছা তুই তো শিক্ষিত, তারপরও সব জেনে বুঝে তোর এরকম চিন্তা ভাবনা আসে কি করে ?” -সায়ক |

কিছুক্ষন চুপ করে থেকে নিস্তব্ধতা ভেঙে অয়ন বলল,” কী করতে হবে বল আমায় ?”

||৩||

সায়কের সাথে কথা বলে আসার পর বাড়ি ফিরে অয়ন মেঘলার সামনে বসল | “কী অবস্থা করেছো নিজের, চোখের নীচে কালি, এভাবে চলতে থাকলে কী করে চলবে? এখনই এতো ভেঙে পড়ার কিছু হয়নি |”

“কোনো আশার আলো দেখার মতোও কোনো পরিস্থিতি আসেনি |” -মেঘলা |

“দ্যাখো, প্লিজ নিজেকে সামলাও | আমি তো তোমায় ভালোবাসি নাকী? তোমায় এভাবে কষ্ট পেতে দেখতে পারছি না আমি, আমার জন্য অন্তত নিজেকে সামলাও | আমি এখনও তো বেঁচে আছি, একটা ব্যবস্থা নিশ্চই করব | এই সব কিছুর জন্য আমাদের এতদিনের ভালবাসা, বিয়ে এগুলো তো মিথ্যে হয়ে যায়নি | যেটুকু তোমার আছে সেটা অন্তত যত্ন করে আগলে রাখো |” -অয়ন |

মেঘলা আর নিজেকে আটকে রাখতে পারল না, আছড়ে পড়ল অয়নের বুকে | কাঁদুক, কেঁদে অন্তত হালকা হোক ভেবে অয়ন শক্ত করে মেঘলাকে ধরে রইল | একটু শান্ত হলে মেঘলাকে আসল কথাটা বলল অয়ন | ভেবেছিল, এটা শুনে ওর মতোই মেঘলারও রিঅ্যাকশন হবে, কিন্তু আয়নকে অবাক করে দিয়ে মেঘলার চোখ দুটো একটুকরো আশার আলোয় চিকচিক করে উঠল |

অয়ন অবাক হয়ে বলল, “বাড়িতে দুজনের মা বাবা কী বলবে ভাবতে পারছো? আর যতই বলি আমাদের মতো সাধারণ মানুষরা এখনও কী এসবে অভ্যস্ত হয়েছি? আর আমাদের এই ক্ষেত্রে সাহায্য করার মতও তো একজন মেয়ে চাই |”

“আচ্ছা, যখন আমি মা না হতে পারার যন্ত্রনায় একা অন্ধকার ঘরে কাঁদছিলাম, তখন তোমার সমাজের কোন দয়ালু মানুষটি এসেছিল বলতো? আর বাড়িতেও এই কথাগুলো শুনে ‘বাঁজা মেয়েছেলে’ তকমা দেওয়া ছাড়া আর কোন উপকারটা করবে সত্যি করে ভেবে বলতো? পাশে দাঁড়াবার লোকের খুব অভাব, বলতে তো সবাই পারে | তাই আমিও এখন থেকে নিজের ভালো লাগাটুকু ভাবব, সমাজের কথা নয় |

অয়ন খানিক চুপ করে থেকে মনে মনে ভাবল, ‘সত্যিই তো, crysis-এর সময় কেউ তো পাশে ছিল না ,এর পরেও থাকবে কী না সন্দেহ, তাহলে কে কী ভাবল এসব ভেবে কেন নিজেদের ভাল থাকাটাকে জলাঞ্জলি দি আমরা? আর যেখানে অর্ধেকের বেশি মানুষ ব্যাপারটা বোঝেই না, সেখানে মানুষের মস্তিষ্কের উদ্ভট ভাবনা কে প্রশ্রয় দিয়ে নিজের শান্তি নষ্ট করা বোকামো ছাড়া কী?’

মেঘলার হাতটা ধরে অয়ন বলল,” আমি তোমার সাথে আছি সবসময়, কিন্তু, এরকম কেউ…|”

মেঘলা থামিয়ে বলল, “সে ভাবনা আমার, আশা করি আমি খালি হাতে ফিরব না | কালই যাব ওর কাছে |”

||৪||

‘বাবার ওষুধটা আবার ফুরিয়েছে, হাতে তো এমাসে তেমন টাকাও নেই আর কী যে করি ?’ ভাবতে ভাবতেই হাতের সেলাইগুলো দ্রুত হাতে শেষ করতে লাগল জুঁই | জুঁই-এর সম্বল একটা সেলাই মেশিন, অসুস্থ বাবা, আর এই ছোট দু’কামরার বাড়িটা | দরজা পেরিয়ে ঘরে ঢুকলেই অর্থাভাব স্পষ্ট বোঝা যায় | চোকলা ওঠা ফাটা দেওয়াল, টিম টিম করে জ্বলছে আলো, স্যাঁতস্যাঁতে ঘর ; আসবাব বলতে খাট, একটা আলনা, দুটো ট্রাঙ্ক, আলমারি, একটা ছোট আয়না |

খাটে চিররুগ্ন বাবাকে নিয়ে জুঁই এখানে রোজ লড়াই করে যাতে একটু বেশি উপার্জন করা যায়, বাবাকে একটু ভাল রাখা যায়, ভাল খাওয়ানো যায় | এই ব্যস্ততা আর স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশের মধ্যেই এসে দাঁড়াল মেঘলা | নিজের বোন না হলেও নিজের বোনের থেকে কিছু কমও না মেঘলার কাছে এই জুঁই | মেঘলা কতবার সাহায্য করতে চেয়েছে, কিন্ত জুঁই বলে,” মেরুদন্ডটা বড্ড শক্ত, রক্ষেকর্তাই রক্ষে করবেন “| তা সেই রক্ষে কর্তার দৌলতে জুঁই তার বাবাকে নিয়ে এই অর্থসর্বস্ব সমাজে এখনো টিকে আছে, বিবর্তনের পথে হারিয়ে যায়নি এখনও |

মেঘলাকে দেখে একগাল হেসে আহ্বান জানাল জুঁই নিজের ঘরে | কুশল সংবাদ বিনিময়ের পর মেঘলা জুঁই-এর কাছে আসল কথাটা পাড়ল |

“তোর কাছে আমি একটা সাহায্য চাই, সে জন্যই এই অসময়ে আসতে বাধ্য হয়েছি |” – মেঘলা |

“বলো এই গরিব মানুষটা কী ভাবে তোমার সাহায্যে লাগতে পারে?” -জুঁই |

“তুই তো জানিস আমি বেশ কিছুদিন ধরেই ডাক্তার দেখাচ্ছিলাম | কিন্তু এখন কনফার্ম হয়ে গেছি যে আমার পক্ষে সন্তান ধারণ সম্ভব নয় | তাই আমি চাই তুই আমার সন্তান ধারণ কর, সারোগেসির মাধ্যমে ” – মেঘলা |

“এসব কী বলছ, কিছুই তো বুঝতে পারছি না | নামটা শোনা কিন্তু কী এটা?” -অবাক চোখে উত্তরটা দিল জুঁই |

“দ্যাখ আমার আর অয়নের সন্তান বেড়ে উঠবে তোর গর্ভে, কারণ আমি গর্ভ ধারণে অক্ষম | তোকে দীর্ঘ ৯ মাস একটা সাধারণ মা-এর মতোই সব মেনে চলতে হবে | সমস্ত দায়িত্ব আমার, সমাজের চিন্তাও আমার, আর তার জন্য তোকে আমরা যথোপযুক্ত টাকাও দেব | এবার তুই যদি মত দিস তাহলেই আমার মা হওয়া সম্ভব | প্লিজ না করিস না |” – মেঘলা |

“দ্যাখো দিদি, লেখাপড়া কম জানি | মানছি আমি গরিব, কিন্তু যখন আর পাঁচটা লোক আমার দিকে আঙ্গুল তুলবে, আমার বাবার দিকে আঙ্গুল তুলবে, তখন তো মুখ দেখানোর জায়গা পাবো না | মুখে যতই বলি, এখনও হইনি অতটা উন্নতমনস্ক | আমি পারবো না, আর দয়া করে অনুরোধ কোরো না |” – জুঁই |

মেঘলা জুঁই-এর হাতটা ধরে বলল, “তুই আমাদের সাথে থাকবি | কাকাবাবু, তুই, তোদের সব দায়িত্ব আমার, আর এটা তো কোনো অপরাধ নয়, তাহলে কেন বারবার সমাজ কী বলবে ভাবছি আমরা | এতে সবারই ভাল হবে, প্লিজ আমায় ফেরাস না |”

হাজারো আপত্তি, অনুনয় বিনয় শেষে অসহায় জুঁই একপ্রকার বাধ্য হয়েই মত দিল | শুরু হলো ওদের সমাজের গতানুগতিকতার বিরুদ্ধে লড়াই |

||৫||

( বেশ কিছুদিন পর )

“বাড়িতে মা বাবা তো খুব খুশি | এখুনি আসতে চাইছেন, কিন্তু ওরা এখন আমাদের এখানে এলে তো সবটাই জানাজানি হয়ে যাবে |” অয়ন ফোন রেখে মেঘলাকে বলল |

মেঘলা জুঁই-এর দুধটা গ্লাসে ঢালতে ঢালতে উত্তর দিল,” আমি তো জানাতেই চাই | যখন কোন অন্যায় করছি না, তখন চোরের মতন এত লুকোচুরি, এত মিথ্যা কেন বলতো?”

অয়ন- “সবই বুঝলাম, কিন্তু ওনারা আগেকার দিনের মানুষ, ওনারা এসব বুঝবেন না |”

মেঘলা- “জানি, বুঝবেন না, ওই জন্যই এত সমস্যা, এত ভাবনা | কিন্তু ওনাদের বোঝার অক্ষমতার জন্য আমাদের কিছু তো করার নেই | আর আমি সত্যিই চাই না আমাদের সন্তান কোনো মিথ্যে, খারাপ সিচুয়েশন -এর ভিতর জন্ম নিক | আমি ওর মা, আমি পারবো লড়াইটা সামলাতে |”

||৬||

সন্তান আগমনের চিহ্নগুলো আসতে আসতে প্রকট হচ্ছে জুঁই-এর শরীরে ; শরীরের সাথে সাথে মনেও | এখন নিজের খেয়াল রাখার কথাটাও খেয়াল রাখতে হয় | একটা ছোট্ট প্রাণ তো ওর ভরসাতেই বেড়ে উঠছে | হয়তো ওর আসল মা ও নয়, কিন্তু রক্ত মাংসটা তো ওরই | ছেলে না মেয়ে, কেমন দেখতে হবে, এসব ভাবতে ভাবতে কোথাও যেন আনন্দে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে জুঁই-এর | একটু মন খুলে হাসতে চেয়েও পারে না জুঁই, এ সন্তান তো ওর নয়, ওর তো এর ওপর কোন অধিকারই নেই | এভাবে কী হয়? বহন করলাম, জন্ম দিলাম, তারপর একটু দেখতেও পাব না? এসব ভাবনার মধ্যেই হারিয়ে যায় জুঁই |

*****************

সমাজে বসবাসকারী জীবগুলো যারা প্রয়োজন-এর সময় পাশে থাকে না তাদের জোড়া চোখগুলো এখন একটু বেশিই ঘোরাফেরা করে অয়ন মেঘলার ফ্ল্যাটের উপর | বলা ভাল, জুঁই-এর উপর | পাড়ায় একটা ভাল আড্ডার বিষয় হিসাবে সংযোজিত হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই, বৌদিদের মধ্যেও বেশ মুখরোচক বিষয় | “ওই পোয়াতি মেয়েটা কে বলতো?” বা, “এরা তো ভদ্র বলেই জানতাম, এসব নোংরামো এই বয়সে দেখতে হলো ছি ছি ” ইত্যাদি ইত্যাদি |

জুঁই-এর কানেও যে কথাগুলো পৌঁছছে না তা নয়, কিন্তু কেন জুঁই কিছুতেই মেঘলা দিদির মত করে ভাবতে পারছে না কে জানে? মেঘলা দিদির কাছে পুরোটাই খুব স্পষ্ট | ধূসর বলে কিছু নেই, হয় সাদা নয় কালো, পুরোটাই স্বচ্ছ, তাই মেঘলা দিদি এভাবে ভাবতে পারে | কিন্তু জুঁই নিজের শারীরিক কষ্টকে উপেক্ষা করে একটু একটু করে নিজের সবটুকু দিয়ে কচি প্রাণটাকে বড় করছে , তখন নিজের চরিত্র সম্পর্কে নোংরা মন্তব্য সহ্য করা চাট্টিখানি কথা নয় | একজন মা তো মা-ই হয়, সৎচরিত্র বা দুশ্চরিত্র এই বিশেষণগুলো কী তখন তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে?

||৭||

“দরজায় বেলটা বাজছে, দেখ না একটু |” জুঁই-এর পায়ে তেল মালিশ করতে করতে মেঘলা অয়নের উদ্দেশ্যে বলল |

key hole দিয়ে দেখতেই পাঁচ পা পিছিয়ে গেল অয়ন | অয়নের মা বাবা এসেছেন কোনো খবর না দিয়েই | বার বার বেল বাজানোয় মেঘলা উঠে এল,”কী হলো দরজাটা…”|

অয়ন- “মা বাবা হঠাৎ এসে হাজির | এবার কী করব?”

মেঘলা কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল,” কী আবার করবে? দরজা খোল, কতক্ষন তাদের এভাবে দাঁড় করিয়ে রেখে দেব?” বলে মেঘলা নিজেই দরজাটা খুলে দিল |

হাসি মুখে ফ্ল্যাটে ঢুকলেন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, বৌমার খুশির খবর শুনে বার বার আসতে চেয়েছেন | কিন্তু অয়ন বার বার মানা করে দিয়েছে, বলেছে-এই শরীরে এত জার্নি করে আসতে হবে না | তাই সারপ্রাইজ দিয়ে চলেই এসছেন তাঁরা | কিন্তু বৃদ্ধ-বৃদ্ধার খুশি বেশিক্ষন থাকলো না, মেঘলাকে দেখে অয়নের মা বললেন,” তুই যে বললি আমরা দাদু দিদা হতে চলেছি, তাহলে?”

মেঘলা কথার রেশ টেনে বলল,” হ্যাঁ, ঠিকই তো বলেছে, তোমরা ভিতরে এস | জুঁই ওই ঘরে আছে, আমি ডাকছি |” অয়নের মা বাবা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, কিছুই বুঝতে পারছেন না |

জুঁই বাইরে আসতেই আঁতকে ওঠেন দু’জনই, “এসব কী?” বলেই অসংখ্য জিজ্ঞাসা নিয়ে অয়ন আর মেঘলার দিকে তাকালেন অয়নের মা, বাবা বসেই পড়লেন মাথায় হাত দিয়ে |

“মা আমার আর অয়নের সন্তান বড় হচ্ছে জুঁই-এর মধ্যে, কারণ আমার, সন্তানকে নিজের মধ্যে বড় করার ক্ষমতা নেই | তাই জুঁই আমাদের সাহায্য করছে নিজের শরীর স্বাস্থ্যের কথা না ভেবেই |” -মেঘলা |

“ছি ছি এসব কী বলে যাচ্ছ তুমি বৌমা? আর অয়ন এসব কী শুরু করেছিস তুই আমার ছেলে হয়ে ? ছিঃ |” – অয়নের মা |

“মা তুমি ভুল বুঝছ |” – অয়ন |

অয়নকে থামিয়ে দিয়ে অয়নের মা বললেন, “চুপ কর তুই, কোথাকার কোন ছোটলোকের ঘরের মেয়ে, সে নাকী জন্ম দেবে আমার বাড়ি বংশধরের, ছিঃ |

সহ্যের বাঁধ এবার ভাঙল জুঁই-এর, “ক্ষমা করবেন মাসিমা, আপনাদের মাঝে কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমি কোন ছোটলোকের ঘরের মেয়ে নই | হ্যাঁ, গরিব মানছি, কিন্তু আমিও মানুষ | আর ওনাদের সন্তানের ভ্রূণকে শুধু আমার গর্ভে স্থাপন করা হয়েছে মাত্র ,চিকিৎসা বিদ্যার কারিগরী ছাড়া এটা আর কিছুই নয় | সেটাকে না বুঝে দয়া করে নোংরা মন্তব্য করে, আমায়, এই সন্তানকে, আর নিজেকে আর ছোট করবেন না |”

পেরেছে, আজ পেরেছে জুঁই বলতে, মেঘলা হাসিমুখে তাকাল জুঁই-এর দিকে | কিছুটা হলেও অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহসটুকু জুটিয়েছে আজ জুঁই |

||৮||

“congratulations অয়ন, মেয়ে হয়েছে |” সুখবরটা দিয়ে সায়ক চলে গেল | আজ অয়ন, মেঘলা, জুঁই-এর একটা লড়াই শেষ হলো |

cabin-এ গিয়ে নিজের সন্তানকে মুগধ হয়ে দেখছিল অয়ন আর মেঘলা | প্রথমে খেয়ালই করেনি, যে পাশে শুয়ে জুঁই-এর চোখে আজ জল | আজ তো জুঁই মুক্ত, আবার নিজের মত করে জীবনে চলতে পারবে, তাও কিসে এত যন্ত্রণা হচ্ছে?

অয়ন বেরিয়ে গেল, মেঘলা জুঁই-এর হাত দুটো ধরে কৃতজ্ঞতা সহকারে বলল,” যাই বলি কম বলা হবে, তুই আমার জন্য কী করলি, তুই নিজেও জানিস না |”

একমনে নবজাতকের দিকে তাকিয়ে জুঁই বলল, “জানি, নিজের রক্তমাংসকে একটু একটু করে গড়ে তোমার হাতে তুলে দিলাম |” জুঁই-এর চোখে জল |

মেঘলা বলল, “এভাবে বলিস না, আইনত তুই ওর কেউ না, কোন অধিকার নেই ওর ওপর তোর | কিন্তু আমি এই অধিকার তোর থেকে কখনো কেড়ে নেব না | আমি ওর একমা হলে তুই ওর আরেক মা | সমাজ কবে বদলাবে জানা নেই কিন্তু আমরা তো বদলাতেই পারি | অন্তত শুরু টুকু করতে পারি |”

জুঁই-এর মুখে তখন এক অমূল্য রত্ন ফিরে পাওয়ার হাসি |

ছোট্ট সোনা তখন ঘুমে অচেতন, পাহারায় তখন তার দুই মা, একজন দেবকী তো আরেকজন যশোদা |

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

মুক্তি

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেল, আকাশ তখন থেকে ঠায় বসেই রয়েছে ঘাটে। এখন বাঁধানো ঘাট থেকে করিডোর হয়ে বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরে পুজো দেওয়া অনেকটা সহজ

Read More »

বন্ধু হবি চল

বাক্সপেটরা নিয়ে স্টেশনেই বসে ছিল নয়না, বৃষ্টি পড়েই চলেছে, মুষলধারায়। বাবা বলল আরেকটু অপেক্ষা করতে, এত বৃষ্টিতে তো ছাতাও হার মানবে, আর বেরিয়ে রাস্তাও অজানা

Read More »

টিফিনবাক্স

প্রতিবারের মতন এই বছর ও সমস্ত সরঞ্জাম গুছিয়ে বেরোনোর জন্য ব্যস্ত অমিত, অন্তত সন্ধ্যার মধ্যে বেরোতে না পারলে খুব মুশকিল। পুজোর দিকটা কতদূর কি হলো

Read More »

ক্লিক

।।১।। -“মালিনী, কালকের মিটিংটা কখন ফিক্স করেছ? -“ম্যাম, সকাল ১১টা।” -“ওকে, কনফার্মেশন পেয়ে গেছ?” -“ইয়েস ম্যাম।” -“ওকে গুড। আর।।। এক মিনিট।।।” টেবিল থেকে ফোনটা তুলে

Read More »

শিক্ষা

।।১।। দাপুটে, বদরাগী, মেজাজি এই সব কটা বিশেষণই বেশ ভালো যায় মিসেস বোসের সাথে। রেণুকা বোস আর অমরনাথ বোস সানফ্লাওয়ার এপার্টমেন্টে ১২০০ স্কোয়ারফিটের ফ্ল্যাট 2c

Read More »

বিদায়

।। ১।। রীতিমত জোর করেই নন্দিনীকে পাহাড়ে নিয়ে এলো সঙ্গীতারা। আসার ইচ্ছে তো ছিল না ওর একদমই, শরীর সাথ দিলেও মনটা কোনোভাবেই সাথ দিচ্ছে না।

Read More »

Share with